মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

দ্রোহের কবি নজরুল স্মরণে

মো. আশিকুর রহমান সৈকত

প্রকাশিত: ০১:০৮, ২৮ আগস্ট ২০২২

দ্রোহের কবি নজরুল স্মরণে

ফাইল ছবি

২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত হয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ফলাফল। ২১তম হয়ে পেয়ে যাই বিদ্রোহী কবির নামে প্রতিষ্ঠিত দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ। ভাইভায় ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে সুযোগ পেলেও আর ভর্তি হইনি।

ভর্তি হয়েছিলাম সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের লোকপ্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগে। এ অনুষদে অবশ্য ১৬তম হয়েছিলাম। যা-ই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরই ঊনবিংশ শতকের ইতিহাসের প্রান্তিক নিঃসংশয়বাদী কবি সম্পর্কে, তাঁর সৃষ্টি, দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষত বিদ্রোহ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পর্কে জানার আগ্রহ খুব বেশি বেড়ে গিয়েছিল।

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বিদ্রোহী। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল তাঁর কণ্ঠস্বর। এ কারণেই তিনি ভূষিত হন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে। আজীবন সংগ্রাম করেছেন শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য। সোচ্চার ছিলেন সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে। তরুণদের কাছে তিনি বিদ্রোহের অনন্ত প্রতীক। চির উন্নত শির কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর মাত্র দুই যুগের সৃষ্টিকর্মজুড়ে পরাধীন দেশের মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন।

ঠিক শতবর্ষ আগে, ১৯২২ সালের ০৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল একটি অসামান্য কবিতা। কবিতাটি প্রকাশনার ওইদিন বিজলী পত্রিকা পরপর দুই বার ছাপতে হয়েছিল, যার সংখ্যা ছিল ২৯ হাজার। মুজাফফর আহমদের কাছ থেকে জানা যায়, সেদিন কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ কবিতাটি পড়েছিল, যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরলতম ঘটনা। পরে অবশ্য ‘মোসলেম ভারত’ ও ‘প্রবাসী’সহ অন্যান্য সাময়িকীতেও প্রকাশিত হয়েছিল আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিতাটি। এই কবিতার বদৌলতে ছেলেবেলার দুখু মিয়া পরিণত হন ‘বিদ্রোহী কবি’তে।

কবিতাটির নাম ‘বিদ্রোহী। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে মুজাফ্ফর আহমদের তালতলা লেনের বাসায় এক রাতে এক বসায় ১৩৯ পঙক্তির ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনা করেছিলেন নজরুল। প্রতিবাদ আর বিদ্রোহ যেন নজরুলের চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য। এটিকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন নতুন সৃষ্টির লক্ষ্যে। অন্যায়ের প্রতিবাদ, কুসংস্কার ধ্বংস এবং নতুন সৃষ্টি এই ত্রিমাত্রিক সত্তাই নজরুল প্রতিভাকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। তাই তো ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি বলেছেন—
‘আমি দুর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!’

কবিতার মতো সংগীতেও নজরুল মানুষকে বিদ্রোহের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াকেই তাঁর প্রধান অন্বিষ্ট বলে বিবেচনা করেছেন। তাই দেশের মানুষের সার্বিক মুুক্তির জন্য তিনি গেয়েছেন শৃঙ্খল-মুক্তির গান—
‘এই শিকল-পরা ছল মোদের এই শিকল-পরা ছল।
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল।’
কিংবা
‘কারার ঐ লৌহ-কপাট
ভেঙে ফেল, কর রে লোপাট
রক্ত-জমাট
শিকল পূজোর পাষাণ-বেদী।’
তিনি ‘পুতুলের বিয়ে’ (১৯৩৩) নাটিকায় লিখেছিলেন, ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান, মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।’
নজরুল হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মানবধর্ম লালন করার কথা বলেছেন। তিনি কল্পনা করেছেন এক সাম্যবাদী সমাজের, যেখানে নেই শোষণ, বৈষম্য আর সাম্প্রদায়িক বিভেদ: ‘গাহি সাম্যের গান, যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চান।’

তিনি ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে মানবতাকে সবচেয়ে বড় করে দেখার জন্য ‘মানুষ’ কবিতায় আরও বলেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।/ নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,/ সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’ নজরুল শোষিতের পক্ষ অবলম্বনে কোনো রাখঢাক রাখেননি। তিনি তাঁর সৃষ্টিশীলতার প্রায় সব প্রয়াস মনুষ্যত্ব, মানব ধর্মের বিকাশ এবং প্রগতির পথের বাধা দূর করার জন্য নিবেদন করেছিলেন। নজরুল তাঁর সাহিত্যে পারস্পরিক সাংস্কৃতিক সমন্বয় তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, এর ফলে দুই প্রধান সম্প্রদায়কে এক কাতারে আনা যাবে এবং সমাজে অধিকতর সহনশীলতা নিশ্চিত করা যাবে। তাই তিনি হিন্দু ও মুসলমান ধর্মীয় বিভিন্ন চরিত্র সংমিশ্রণ করে ব্যবহার করেছেন।

কাজী নজরুল ইসলাম সমাজের সব স্তরের, শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন। দুখু মিয়া জানতেন, গরিব কৃষক মুটে-মজুর আর দৌলতবান মানুষের ঈদ-আনন্দ কেমন। তাই তো ‘কৃষকের ঈদ’ কবিতায় ক্ষুব্ধ নজরুল লিখেছিলেন—

‘বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিম আসমানে,
লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গোরস্তানে!
জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ,
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’

১৮৯৯ সালে আসানসোলে জন্ম নেওয়া নজরুলের সৃষ্টিকর্ম ১২৩ বছর পর আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আর তাই তো মহান কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি চাই, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চেতনায় সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ উৎপাটন করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে উঠুক। জেগে উঠুক মানুষের ভেতরের আত্মবিশ্বাস এবং আত্মপ্রত্যয়ের অনমনীয় চিত্ত। তিনি আজীবন অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছেন, দেখিয়েছেন। তাঁর জীবনাদর্শ অনুসরণ করে একটি অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শান্তিপূর্ণ, সুখী-সমৃদ্ধ ও আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ হোক—এটাই আমার প্রত্যাশা

লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।

শেয়ার করুন: