রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

উদীচীর আড়ম্বড়পূর্ণ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

নবযুগ ডেস্ক 

প্রকাশিত: ০০:৪১, ২৫ নভেম্বর ২০২৩

উদীচীর আড়ম্বড়পূর্ণ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

ফাইল ছবি

আড়ম্বড়পূর্ণ আয়োজনে উদযাপিত হলো উদীচীর ৫৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। গত রোববার স্থানীয় কুইন্স প্যালেসের এ আয়োজনে কমিউনিটির বিশিষ্টজন ও সাধারণের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল স্থানীয় বাফা, শিল্পকলা একাডেমি, বহ্নিশিখা, রবীন্দ্র একাডেমীসহ স্থানীয় শিল্পী সংস্থা সমূহকে। এছাড়া অংশগ্রহণ করে উদীচীর ব্রঙ্কস ও জ্যামাইকা শাখা। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ছাড়াও বিশিষ্ট শিল্পী ও আবৃত্তিকার এতে অংশ নেন। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল নাজমুল হুদা। 
বিশিষ্ট লোকগীতি শিল্পী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক রথীন্দ্রনাথ রায় ও কনসাল জেনারেল নাজমুল হুদা প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন এবং সংগঠনের সভাপতি বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত বিশ্বাস বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন করেন। এসময় সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় এবং শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন কনসাল জেনারেল নাজমুল হুদা।

নাজমুল হুদা বলেন, প্রবাসে বাংলা সংস্কৃতির বিকাশ আমাদেরকে সম্মানিত ও গর্বিত করে। সংস্কৃতির বিকাশ যাতে বাঙালি কমিউনিটিতে প্রসার লাভ করে তিনি সর্বতোভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তিনি উদীচীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আলীম উদ্দীন।

উদ্বোধনী পর্বের পর শোক প্রস্তাব ও নিন্দা প্রস্তাব পাঠ করেন সংগঠনের প্রচার সম্পাদক জাকির হোসেন। শোক প্রস্তাবে সম্প্রতি বিশিষ্ট কবি আসাদ চৌধুরী ও জামালপুর উদীচীর প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়। এছাড়া সংগঠন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর আক্রমণে আত্মাহুতি দেওয়া সংগঠনের নেতাকর্মী, শিল্পী ও মুক্তিযুদ্ধে এবং যুদ্ধ পরবর্তীতে সকল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর জায়নবাদী ইজরায়েলের গণহত্যার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন এবং যুদ্ধ বন্ধে বিশে^র সকল গণতান্ত্রিক সরকার ও জনগণকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া ভারতের ‘পিপ্পা’ ছবিতে এ আর রহমান জাতীয় কবি নজরুলের কালজয়ী গান ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানের সুরারোপ বিকৃত করার নিন্দা এবং ক্ষমা প্রার্থনার জন্য প্রযোজক ও গায়কের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। 
শোক প্রস্তাবের পর সকল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। তারপর সংগঠনের সহসভাপতি শরাফ সরকার শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। তিনি আমন্ত্রিত সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

এরপরে আসে নির্ধারিত আলোচকবৃন্দের আলোচনা পর্ব। আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়, লেখক ও সাহিত্যিক কুলদা রায়, লেখক ও প্রকাশক সাগর লোহানী এবং উদীচীর সভাপতি সুব্রত বিশ্বাস। সম্পাদক একে একে আলোচকদের মঞ্চে আহ্বান জানান। এবং তাদেরকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হয়।

সাধারণ সম্পাদকের নাতিদীর্ঘ সূচনা বক্তব্যের পর আলোচনা পর্ব শুরু হয়। প্রথমে সাগর লোহানী তার বক্তব্যে বলেন, উদীচী দীর্ঘদিন থেকে এই প্রবাসে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তিনি বলেন, উদীচীকে দেশের মতো করে এখানে সংস্কৃতি চর্চা করলে হবে না। এখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলা সংস্কৃতি পৌছে দিতে হবে।

লেখক সাহিত্যিক কুলদা রায় বলেন, দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল। শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে হিন্দুর সংস্কৃতি ও ভাষা অভিহিত করে সাম্প্রদায়িক প্রলেপ দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। ধর্মের নামে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বাংলা সংস্কৃতির ওপর আঘাত এসেছে। কিন্তু বাঙালি ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর আক্রমণের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করে গেছে, সফলও হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জাতি একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ ও রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু আজ আমরা এক গ্লানিকর বিপরীত পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে নিপতিত। আমাদের চাওয়া পাওয়া সব স্বপ্ন আজ হারিয়ে গেছে। স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী সরকারের দুর্বলতা ও পৃষ্ঠপোষকতার সুযোগে দ্বিজাতিতত্ত্বের শাপদ গোষ্ঠী এখন পাকিস্তান আমলের চেয়েও শক্তিশালী। এটা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের জন্য এক চরম লজ্জাকর ও অপমানকরও বটে।

শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় বলেন উদীচী গণমানুষের গান গাইবার অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর জন্ম নিয়েছিল। তার নেতৃত্বে ছিলেন দুই প্রথিতযশা শিল্পী সাহিত্যিক লেখক সাংবাদিক, উপমহাদেশের বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ঋতুতুল্য সাধক সত্যেন সেন ও রণেশ দাশগুপ্ত। তাদের হাতে গড়া উদীচী তাদের নীতি ও আদর্শকে লালন ও ধারণ করে আজ এক মহীরুহ। উদীচী জন্মের ৫৫ বছরে আজ শুধু দেশেই নয় বিদেশের বড় বড় শহরে রয়েছে উদীচীর শাখা প্রশাখা। একজন শিল্পী হিসেবে  উদীচীর উত্তরোত্তর অগ্রগতি ও শুভ কামনা করি।

আলোচনাপর্ব ও সংগঠনের সভাপতি সুব্রত বিশ্বাস সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে তিন আলোচক বৃন্দকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, উদীচীর জন্মের পর পর সমগ্র জাতি ও দেশ পরাধীনতার নাগপাশ হতে মুক্তির জন্য পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামে উত্তাল ছিল। স্বাভাবিকভাবে উদীচীর সামনে ছিল এক অগ্নি পরীক্ষা। কিন্তু সদ্য প্রতিষ্ঠিত উদীচীর ভাই-বোনেরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। লক্ষ শহীদের রক্তের সাথে উদীচীর ভাইবোনের রক্তস্রোতও জড়িয়ে আছে।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধের ভীবৎসতার তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে আবার উদীচী যাত্রা শুরু করে। সংগঠনকে সংগঠিত করার পাশাপাশি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায় জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়। তারপর বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী দেশকে পুনরায় পাকিস্তানী ভাব্যধারায় পরিচালিত করার প্রয়াস পায়। স্বাভাবিক ভাবে উদীচীর যাত্রাপথ মোটেও মশৃণ ছিল না। বার বার প্রতিক্রিয়ার আঘাত এসেছে উদীচীর ওপর। ১৯৯৯ সালে যশোহরে উদীচীর জাতীয় সম্মেলনে বোমা হামলা হয়েছে। সেখানে ১০০ জনের ওপর শিল্পী কর্মী গুরুতর আহত হন। ১০জন শিল্পী কর্মী ঘটনাস্থলেই মারা যান। ৫০ জনের ওপর জীবনের মতো পঙ্গু হয়ে যান। ইতিমধ্যে তাদের অনেকের মৃত্যু হয়েছে। ২০০৫ সালে আবার নেত্রকোনায় উদীচী অফিসে বোমা হামলা হয়। সেখানে জেলা পর্যায়ের দু’জন শিল্পী মারা যান। দুঃখের বিষয় আজ স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী সরকার ক্ষমতায়। দুঃখজনক একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, পল্টনে বোমা হামলা, বটমুলে বোমা হামলা সহ অনেক হত্যাকান্ডের বিচার হলেও ২২ বছর যাবৎ উদীচী হত্যা বিচার হয়নি। 
পরিশেষে তিনি বলেন, প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের অত্যাচার নির্যাতন, রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে উদীচী সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্তের নীতি আদর্শ ধারণ ও অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছে। উদীচীর লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত উদীচীর সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।

উদ্বোধনীপর্ব থেকে আলোচনা পর্ব পর্যন্ত পুরো অংশটি পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আলীম উদ্দীন। আলোচনা পর্বের শেষে সাংস্কৃতিকপর্ব পরিচালনার জন্য মাইক্রোফন হস্তান্তর করেন সাংস্কৃতিক সম্পাদক ক্লারা রোজারিও’র কাছে।

নাচে-গানে-পিয়ানো ও কবিতার ছন্দে ভরপুর দীর্ঘ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি পরিচলানা করেন সাংস্কৃতিক সম্পাদক ক্লারা রোজারিও। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর যৌথ ও একক এবং একক অতিথি শিল্পী ছাড়া আমন্ত্রিত অতিথি সংগঠনের শিল্পীদের নাচে-গানে দর্শক শ্রোতাদের মনোমুগ্ধ করে তুলে পুরো অনুষ্ঠানটি।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও ছিল শিশু কিশোরদের অংকন প্রতিযোগিতা। পরিচালনা করেন সুপর্ণ সরকার ও মুনমুন সাহা। বিচারক ছিলেন ঢাকা চারুকলা থেকে ডিগ্রীধারী ফজলে আলী কচি। প্রতিযোগীদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থান দখলকারীদের পুরস্কৃত করা ছাড়াও সকল প্রতিযোগীদের সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। এছাড়াও আমন্ত্রিত সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে বিশেষ সম্মাননা পদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়। 
উল্লেখ্য, উদীচীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শিল্পী রথীন্দ্রনাথ আজীবন বাংলা কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে অবদান ও ভূমিকা রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ বিশেষ সম্মাননা সনদ প্রদান করা হয়। প্রদান করেন উদীচীর সভাপতি সুব্রত বিশ্বাস, সাথে সম্পাদক, সহসভাপতি সহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

শেয়ার করুন: