শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

‘থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী এক মৃত্যু’

চলেই গেলেন জুলাই  বিপ্লবী ওসমান হাদি আজ বিশেষ মোনাজাত

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা

প্রকাশিত: ১৯:১৮, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫

চলেই গেলেন জুলাই  বিপ্লবী ওসমান হাদি আজ বিশেষ মোনাজাত

ছবি: সংগৃহীত

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ওসমান হাদি মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। সিঙ্গাপুরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে ইনকিলাব মঞ্চ ও ওসমান হাদির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া পোস্টে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
ইনকিলাব মঞ্চের ফেসবুক পোস্টে বলা হয়েছে, ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদের মোকাবিলায় মহান বিপ্লবী ওসমান হাদিকে আল্লাহ শহীদ হিসেবে কবুল করেছেন।’
এদিকে, হাদিকে নিয়ে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করেছেন সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি পোস্টে লেখেন, ‘আমাদের ভাই হাদী রওনা দিয়েছেন অনন্তের পথে। আবরার, আবু সাঈদদের মতো হাদী না থেকেও আরো বেশি করে থাকবেন বাংলাদেশের বুকে। ইউ ফেইলড টু কিল ওসমান হাদী!’
জুলাই অভ্যুত্থান ও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিচিতি পাওয়া হাদি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকায় গত শুক্রবার চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে দুর্বৃত্তরা রিকশায় থাকা হাদিকে গুলি করে। গুলিটি হাদির মাথায় লাগে।
গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে অস্ত্রোপচার শেষে রাতেই তাঁকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে গত সোমবার দুপুরে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়।
হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় পরিবারের সম্মতি নিয়ে গত রোববার রাতে পল্টন থানায় একটি মামলা করা হয়। ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল জাবের মামলাটি করেন।
থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী এক মৃত্যু আমাদের কাঁধে এসে পড়েছে বৃহস্পতিবার রাতে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক যুগ-সন্ধিক্ষণে, ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর মোড়ে দাঁড়িয়ে যে সাহস বুক পেতে দিয়েছিল সে বুক আজ নিথর। গণতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের লড়াইয়ের ময়দানে যে কণ্ঠ ছিল অবিচল, যে চোখে ছিল ভবিষ্যতের স্বপ্ন, সেই কণ্ঠ আজ নীরব, সেই চোখ চিরতরে বন্ধ।
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান হাদি আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার চলে যাওয়া কোনো সাধারণ মৃত্যু নয় এ এক রাজনৈতিক ক্ষয়, এক নৈতিক শূন্যতা, এক প্রজন্মের স্বপ্নে নেমে আসা গভীর অন্ধকার। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে থেকেও তিনি ছিলেন বাংলার রাজপথে, মানুষের অধিকারের পাশে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক অদম্য নাম।
তিনি জানতেন এই পথ ঝুঁকির, এই লড়াইয়ের মূল্য আছে। তবু তিনি পিছু হটেননি। বুক পেতে দিয়েছিলেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন গণতন্ত্র ভিক্ষা নয়, অধিকার; ন্যায়ের পথে নীরবতা অপরাধ। তার জীবন ছিল এক জীবন্ত প্রতিবাদ, আর তার মৃত্যু হয়ে উঠল এক ভারী প্রশ্ন আমরা কী সেই সাহস ধারণ করতে পারবো?
বৃহস্পতিবার (১৮ই ডিসেম্বর) রাতে ইনকিলাব মঞ্চ তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। কিন্তু সত্যটা আরও গভীর; আজ শুধু একজন মানুষ নয়, আজ পতন হলো একটি দীপ্তকণ্ঠ, একটি নির্ভীক উপস্থিতি। তবু ইতিহাস সাক্ষী এমন মানুষরা কখনো পুরোপুরি মরে না। তারা রয়ে যায় লড়াইয়ের ভাষায়, প্রতিরোধের শপথে, নতুন প্রজন্মের চোখে। শরীফ ওসমান হাদি আপনি থাকবেন। আপনার সাহস থাকবে। আপনার স্বপ্ন থাকবে। আর এই শূন্যতা তরুণ প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেবে গণতন্ত্রের পথ কখনো সহজ নয়, কিন্তু সেই পথে হাঁটার মানুষরা অমর।
ইতিহাস স্বীকার করবে, তার অবদান কেবল কোনো সংগঠনের নেতৃত্বে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা ছিল একটি সময়ের নৈতিক প্রতিবাদ, একটি প্রজন্মের সাহসী উচ্চারণ। শরীফ ওসমান হাদির জীবন ছিল সংগ্রাম, সাহস ও দায়বদ্ধতার এক অনন্য দলিল। তিনি রাজনীতিকে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে দেখেননি; দেখেছেন দায়িত্ব হিসেবে, আত্মত্যাগের ক্ষেত্র হিসেবে। যখন ভয় ছিল রাষ্ট্রের নিত্যসঙ্গী, যখন নীরবতা হয়ে উঠেছিল টিকে থাকার কৌশল ঠিক তখনই তিনি কথা বলেছেন। স্পষ্ট, দ্বিধাহীন, আপসহীন।
হাদি বিশ্বাস করতেন, গণতন্ত্র কোনো বিমূর্ত ধারণা নয় এটি মানুষের দৈনন্দিন মর্যাদা, ভোটের অধিকার, ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি রাজপথে নেমেছেন, আন্দোলন গড়েছেন, তরুণদের সংগঠিত করেছেন। দমনপীড়ন, নজরদারি, হুমকি কিছুই তাকে থামাতে পারেনি। কারণ তার সংগ্রাম ব্যক্তিগত নয়; তা ছিল সামষ্টিক মুক্তির স্বপ্নে প্রোথিত।
তিনি জানতেন, ফ্যাসিবাদ কেবল একটি শাসনব্যবস্থা নয় এটি ভয় তৈরি করে, মানুষকে একা করে দেয়। তাই তার সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ভয়ের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সাহসের সংস্কৃতি তৈরি করা। যারা প্রথমবার রাজপথে নামতে ভয় পেতো, তিনি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যারা কথা বলতে দ্বিধায় ছিল, তিনি তাদের কণ্ঠে আস্থা জুগিয়েছেন।
শরীফ ওসমান হাদির সাহস প্রদর্শনমূলক নয়- ছিল নীরব, গভীর, দৃঢ়। তিনি জানতেন এই সাহসের মূল্য দিতে হতে পারে জীবন দিয়েও। তবু তিনি পিছু হটেননি। বুক পেতে দিয়েছিলেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন ইতিহাস কখনো নিরাপদ মানুষের কাঁধে ভর করে এগোয় না; এগোয় ঝুঁঁকি নেয়া মানুষের রক্তে-ঘামে।
সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও তার আহত শরীর-মন পড়ে ছিল দেশের দিকে, আন্দোলনের দিকে, মানুষের ভবিষ্যতের দিকে। শারীরিক দুর্বলতা তার রাজনৈতিক দৃঢ়তাকে ভাঙতে পারেনি। এই অদম্য মানসিক শক্তিই তাকে আলাদা করেছে একজন সাধারণ কর্মী থেকে এক প্রতীকী চরিত্রে।
তার মৃত্যু একটি শূন্যতা কিন্তু সেই শূন্যতাই পূরণের দায় জাগ্রত জনতার। তারুণ্যের দায় তার আদর্শ বহন করার, তার সাহসকে ছড়িয়ে দেয়ার, তার অসমাপ্ত স্বপ্নকে সম্পূর্ণ করার। তিনি জুলাইয়ের পটভূমিতে শিখিয়ে গেছেন গণতন্ত্র রক্ষা করা মানে শুধু ভোট দেয়া নয়; প্রয়োজনে বুক পেতে দেয়া।
শরীফ ওসমান হাদি চলে গেছেন, কিন্তু তার অবদান রয়ে গেছে সংগ্রামের ভাষায়, সাহসের ইতিহাসে এবং জাতির 
ওসমান হাদির মৃত্যুতে শুক্রবার বিশেষ মোনাজাত, শনিবার রাষ্ট্রীয় শোক:
‎শহীদ শরিফ ওসমান হাদির অকাল মৃত্যুতে আগামী শনিবার এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজ বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে এই ঘোষণা দেন তিনি।
সিঙ্গাপুরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন হাদি। এই উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক একটি সংবাদ নিয়ে। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সম্মুখভাগের অকুতোভয় যোদ্ধা ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি আর আমাদের মাঝে নেই।’
শরিফ ওসমান হাদির এই অকাল মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে ড. ইউনূস বলেন, তাঁর প্রয়াণ দেশের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পরিসরে এক অপূরণীয় ক্ষতি।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আমি তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত স্ত্রী, পরিবারের সদস্যবৃন্দ, স্বজন ও সহকর্মীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। শহীদ ওসমান হাদির স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানের দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করবে।’
এ সময় হাদির মৃত্যুতে আগামী শনিবার (২০ ডিসেম্বর) এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, শহীদ শরিফ ওসমান হাদির অকাল মৃত্যুতে আগামী শনিবার এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করছি। এই উপলক্ষে শনিবার দেশের সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে।
একই সঙ্গে আগামীকাল শুক্রবার বাদ জুমা দেশের প্রতিটি মসজিদে শহীদ ওসমান হাদির রুহের মাগফিরাত কামনায় বিশেষ দোয়া ও মোনাজাতের আয়োজন করা হবে বলে জানান ড. ইউনূস। তিনি বলেন, অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয়গুলোতেও আয়োজন হবে বিশেষ প্রার্থনার।
 

শেয়ার করুন: