ছবি: সংগৃহীত
তফসিল ঘোষণার মধ্যদিয়ে নির্বাচনী ট্রেনের যাত্রা শুরু হলো। গতকাল বৃহম্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি ভোটগ্রহণ। একই দিন জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে হবে গণভোট।
নির্বাচনের মনোনয়ণপত্র দাখিলের শেষ দিন ২৯ ডিসেম্বর। জাতীয় নির্বাচনের তফসিলকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তফসিল ঘোষণা করায় নির্বাচন কমিশনকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করেন। সিইসি’র ভাষণটি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে একযোগে প্রচার করা হয়।
তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র বাছাই ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের ১১ জানুয়ারি এবং আপিল নিষ্পত্তি হবে ১২ থেকে ১৮ জানুয়ারি। অন্যদিকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ২০ জানুয়ারি। প্রতীক বরাদ্দ করা হবে ২১ জানুয়ারি। নির্বাচনী প্রচার শুরু হবে ২২ জানুয়ারি, প্রচার শেষ হবে ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। একই দিনে দু’টি ভোট হওয়ায় এবার ভোটের সময় এক ঘণ্টা বাড়িয়ে নয় ঘণ্টা করা হয়েছে। অর্থাৎ, ১২ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বিকাল সাড়ে চারটা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোটগ্রহণ চলবে। এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৯৩ জন। প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটাররাও পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
১২ মিনিটের ভাষণে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন সিইসি। একই সঙ্গে জুলাই-আগস্ট ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের আত্মার শান্তি কামনা করেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে ২০২৪-এর ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত সার্বভৌমত্ব এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার সকল আন্দোলনে যারা আহত, নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের প্রতি জানাই আমার আন্তরিক সমবেদনা। আহতদের দ্রুত আরোগ্য এবং স্বাভাবিক জীবনের জন্য প্রার্থনা করছি। জাতি হিসেবে আমাদের অমোঘ শক্তি হচ্ছে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের জন্য আমাদের ভালোবাসা ও আত্মত্যাগ। জাতির প্রত্যাশাকে ধারণ করে আমাদের সংবিধান রাষ্ট্রের উপর জনগণের একচ্ছত্র মালিকানা নিশ্চিত করেছে।
তিনি বলেন, জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল মালিকানা প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হচ্ছে নির্বাচন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মানসম্মত নির্বাচনের অনুপস্থিতি প্রায়শই আমাদের ঐতিহ্য এবং সামষ্টির প্রত্যাশাকে ম্লান করেছে। এমনই এক প্রেক্ষাপটে ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। আমাদের ভাইবোন- সন্তানদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আমাদের অঙ্গীকার হচ্ছে, একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠান, যা জাতি হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করবে এবং বিশ্বদরবারে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনারা একই প্রত্যাশা ধারণ করেন এবং একই অঙ্গীকারে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
সিইসি বলেন, গত এক বছরে নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি ভোটবিমুখ এবং বাদ পড়া প্রায় ৪৫ লাখ ভোটারকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং ২১ লক্ষাধিক মৃত ভোটারকে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। নারী ভোটারদের যথাযথ অন্তর্ভুক্তির অভাবে পুরুষের সঙ্গে নারী ভোটারের ব্যবধান বেড়ে প্রায় ২৯ লাখে গিয়ে দাঁড়ায়। বাদ পড়া নারী ভোটারদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সেই ব্যবধান উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা হয়েছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, নির্বাচনের জন্য ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৮৩ জন ভোটারের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৬ কোটি ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ৯০৭ জন এবং নারী ভোটারের সংখ্যা ৬ কোটি ২৮ লাখ ৭ হাজার ৯৪২ জন।
তিনি বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের বিভিন্ন সুপারিশের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব মূল্যায়ন ও অংশীজনের পরামর্শের ভিত্তিতে এসব সংস্কার করা হয়েছে। এই উদ্যোগ সফলভাবে সম্পন্ন করতে সহযোগিতার জন্য আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনসহ সকল অংশীজনদের জানাই আমার কৃতজ্ঞতা।
চার কারণে এবারের নির্বাচনকে ‘জাতির ইতিহাসে অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে অভিহিত করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, প্রথমত, প্রকৃত গণতান্ত্রিক ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কাক্সিক্ষত সংস্কার প্রশ্নে সিদ্ধান্তের নির্বাচন এটি। এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে যা একটি নতুন অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্ট সকল রাষ্ট্রীয় ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের জন্য এই নির্বাচন হচ্ছে সক্ষমতা প্রমাণ করে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের অনন্য সুযোগ। তৃতীয়ত, দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের পর দেশের স্বার্থে রাজনৈতিক দলসমূহের মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার ধারা প্রবর্তনের দাবি রাখে এই নির্বাচন। চতুর্থ কারণ হিসেবে প্রবাসী ও কারাগারে থাকা ব্যক্তিদের ভোটের আওতায় আনার কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, প্রায় অকার্যকর পোস্টাল ভোট ব্যবস্থাকে পরিমার্জন করে এই নির্বাচনে একটি কার্যকরী রূপ দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অন্যতম চালিকাশক্তি আমাদের রেমিটেন্স যোদ্ধা তথা প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের প্রথমবারের মতো ভোটের আওতায় আনা হচ্ছে। একইভাবে প্রথমবারের মতো ভোটের আওতায় আসছেন আইনি হেফাজতে থাকা ভোটারগণ। এছাড়াও নিজ নির্বাচনী এলাকার বাইরে কর্মরত সরকারি কর্মচারী এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিগণ পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে এবার ভোট দেবেন।
সিইসি আরও বলেন, ভোট আপনার শুধু নাগরিক অধিকারই নয় বরং পবিত্র আমানত ও দায়িত্ব। এই দায়িত্ব সচেতনভাবে আপনারা পালন করবেন- এ আমার বিশ্বাস। যে কোনো ভয়ভীতি, প্রলোভন, প্রবঞ্চনা এবং সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে নিঃসংকোচে আপনাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করুন। আপনাদের নিরাপদ ও উৎসবমুখর অংশগ্রহণকল্পে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান ও বাহিনী কাজ করবে। ধর্ম, গোত্র, গোষ্ঠী, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলে এই আনন্দ আয়োজনে অংশগ্রহণ করুন। পরিবারের প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ও সন্তানসম্ভবা মা-সহ সকলকে নিয়ে ভোট দিতে আসুন। আমি আশা করি আপনাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভোটের অনুষ্ঠান উৎসবে রূপ নেবে।
সিইসি বলেন, বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো হয়ে থাকে। বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অসত্য তথ্য ও অপতত্ত্বের বিস্তার দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। প্রতিপক্ষ দল ও প্রার্থীকে হেয় করার পাশাপাশি নারীদের প্রতি বিদ্বেষমূলক প্রচারণা আমাদের ঐতিহ্যকে ক্ষুণ্ন করে এবং নির্বাচনকে কলুষিত করে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী এটা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আপনাদের প্রতি আমার বিশেষ অনুরোধ অসত্য এবং অসৎ উদ্দেশ্যে প্রচারিত কোনো তথ্যে কান দিবেন না, গ্রহণ করবেন না। মনে রাখবেন অসত্য তথ্য শেয়ার করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক প্রার্থী এবং দলসমূহের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, আসুন আমরা আচরণবিধি মেনে একটি শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর নির্বাচন নিশ্চিত করি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা নিশ্চিত করে ভোটারদের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনই হোক আপনাদের লক্ষ্য নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী। নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর কমিশনের অংশ হিসেবে আপনারা নির্ভয়ে সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন। মনে রাখবেন, এ ব্যাপারে কোনো শিথিলতা বা গাফিলতি সহ্য করা হবে না। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সকল রাজনৈতিক দল ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীসহ ভোটারদের আন্তরিক অংশগ্রহণ ও সক্রিয়তা কামনা করছি। সকলের প্রতি আমার আহ্বান আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট সফল করে আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখুন। মহান আল্লাহ্ আমাদের সহায় হোন।
গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, একটি সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংবাদমাধ্যম ও পর্যবেক্ষক সংস্থার সহকর্মীদের ভূমিকা অপরিসীম। আপনারা স্বাধীনভাবে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে আপনাদের দায়িত্ব পালন করবেনÑ এটি আমাদের প্রত্যাশা।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ই আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু হয়। এ সরকারের বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে ২০২৫ সালের ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দেন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হবে। পরে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোটের সিদ্ধান্ত হয়। ১৩ই নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দেন, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট হবে। ওই ঘোষণার সময়সীমার মধ্যে এ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে এটিই প্রথম নির্বাচন।

















