শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

‘বয়ে চলে কুড়ানদী’ গ্রন্থ নিয়ে দুটি কথা

সুব্রত বিশ্বাস

প্রকাশিত: ২২:১০, ১৯ আগস্ট ২০২২

‘বয়ে চলে কুড়ানদী’ গ্রন্থ নিয়ে দুটি কথা

ফাইল ছবি

বয়ে চলে কুড়া নদীজীবন ঘনিষ্ট একটি বইয়ের নাম। লেখকের জীবন কাহিনী পরিবারিক ইতিহাস, রাজনীতি-সমাজনীতিসহ নানাবিধ ঘটনা বইয়ের প্রধান প্রতিপাদ্য। পাশাপাশি এলাকার ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে খন্ডিত আকারে ধর্ম ধর্মীয় অনুসুঙ্গ স্থান পেয়েছে। আমার সাথে  লেখকের পরিচয় সম্পর্ক ষাটের দশকের শেষ দিকে। আর সেটা ছাত্র ইউনিয়নের একজন কর্মী হিসেবে। লেখক তখন স্কুলের ছাত্র  এবং প্রগতিশীল ছাত্র ইউনিয়নের একনিষ্ঠ কর্মী। আমি তখন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপের সক্রিয় কর্মী। সেই থেকে অনুজপ্রতীম সহকর্মী হিসেবে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা বন্ধুত্বের সম্পর্ক।

কুড়া একটি নদীর নাম। আবার কুড়া একটি পাখিরও নাম। আবহমানকাল থেকে গ্রাম বাংলায় চলাচলের প্রধান পথ বা উপায় ছিল নদী। তাই গ্রামে-গঞ্জে নদীর তীরে, নদীর দুই পাড়ে জনবসতি গড়ে ওঠার ধারা সেই আদিকাল থেকে। লেখকের নিজস্ব ভাদেশ^ গ্রামটিও গড়ে ওঠে তারই বর্ণিত কুড়া নদীর পাড় ঘেঁষে। নদীর সৌন্দর্য্য অলঙ্কার তাই দুপাড়ে গড়ে ওঠা জনবসতি। নদী তীরের প্রাণচাঞ্চল্যও দুপাড়ের বসতি তার কোলাহল। কুড়া নদীও তার দুপাড়ের জনপদের ইতিহাস ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে গেছে আবহমানকাল থেকে। যদিও কালের পরিক্রমায় কুড়া নদী আজ মৃত। কুড়া নদীর প্রয়োজনীয়তা আজ হয়তো কুড়া পাড়ের জনগণের আর নেই। কিন্তু কুড়া নদী মরে গেলেও লেখক তার লেখার পরতে পরতে কুড়া নদীর ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে ইতিহাসের দায় মিটিয়েছেন। কুড়া নদীর অতীতকে জীবন্ত করে ফুটিয়ে তুলেছেন। পাশাপাশিকুড়া পাখিগ্রাম-বাংলার একটি শিকারী পাখির নাম। লেখক সেটির ইতিহাস সন্নিবেশিত করতেও ভুল করেননি। আধুনিক বৈশি^ চাপে গ্রাম-বাংলার বহু ইতিহাস ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তপ্রায়। কুড়া পাখিও একই গতিধারায় পড়ে বিলীন হয়ে গেছে। তাই বলে বিলীনপ্রাপ্ত কুড়া পাখির ইতিহাস খাটো করে দেখেননি। বরং গ্রাম-বাংলার ইতিহাসের অংশ হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। 

লেখকের মতে ভাদেশ^ গ্রামটি গড়ে ওঠার পেছনে মহেঞ্জোদারো আর হরপ্পা সভ্যতার প্রাপ্ত নিদর্শনের সাথে অঞ্চলের সভ্যতার মিল রয়েছে। প্রমাণ হিসেবে প্রতœতাত্ত্বিকদের ধারণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী কৈলাস পাহাড়ে প্রাপ্ত শিলালিপি জগন্নাাথ মিশ্রের বাড়ি, শ্রীচেতন্য দেবের আগমন আর নবী সুলাইমান (.)-এর বংশের উত্তরাধিকার দাবিদার এলাকার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের বসবাস থেকে ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে। সেটাও কুড়া নদীকে আশ্রয় করেই বর্ণিত। 

মৎস্যজীবী হিসেবে স্বতন্ত্র এই জনগোষ্ঠী কালের ধারায় আবর্তিত হয়ে হিন্দু-মুসলিম দুই গোত্রে দুই ধারার সৃষ্টি হয়েছে বলে জনশ্রুতি। হিন্দু ধারায় প্রবর্তিত অংশ বশ্য বা নম:শুদ্র জাতি গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়ে স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রেখে এসেছে। আবার অন্যত্র ব্রাম্মণ্যবাদের আবির্ভাবে ব্রাম্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য শুদ্র বিভাজিত চতুবর্ণ জাতি গোষ্ঠীর উদ্ভবের উল্লেখ করা হয়ছে। এসব জটিল   বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা এক্ষেত্রে যথার্থ মনে করি না। এই ক্ষুদ্র পরিসরে সে আলোচনা সম্ভব নয়, প্রয়োজনও বোধ করিনা। তবে নবদ্বীপ, বৃন্দাবন আদি তীর্থপীঠের সাথে এই অঞ্চলের একটি যুগসূত্র যে ছিল তথ্য প্রমাণে যথেষ্ট সত্যতা প্রতীয়মান হয়। শ্রী চৈতন্য দেব, তার পিতামহের আগমন পাশাপাশি শচীরাণীর গর্ভে নিমাইয়ের জন্ম কীর্তিকলাপ বহুলাংশে সত্যতা প্রমাণের অবকাশ রাখে। এসব প্রসঙ্গে সিলেটের ইতিবৃত্ত বইয়ের  লেখক অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি তার বইতে ধর্ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘শ্রীহট্ট জিলার সীমাদেশে প্রায় চারিদিকেই দেবতাদের অবস্থান দৃষ্টে জিলাকে দেবতারক্ষিত দেশ বলিলে, অসঙ্গত বলা হয় না।

কালের বিবর্তনে কুড়া তীরবর্তী এলাকায় সনাতন সভ্যতার পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ইসলামের আবির্ভাব, মুহাম্মদ বিন কাসেমের সিন্ধু বিজয়, ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক আকর্ষণে নেমে আসা শেখ ইসমাইল, দাতা গঞ্জবক্স, খাজা ইসমাইল গাজি, দরবেশ হযরত শাহজালালের আগমনে  লেখকের আবেগ স্বতস্ফূর্ততার উল্লেখ রয়েছে এবং ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের ফলে ইসলামের ঢেউয়ের সাথে শ্রীচৈতন্য দেব শ্রী শঙ্করাচার্যের একেশ^রবাদ ইসলামের একেশ^রবাদের সাথে একীভূত যুগসূত্রের অভিব্যক্তির উল্লেখ করা হয়েছে।

লেখক তার জন্ম বৃত্তান্তে প্রশ্ন রেখে লিখেছেন, পবিত্র রমজান মাসের অন্যতম বেজোড় রাত্রের শেষ প্রহর। কেমন ছিল সে রাত? আষাঢ়ের অঝোর ধারার বৃষ্টি¯œাত রজনীর শেষ প্রহর থরথর করে কি কেপে উঠেছিল, দরবেশ শেখ আনোয়ারুল ইসলাম তথা বাবার আজান ধ্বনীতে? প্রশ্ন রেখেছেন, সেদিন যদি এভাবে জন্ম না হয়ে অন্য কোথাও অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষের ঘরে হতো, তাহলে কি হতো তার পরিচয়? তবে দায় তার নয়, সৃষ্টিকর্তার। এজন্য শেখ পরিবারে জন্মের জন্য পিতামাতা এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। এবং জ্ঞান-বুদ্ধি বৃদ্ধির পরবর্তীতে বংশ পরমপরায় পরিবারের অবস্থান খ্যাতিতে নিজেকে উচ্চসিত কৃতার্থ মনে করেছেন। তাই বইয়ের বিরাট অংশ জুড়ে পরিবার পরিবারের লোকজনের গুণাবলী, পরিচিতি অবদান তুলে ধরতে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন।

কুড়া নদীর বহমান জলধারার ন্যায় লেখক নিজের জীবন প্রবাহের তুলনা করেছেন। তাই জীবন সংগ্রামের গতিধারায় বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত, আশা-নিরাশা, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির ঘটনাপ্রবাহ বইয়ের অন্যতম প্রধান প্রতিপাদ্য হিসেবে স্থান পেয়েছে। পারিবারিক রীতি অনুসারে ধর্মীয় শিক্ষার গৃহশিক্ষক ইন্তাজ আলী স্কুল শিক্ষক বারীন্দ্র নাথ দুই শিক্ষাগুরুর ভিন্নধর্মী শিক্ষা লেখকের প্রাথমিক জীবন শুরুর প্রাক্কালে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। তাই জীবন জিজ্ঞাসা প্রসারিত করতে ইকবালের শিকওয়া-জওয়াবে শিকওয়া, রুবাইয়াতে ওমর খৈয়াম, আকবরের দীন--ইলাহি, শেখ সাদী, আবুজর গিফারী এদের জীবনাদর্শনে আকৃষ্ট হয়েছেন। অন্যদিকে শ্রীচৈতন্য দেব আর শঙ্করাচার্যের একেশ^রবাদ থেকে আবার তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে ইসলামের একেশ^রবাদে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ পার্থক্য কিশোর মনকে ভারাক্রান্ত করেছে।

এসব হতবিহ্বলতার এক পর্যায়ে ১৯৬৭ সালে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিনের সাথে যুক্ত হওয়া। স্থানীয়ভাবে এবং জেলা ছাত্র ইউনিয়নের নানা কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে পড়া। এলাকায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে নেতৃত্ব দেওয়া ইত্যাদি। এসব আন্দোলন সংগ্রামের পেছন বুদ্ধি, পরামর্শ, উৎসাহ যুজিয়েছে প্রিয় শিক্ষক নজির হোসেনর অনুপ্রেরণা। মুক্তিযুদ্ধে না গেলেও মুক্তিযুদ্ধের কর্মকান্ডে সক্রিয় থাকেছেন।

জীবন সংগ্রামে উত্থান পতনের ধারাবাহিকতায় কখনো ব্যবসা, কখনো চাকুরী, পাশাপাশি রাজনীতি সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত থাকার বিশদ উল্লেখ পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাশ করে আইন পেশায় যোগ দিয়ে আইনপেশার বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করেছেন। প্রতিনিধি হিসেবে ভারত, নেপাল, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন। আইন ব্যবসার প্রয়োজনে যুক্ত হয়েছেন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ . কামাল হোসেনের আইনী প্রতিষ্ঠানের সাথে। তখন আবার . কামাল হোসেনের গণফোরামের সাথে যুক্ত হয়েছেন। কর্মক্ষেত্রে অবস্থান পরিবর্তনের পাশাপাশি রাজনীতির অবস্থান পরিবর্তন জীবনের প্রয়োজনে, সমাজের কল্যাণে নাকি রাজনীতির প্রয়োজনে প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যায়। অবশ্য রাজনীতির সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের অবস্থান পরিবর্তন নতুন কোন বিষয় নয়। অস্বাভাবিকও নয়। লেখকের ক্ষেত্রেও হয়তা একই সত্য প্রযোজ্য। তবে বিভিন্ন অবস্থান পরিবর্তন সত্বেও লক্ষণীয় হলো, জীবনের শুরুতে যাদের সাথে সম্পৃক্ততা গড়ে উঠেছিল তাদের সাথে আজও যথারীতি সম্পর্ক অব্যাহত আছে।

চাকুরী, আইন ব্যবসার পাশাপাশি পত্রপত্রিকায় কলাম লেখা অন্যতম নেশা। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় লেখা নির্বাচিত কলাম নিয়ে তার প্রথম বইকালের ধ্বনি তারই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর স্বরচিত লেখা, দেশ বিদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের স্মৃতিচারণ নিয়ে জীবন কাহিনীমূলক বই। বইটি পড়েছি, এটি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তৃতীয় গ্রন্থবয়ে চলে কুড়া নদীলেখকের জীবনের স্মৃতিচারণমূলক বই হলেও কালের ধারায় নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি জনপদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যা, বইয়ের আবেদন গুরুত্ব বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। লেখক, প্রকাশক সংগঠক জনাব বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সলের ছোট্ট সুন্দর মুখবন্ধে তার একটি পরিপূর্ণ চিত্র ফুটে উঠেছে। এরপর আর বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না।

বইয়ের লেখায় শব্দচয়ণ, শব্দের প্রয়োগ, প্রসঙ্গের ধারাহিকতায় ভিন্ন প্রসঙ্গ অবতারনায় যুথসই সামঞ্জস্য রক্ষায় কোনও ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয়নি। প্রসঙ্গের সাথে তথ্য যুক্তি লেখার মান বৃদ্ধি করেছে। এতে লেখকের লেখার হাত যথেষ্ট পাকা বলে প্রতীয়মান হয়। চাকুরী, ব্যবসা, আইন ব্যবসা এবং রাজনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্যক বিচরণের অভিজ্ঞতা বিধৃত হয়েছে সমগ্র বই জুড়ে। স্বাভাবিকভাবে পাঠকবৃন্দ বিভিন্নমুখী ঘটনার আলোকে হৃদ্ধ হবেন বইটি পড়ে।

পরিশেষে বলা চলে, ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়েও জীবন শুরুর প্রাক্কালে অসম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে ওঠা আদর্শ, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং মানুষের কল্যাণে যে চেতনা লালন করে এসেছেন আজও তার ব্যত্যয় ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। বরং ধারাবাহিক অভিজ্ঞতায় আরও দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছে। তাই সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ একজন ব্যক্তির এখানেই মহত্বের পরিচয়। আমি তার আপনজন, কাছের মানুষ। তার মঙ্গল কামনা করি।  

শেয়ার করুন: