বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

শব্দের অর্থ নয় উদ্দেশ্যটাই আসল

কাজী জহিরুল ইসলাম, কবি ও ভাষাশিল্পী

প্রকাশিত: ১১:৫৫, ৮ এপ্রিল ২০২৩

শব্দের অর্থ নয় উদ্দেশ্যটাই আসল

ফাইল ছবি

সম্ভবত ২০১৭ সালের জুলাই মাস। নিউইয়র্ক বইমেলায় আমি, কবি মাহবুব হাসান, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু, কবি ইকবাল হাসান আড্ডা দিচ্ছি। একজন সত্তর ছুঁই ছুঁই শুভ্র শশ্রুমন্ডিত পেটানো শরীরের  ছোটোখাটো মানুষ বহুদূর থেকে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বেশ দ্রুত এগিয়ে আসছেন। লোকটির পরনে শাদা পাঞ্জাবি, কাঁধে শান্তিনিকেতনী  ঝোলা।

ওর দৃষ্টিতে আন্তরিকতা এবং হঠাৎ খুঁজে পাওয়ার আনন্দ ছিল। আমিও চোখ ফেরাতে পারিনি। কাছে আসতেই লোকটির নুরানী মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে সালাম দিই। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ভয়ানক  ক্ষেপে যান। উত্তেজিত হয়ে আমাকে এবং সকল বাংলাদেশি মুসলমানকে উদ্দেশ্য করে গালমন্দ করতে শুরু করেন। কথা শুনে বুঝলাম তার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে এবং তিনি হিন্দু। তিনি বলেন, এই জন্যই আমি বাঙালি মুসলমানদের পছন্দ করি না।

আমি তাকে বিনয়ের সঙ্গে সালামের অর্থ বোঝালাম কিন্তু তিনি কিছুতেই শান্ত হলেন না। তাকে আগে থেকেই চনেন এমন দুএকজন এসে আমাকে বললেন, ওকে বোঝাবার কোনো দরকার নেই, লোকটি পাগল।

এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হয় হলিস লাইব্রেরিতে, ২০১৮ সালে। সেদিন তার নাম জানতে পারিশংকর তখন আমরা নুরজাহান বোসেরআগুনমুখার মেয়েবইটি নিয়ে বাংলা বুক ক্লাবপাঠকের পাতা আলোচনা করছিলাম। প্রবীন লেখিকা নুরজাহান বোস তার কন্যাকে নিয়ে সুদূর মেরিল্যান্ড থেকে এসেছেন। লাইব্রেরি ম্যানেজার আব্দুল্লাহ জাহিদ শংকরকে কিছু বলার জন্য ডাকেন। তিনি বাংলাদেশের লেখক সম্প্রদায়কে তাচ্ছিল্য করে বলেন, বাঙালি মুসলমানেরা লিখতে জানে এটা দেখে খুব অবাক হলাম। সেদিন অনেকেই তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। নুরজাহান বোস নিজেও তাকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দেন।

২০২২ সালের শেষের দিকে একদিন সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার সম্পাদক মিজানুর রহমান আমাকে টেলিফোন করে বলেন, জহির ভাই, আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য এক বয়স্ক ভদ্রলোক অনেক দূর থেকে ড্রাইভ করে এসেছেন। আপনি কি জ্যাকসন হাইটসের আশে-পাশে কোথাও আছেন? আমি বলি, না, আমি অনেক দূরে আছি। মিজানুর রহমান ফোনটা ভদ্রলোকের হাতে তুলে দেন। তিনি আমাকে বলেন, কাজী নজরুল ইসলামের ওপর আপনার একটি দীর্ঘ লেখা পড়লাম। আমি অবাক হয়েছি জেনে যে বাঙালি মুসলমানেরাও পড়াশোনা জানে, লিখতে জানে! আমি ওর কণ্ঠ এবং কথা বলার ধরণ শুনেই বুঝে ফেলেছি, তিনি আর কেউ নন, শংকর। তিনি জানতে চাইলেন, আমি তখন কোথায়? কতক্ষণ লাগবে বাসায় ফিরতে? আমার বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারেন কি-না? লোকটি নাছোড়বান্দা, দেখা করেই ছাড়বেন। অবশেষে তাকে তিনদিন পরের একটা এপোয়েন্টমেন্ট দিলে তিনি দেখা করতে আসেন।

শংকর তার জীবনের নানান গল্প আমাকে বলেন। জন্ম বাংলাদেশের বরিশালে। কিশোর বয়সে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে। অনেক চড়াই-উতরাই গেছে তার জীবনে। মজার এক চরিত্র। তার সঙ্গে আমার কিছুটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেইসব হয়ত অন্য আরেকদিন লেখা যাবে। আমার আজকের লেখার বিষয় শংকর নয়, বিষয় হচ্ছে শব্দের বা ভাষার ব্যবহার। কেন সালাম শুনে শংকর রেগে  গেলেন?

একথা ঠিক যে শব্দের শক্তি অনেক। একটি শব্দের জন্য আপনি/আমি  যেমন পুরস্কৃত হতে পারি আবার তিরস্কৃতও হতে পারি। কিন্তু শুধু শব্দই কি সব? না, শব্দ সব নয়। শব্দ প্রয়োগের অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্যটিই আসল। আমরা তো একজনকে গালি দিইবদমাশবলে। আবার শিশুকে আদরও করিবদমাশবলে। কী উদ্দেশে শব্দটি প্রয়োগ করছি  সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। ভিন্ন ভিন্ন ভাষায়, সংস্কৃতিতে এবং ধর্মে একই উদ্দেশে আমরা ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করি। আদাব, সালাম, নমস্কার, সুপ্রভাত, গুড এভিনিং, বঁজু ইত্যাদি শব্দ আমরা ব্যবহার করি কুশল বা  সৌহার্দ্য বিনিময়ের জন্য। কিছু শব্দ ভাষার ভিন্নতার কারণে তৈরি হয়েছে, আবার কিছু শব্দ ধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। মধ্যযুগে, এমন কী বিশ শতকের গোড়ার দিকেও, ভারতীয় বাঙালিরা, কী হিন্দু, কী মুসলমান সকলেই কুশল বিনিময়ের ভাষা হিসেবেআদাবব্যবহার করতেন। ধীরে ধীরে বাংলাদেশে বাঙালি মুসলমানদের একটি সংস্কৃতি পূর্ণতা পেতে থাকে এবং ইসলাম ধর্মের অনেক রীতিনীতি যুক্ত হয়। আদাবের স্থলে সালাম, দাদার স্থলে ভাই, দিদির জায়গায় বোন ইত্যাদি শব্দ বা সম্বোধন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এইসব শব্দের বা সম্বোধন প্রয়োগের উদ্দেশে তো কোনো তারতম্য ঘটেনি।

আল্লাহ, খোদা, ভগবান, ঈশ্বর, গড যে নামেই ডাকি না কেন উদ্দেশ্যে  তো কোনো পার্থক্য নেই। কেউ যদি জুম্মার নামাজে মুসুল্লিদের দেখিয়ে বলেন, ওরা প্রার্থনা করতে যাচ্ছে, তাতে কি নামাজের কোনো ক্ষতি হবে? একজন হিন্দু পুজোর মন্ত্র পড়ছেন আর একজন মুসলমান নামাজের সুরা পড়ছেন, কোনো শিশু এই দুইয়ের পার্থক্য না বুঝে যদি বলে দুজনই নামাজ পড়ছেন বা দুজনই পুজো করছেন এতে কি কারো প্রার্থনা নষ্ট হয়ে যাবে? একজন হিন্দুকে যদি জলের বদলে পানি দেওয়া হয় তার তৃষ্ণা কি মিটবে না? একজন মুসলমান যদি জল পান করে সে কি নাপাক হয়ে যাবে? হিন্দিভাষী ভারতের হিন্দুরা কি জলকে পানি বলছে না? তারা আরো অনেক আরবী/ফার্সি শব্দ দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যবহার করে থাকে। আবার ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানেরা তাদের প্রতিদিনের আচার-অনুষ্ঠানে রামায়ন-মহাভারতের শব্দ, সংস্কৃতি ব্যবহার করে। আমার এক ইন্দোনেশিয় সহকর্মীর নাম কালী কৃষ্ণমূর্তি, তিনি একজন খাঁটি মুসলমান, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। এতে কী তার ধর্ম নষ্ট হয়ে গেল? কিছুতেই নয়।

এক একটি শব্দ আমাদের চোখের সামনে এক একটি চিত্রকল্প তৈরি করে। যেমন আমি যখন পিতা বলি তখন একজনের অবয়ব দেখি, রাষ্ট্রপতি বললে একজনের অবয়ব দেখি, পুলিশ বললে অন্য একজনের অবয়ব দেখি। যদি জন্মের পর কেউ জন্মদাতাকে দেখিয়ে বলত ইনি হচ্ছেন পুলিশ, পুলিশকে দেখিয়ে বলত, ইনি হচ্ছেন পিতা। তাহলে কি শব্দগুলো উচ্চারিত হলে আমি ভিন্ন মানুষের ছবি দেখতাম না? শব্দ তো নির্দোষ। আমরা শব্দের উচ্চারণের মধ্য দিয়ে কি অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্য প্রকাশ করি সেটিই মূখ্য।

একদিন হলিস লাইব্রেরিতে বসে এই কথাগুলো আমি শংকরকে বলেছি। কারো উচ্চারিত শব্দ যদি আমাদের পছন্দ না হয় তক্ষুনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে আমাদের উচিত একটু ভাবা। কেন তিনি কথাটা বললেন, এর  পেছনে তার কি নেতিবাচক কোনো উদ্দেশ্য ছিল? যদি না থাকে, শুধু শব্দটি আমার পছন্দ হলো না বলে মানুষটির সঙ্গে নেতিবাচক আচরণ করা, এমন কী মনে মনে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে রাখা একদমই ঠিক হবে না।  লেখক: কবি বাংলা ভাষা গবেষক।

শেয়ার করুন: