বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

মানুষ কি পরস্পর যুক্ত?

কাজী জহিরুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৪:০১, ২৬ মার্চ ২০২৩

মানুষ কি  পরস্পর  যুক্ত?

ফাইল ছবি

পৃথিবীর সব মানুষ যুক্ত এই বিশ্বাস আমার ছেলেবেলা থেকেই। বলতে পারেন এটি আমার কৈশোরের হাইপোথিসিস। সারা জীবন ধরে এই হাইপোথিসিসের সত্যতা খুঁজছি। খুঁজতে খুঁজতে কী পেলাম তা এই রচনায় উল্লেখ করবো। চট্টগ্রামে জন্ম নেয়া, ১১ বছর বয়সে শ্রী অরবিন্দের আশ্রম ভারতের পন্ডিচেরিতে চলে যাওয়া এবং ৩৩ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো আধ্যাত্মিক গুরু শ্রী চিন্ময় সমস্ত জীবন এই বিশ্বাসকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে কাজ করেছেন।

নিউইয়র্কে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজস্ব আশ্রম। এখানে জড়ো হয়েছে অসংখ্য মার্কিন নাগরিক, শ্রী চিন্ময়ের বিশ্বাসের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে গ্রহণ করেছেন তার শিষ্যত্ব। শ্রী চিন্ময় সেন্টারের কার্যক্রম এখন ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর ৯১টি দেশের ৩৫০ টিরও অধিক শহরে, এই ধারণার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন নানান জাত, ধর্ম বর্ণের হাজার হাজার মানুষ। আজ এই আশ্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের নামওয়াননেস হার্ট সেন্টার এই সেন্টার নিশ্চয়ই নিয়মতান্ত্রিক সাধনার মধ্য দিয়ে ওয়াননেসের চর্চা করে। আমি সেইসব নিয়ম জানি না। নিয়মতান্ত্রিক মেডিটেশন করি না। তবে আমি বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করি। আমার চিন্তায় ওয়াননেসের সঙ্গে সম্পৃক্ত যা কিছু এসেছে তার কিছু কিছু উল্লেখ করছি।

আমি মনে করি শুধু জীবিত মানুষেরাই পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত তা- না, যারা মৃত এবং যাদের জন্ম হয়নি তারা সকলেই যুক্ত। আসলে সর্বকালের সকল মানব যুক্ত। একটিই প্রাণ শত কোটি, হাজার কোটি দেহে প্রবাহিত।

একটি উদাহরণ দিই। বিজ্ঞানীরা বলছেন আমাদের যোগাযোগের ৫৫ শতাংশ বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, ৩৮ শতাংশ কণ্ঠের অভিব্যক্তি এবং শতাংশ ভাষা দিয়ে ঘটে। এর কারণ হিসেবে আমরা পাই, মানুষ লক্ষ লক্ষ বছর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে যোগাযোগ করেছে, আরো কয়েক লক্ষ বছর কন্ঠের অভিব্যক্তি, অর্থাৎ নানান রকম শব্দ দিয়ে যোগাযোগ করেছে এবং মাত্র লক্ষ বছর যাবৎ ভাষা দিয়ে যোগাযোগ করতে শিখেছে। সেই অভিজ্ঞতা আজকের মানুষের ডিএনএর মধ্যে আছে। তাই আজকের আধুনিক মানুষের মধ্যেও সেই অনুপাত প্রতিফলিত হচ্ছে। তাহলে বিষয়টা দাঁড়ালো আমি একা স্বতন্ত্র কোনো স্বত্বা নই, আমার মধ্যে আছে ৩২ লক্ষ বছরের অভিজ্ঞতার ডিএনএ এবং আমি পরিচালিত হই সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে। সুতরাং জন্মের আদি থেকে আজ অব্দি যত মানুষ এসেছে পৃথিবীতে তারা সকলেই যুক্ত।

আমার মধ্যে বাস করে কমপক্ষে ১০০ ট্রিলিয়ন জীবন্ত কোষ। প্রত্যেকটি  কোষ এককভাবে জীবন্ত। আমার দেহ থেকে বের করে অন্য কোনো পাত্রে  রেখে প্রতিটি কোষকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে। তাহলে কী দাঁড়ালো? ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন প্রাণি মিলে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, বাঁচিয়ে রেখেছে। আমি  তো আমি না, ট্রিলিয়ন প্রাণের সমষ্টি। তাহলে বিলিয়ন মানুষ আরো বিলিয়ন বিলিয়ন প্রাণি মিলে তৈরি এই পৃথিবী [কিংবা ব্রহ্মা-] যে একটি একক সত্ত্বা তা ভাবা কি অযৌক্তিক হবে?

আমরা যদি আল্পস পর্বতশৃঙ্গকে আকাশ থেকে দেখি, দেখবো অনেকগুলো চূড়ো এবং সবগুলো চূড়োই নিচের দিকে একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু আমরা জানি প্রতিটি চূড়োর নিজস্ব নাম আছে, যেমন মন্ট ব্লাঁ মন্টে রোজাডোম, লিজকাম, উইজহর্ন ইত্যাদি। মানুষের চেতন এবং অবচেতনের কথা আমরা জানি। চেতন সত্ত্বার নানান নাম থাকে, জহিরুল, আমিনুল, কুমার, স্মিথ, লিসা কতো কী। কিন্তু অবচেতনের কোনো নাম নেই। কেননা পর্বতশৃঙ্গের শেকড়ের মতো সকল অবচেতন একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। অবচেতন এক সুবৃহৎ সত্ত্বা, হয়ত আমরা কেউ কেউ সেই অবস্থাটিকেই বলি পরমাত্মা।

আরো একটি উদাহরণ দিই। -কথা আমরা প্রায়শই বলতে শুনি, মানুষ দুনিয়াতেই তার কর্মফল ভোগ করে। পরকাল আছে কী নেই, মানুষ মৃত্যুর পরে বেহেশতে যাবে না নরকে যাবে সেই চিন্তা না করতে মনীষীরা বলেন। তারা বলেন, ইহকালেই তুমি তোমার কর্মফল ভোগ করবে। কীভাবে? যদি এভাবে ভাবি, এই পৃথিবী একটি সুবৃহৎ পাত্র। আমরা সবাই সেই পাত্রের চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি কিংবা প্রদক্ষিণ করছি। আমরা যা উৎপাদন করি তা এই পাত্রে ঢেলে দিই। আবার আমাদের যা প্রয়োজন তা এই পাত্র  থেকে তুলে খাই। পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ যদি বিষ উৎপাদন করে পাত্রটির অর্ধেক বিষে পূর্ণ হয়ে উঠবে। এখান থেকে নিয়ে আমি যা খাবো তার অর্ধেক তো বিষই হবে। আমি যদি ভালো কাজ করি, তার কিছুটা আমার কাছে ফিরে আসবেই, আমি যদি মন্দ কাজ করি তারও কিছুটা আমার কাছে ফিরে আসবে। কাজেই আমরা সবাই যুক্ত।

আমরা যে যুক্ত তার অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়। এবার আসি ওয়াননেসের চর্চা আমরা কেন করবো, এই বিষয়টাতে। আপনি যদি বিশ্বাস করেন আমরা সবাই যুক্ত তাহলে ওয়াননেসের চর্চার মধ্যেই আপনি আছেন। আপনি যদি বলেন, আমি একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ, এইসব আজগুবি কল্পনা আমি বিশ্বাস করি না। আমি আপনাকে দোষ দেব না। বিশ্বাস একটি অন্ধকার চাদর, সত্যকে সে ঢেকে রাখে মাত্র। একদিন বিজ্ঞান সেই চাদরের নিচ থেকে সত্যকে বের করে এনে আলোতে মেলে ধরে। যতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞান তা উন্মোচন না করছে ততদিন আপনি কেন ওয়াননেসের চর্চা করবেন তার পক্ষে একটি যুক্তি দিয়েই লেখাটি শেষ করবো।

আপনি যদি ওয়াননেসের চর্চা করেন তাহলে আপনি একথা মানবেন যে আপনি, আমি, আমাদের প্রতিবেশী আমরা সকলেই যুক্ত। আমরা পরস্পর পরস্পরের অঙ্গ। যদি তাই হয় তাহলে আমরা একে অন্যকে আঘাত করতে পারবো না। আমি কি আমার ডান হাত দিয়ে বাম হাতকে আঘাত করি? করি না। ১৯২৩ সালে, যখন জাতিসংঘ ছিল না, ছিল লিগ অব নেশনস, তখন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট কামাল আতাতুর্ক বলেছিলেন আমাদের এমন একটি বিশ্বসংস্থা প্রয়োজন যার কাজ হবে রাষ্ট্রগুলোকে বোঝানো যে আমরা পরস্পর মানব দেহের অঙ্গের মতো যুক্ত। এক দেশে যুদ্ধ, মহামারী হলে অন্য দেশকে এমনভাবে প্রতিক্রিয়া করতে হবে যেন তার দেহের একটি অঙ্গ আঘাত পেয়েছে। এটিই রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ওয়াননেসের চর্চা। এটিই আজকের জাতিসংঘের মূল কাজ। এই ওয়াননেসই কার্যকর বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

ঠিক একইভাবে ব্যক্তি পর্যায়ে আমরা যদি এই ওয়াননেসের চর্চা করি তাহলে আমরা সবাই অনেক বেশি মানবিক হয়ে উঠবো এবং পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং আপনি/আমি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হওয়ার কারণেআমরা পরস্পর যুক্ত নইএই বিষয়ে নিশ্চিত হলেও, আসুন বিশ্বমানবতার জন্য, শান্তির পথে দুকদম হেঁটে যাওয়ার লক্ষে যতটা পারি ওয়াননেসের চর্চা করি।

 লেখক: কবি বাংলাভাষা গবেষক।

শেয়ার করুন: