বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

অর্ধশিক্ষিতদের দখলে শিশুসাহিত্য

কাজী জহিরুল ইসলাম, কবি ও ভাষাশিল্পী

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ৫ মার্চ ২০২৩

অর্ধশিক্ষিতদের দখলে শিশুসাহিত্য

ফাইল ছবি

আমি মনে করি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে শিশুসাহিত্যে কাজ করা একটু বেশি কঠিন। কঠিন জন্য যে এই সাহিত্য পড়ে কোমলমতি শিশুদের মনন এবং নৈতিক বিকাশ ঘটে। ইংরেজিতে ননসেন্স রাইম বলে একটি ব্যাপার আছে, বাংলায় আমরা যেটিকে আবোল-তাবোল ছড়া বলি। এই আবোল-তাবোলেরও একটি যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা থাকা দরকার। আবোল-তাবোল ছড়া বা রূপকথার গল্প পড়ে শিশুদের মনের মধ্যে একটি কল্পনার জগৎ গড়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে সেই কল্পনার জগৎটি যেন অনৈতিকতায় পূর্ণ না হয়।

গল্পগুলোতে যেন নৈতিকতার বিজয় ঘটে। বাস্তব পৃথিবীতে প্রায়শই অনৈতিক শক্তির উত্থান বা বিজয় ঘটে, সেই নিরেট বাস্তবের সঙ্গে শিশুদের এমনভাবে পরিচয় ঘটাতে হবে যেন  সে বুঝতে পারে এই বিজয় অনৈতিক বিজয়, যা হয়েছে তা না হলেই সমাজের জন্য, পৃথিবীর জন্য ভালো। যদি আমরা ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর শিশুসাহিত্য রচনা করি তখন অধিক সচেতন থাকতে হবে যাতে ঐতিহাসিক ঘটনার সময়, নাম-ধাম কিছুতেই ভুল না হয়।

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে ফেইসবুকে দেখি আমার এক সুহৃদ লিখেছেন তার রচিত প্রচুর বইয়ে তাকে সাক্ষর করতে হবে। আমি খুব খুশি হয়েছি জেনে যে তিনি বেশ জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক হয়ে উঠেছেন। তখনই মনে হলো, আচ্ছা তিনি কী লেখেন একটু পড়ে দেখি।  বেশ খুঁজে তার একটি সদ্য প্রকাশিত কিশোর কবিতা পেলাম। শুদ্ধ ছন্দে লেখা সরল-সুন্দর কিশোর কবিতা। কবিতাটি তিনি লিখেছেন একুশের ওপর। শিরোনামেও সে কথাই লেখা আছে। কিন্তু ভেতরে তিনি লিখেছেন, ‘হারিয়ে গেলো শফিক রফিক তাজ আমি তখন একটা ধাক্কা খেলাম। আমাদের ভাষা আন্দোলনের যে ৭জন শহীদের কথা আমরা জানি তাদের মধ্যে  কেউ শফিক বা তাজ ছিলেন না। ৭জন ভাষা শহীদ হলেন: রফিক উদ্দিন আহমদ, আব্দুল জব্বার, আব্দুস সালাম, আবুল বরকত, সফিউর রহমান, আব্দুল আউয়াল এবং অহিউল্লা। এই কবিতাটি পড়ে একজন শিশু বা কিশোর জানবে ভাষা আন্দোলনে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের নাম শফিক, রফিক এবং তাজ। আমি মধ্য পঞ্চাশে উপনীত একজন মানুষ। আজকাল অনেক কিছুই মনে রাখতে পারি না। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার শেখা বা দেখা অনেক বিষয় এখনও স্মৃতিতে খুব উজ্জ্বল। এটিই হয়। মানুষ তার ছেলেবেলার স্মৃতি সারা জীবন বহন করে। খুব সহজেই সেই সব শিক্ষা স্মৃতি মানুষ ভোলে না। কাজেই শিশুদের আমরা কী শেখাচ্ছি সেই বিষয়ে খুব সচেতন হতে হবে।

এবার একুশের প্রাক্কালে এবং একুশের দিন আমি অনেকগুলো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করি। একটি অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেছিলাম, আমরা যেন আমাদের শিশুদের বাংলাদেশের ৪টি প্রধান জাতীয় দিবসের পটভূমি গল্পচ্ছলে প্রায়শই বলি। দিবসগুলো হচ্ছে: ভাষা দিবস বা শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং বাংলা নববর্ষ। যাতে তারা এই দিবসগুলোর তাৎপর্য সঠিকভাবে বুঝতে পারে। আমার মত আপনারা অনেকেই নিশ্চয়ই সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেছেন, এক সাংবাদিক বাংলাদেশি শিশুদের জিজ্ঞেস করছিলেন, একুশে ফেব্রুয়ারিতে কী হয়েছিল? প্রায় সকলেই ভুল উত্তর দিচ্ছিল। কেউ বলল, একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। কেউ আবার কোনো উত্তরই দিতে পারল না। মন্তব্যের ঘরে অনেকেই এই অবস্থার জন্য প্রাইভেট স্কুল এবং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলকে দায়ী করেছেন। আসলে কি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বা প্রাইভেট স্কুল একা দায়ী? এই যে অসচেতন, অর্ধশিক্ষিত লেখকেরা শিশুসাহিত্য করছেন তারাও কি দায়ী নন?

সাহিত্য উন্মুক্ত থাকুক, এর কোনো সেন্সর বা নিয়ন্ত্রণ না থাকুক এটিই আমি চাই। কিন্তু যে দেশে মানসম্পন্ন বইয়ের চেয়ে মানহীন বই অনেক অনেক গুন  বেশি প্রকাশ হয় সেই দেশে মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কিছুকালের জন্য প্রনয়ণ করা  যেতে পারে।

শিশুসাহিত্যিকদের প্রতি বিনীত অনুরোধ ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর যখন লিখবেন অনুগ্রহ করে ছন্দের জন্য বা অন্ততানুপ্রাসের জন্য নাম-ধাম, সন-তারিখ বিকৃত করবেন না।

লেখক: কবি, ভাষাশিল্পী।

শেয়ার করুন: