বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল যারা

সামছুদ্দীন আজাদ, সহ সভাপতি-যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত: ১০:২৯, ২০ জানুয়ারি ২০২৩

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল যারা

ফাইল ছবি

২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য নির্বাচনের নামে যে প্রহসন এবং নগ্ন সন্ত্রাস সৃষ্টি করে শেষ পর্যন্ত বেগম জিয়াকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দিয়েছিলেন। বিএনপি ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশে যে নির্মম হত্যা, ধর্ষণ, অত্যাচার করেছিল বিএনপি নেতাদের সেই তথ্যগুলি স্মরণে রাখা দরকার। 

এবার আসছি কেন বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কনসেপ্ট চালু করা হয়েছিল এবং কেন পরবর্তীতে এটি গলার কাঁটায় পরিণত হল সে বিষয়টিতে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধকে রাতের অন্ধকারে স্বপরিবারে খুন করে এই দেশেরই কিছু বিপথগামী সেনা সদস্য। আর তাদেরকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বিদেশে পালিয়ে যেতে সব ব্যাবস্থা করেন স্বৈরাচারি মিলিটারি ডিকটেটর যিনি ছিলেন পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর পেইড এজেন্ট। এসব খুনিদের আবার বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে চাকুরি দিয়ে পুরস্কৃত করে নিজের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করেন এবং বন্দুকের নল কাঁধে নিয়ে ক্ষমতা দখল করেন এই অবৈধ স্বৈরাচার। ক্ষমতা দখল করে আল বদর রাজাকার যুদ্ধাপরাধী, খুনি, স্বাধীনতা বিরোধীদের ও পুনর্বাসন করেন নিজের সৃষ্ট দলে ঢুকিয়ে অথবা ক্ষমতার অংশিদার বানিয়ে।

মোটামুটি স্বাধীন দেশের সংবিধানকে কেটে ছেঁটে নিজের মত করে সাজালেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সব চেতনা মুছে দিলেন। মুক্তির শ্লোগান জয় বাংলা কেটে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ করলেন, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ কেটে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বসালেন। সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্রও বাদ দিলেন। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশ বেতার নাম বাদ দিয়ে পুরানো পাকিস্তানের প্রতি প্রেম দেখাতে জধফরড় ইধহমষধফবংয করেন হুবহু জধফরড় চধশরংঃধহ এর আদলে।

তিনি মোটামুটি সব জায়গায় একটা সংঘর্ষের জায়গা তৈরি করে দেখলেন স্বাধীনতার স্বপক্ষ ও স্বাধীনতা বিরোধীদের মধ্যে এমন সব বিতর্ক সৃষ্টি করে। শেষ পর্যন্ত তার শেষ রক্ষা হয়নি তাকেও নিষ্ঠুর পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। তার বিদায়ের পর আরেক স্বৈরাচারের অভিষেক ঘটে। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখল করে নিজকে চীফ মার্শাল এডমিনিস্ট্রেটর ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসেন। দীর্ঘ সাড়ে নয় বছর পর এই স্বৈরাচারের বিদায় হয় শান্তিপূর্ণ রক্তপাতহীন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর গণআন্দোলনের মুখে এই স্বৈরাচার বিদায় নেন। এবার বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা আসে কিভাবে মিলিটারি হস্তক্ষেপ ছাড়া একটি গ্রহণযোগ্য পার্লামেন্টারি ইলেকশন করা যায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেন তত্ত্বাবধাযক সরকার পদ্ধতির কথা।

তারই প্রস্তাবের ভিত্তিতে সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতের ভিত্তি তৈরি হলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত (সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত) হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান তার সাথে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে উপদেষ্টা হিসেবে থাকবেন দেশের সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ আরও ৯ জন উপদেষ্টা। তারাই ৯০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করিয়ে যে দল সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায় তাকে সরকার গঠনের আহবান করবেন এবং ক্ষমতা বুঝিয়ে দিবেন। সেই ধারাবাহিকতায় সর্বসম্মতভাবে দেশের সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে বিচারপতি সাহাবু উদ্দিনকে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার বানিয়ে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম পার্লামেন্টারি ইলেকশন করা হয়। 

উল্লেখ্য যে ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যা করার পর বাংলাদেশ এই প্রথম গণতন্ত্রের পথে হাঁটার সুযোগ পেল। বঙ্গবন্ধু কন্যা সব সময় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মাঠে স্বরব ছিলেন ১৯৮১ সালের ১৭ই মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শপথ নেন, অঙ্গীকার করেন। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া, মানুষ যাতে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে পারে সেই অধিকার নিশ্চিত করেন।

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের ২৭ বিচারপতি সাহাব উদ্দিনের নেতৃত্বে পার্লামেন্টারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে আর আওয়ামী লীগ পরাজয় মেনে নিয়ে বিরোধী আসনে বসে সংসদে। যথারীতি সরকারের মেয়াদ শেষ হলে ৯০ দিন পূর্বে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে বিএনপি ক্ষমতা বুঝিয়ে দিল এবারের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের কাছে। এবার তিনিও একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ প্রভাবমুক্ত নির্বাচন উপহার দিলেন ১২ জুন ১৯৯৬ সালে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৭৪%, ৯৬% পারসেন্ট ভোট পেয়ে সংসদে ১৪৬টি আসনে জয়লাভ করে শরিকদের নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রথমবারের মত সরকার গঠন করে দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন দীর্ঘ ২১ বছর পর। তিনিও যথারীতি মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়ে তৃতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান জনাব বিচারপতি লতিফুর রহমানকে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেন।

যথারীতি ১লা অক্টোবর ২০০১ সালে নির্বাচন হলো-বিএনপি দ্বিতীয় বার আবার ক্ষমতায় আসলো কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পেয়ে বিচারপতি লতিফুর রহমান বিএনপি-জামাত জোটকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য যে নগ্ন খেলায় মেতে উঠে ছিলেন, গোটা বাংলাদেশকে একটা জঘন্য ভোট ডাকাতি, মানুষ হত্যা, ধর্ষণের মত নৃশংসতায় ঠেলে দিয়ে গেছেন। তার এমন অপকর্মের সুযোগে বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় এসে ২০০১ অক্টোবর থেকে অক্টোবর ২৬, ২০০৬ সাল পর্যন্ত থেকে আওয়ামী লীগের ২৪ হাজার নেতা-কর্মীর জীবন কেড়ে নিয়েছিল।

বাংলাদেশকে ব্যার্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল বিএনপি। দূর্নীতিতে বাংলাদেশ পঞ্চম বারের মত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। বাংলাদেশে জঙ্গী-তালেবানদের দূর্গ করে দেয়া হয়েছিল, চট্টগ্রাম বন্দরে “ঞযব গবপপধ” নামক অস্ত্র গোলা বারুদ ভর্তি জাহাজ নোঙ্গর করে অস্ত্র খালাসের সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল তালেবানী জঙ্গীদের। হাওয়া ভবনকে প্রশাসনিক অফিস বানিয়ে খালেদা পুত্র তারেক রহমান কমিশন বাণিজ্যের টাকা নিয়োগ ও বদলির টাকা ভাগাভাগি করে খেতেন। বিদেশী কোম্পানীকে বাংলাদেশে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য সব গোপন দেন দরবার হতো এই হাওয়া ভবনে। এত লুটপাট, ডাকাতি, মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, অন্যায় অবিচারকে বৈধ করার জন্য নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য আবারও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শুরু করেন নতুন ষড়যন্ত্র। ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হলে এবার ক্ষমতা তো বুঝিয়ে দিতে হবে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির হাতে যিনি হবেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

নিয়মতান্ত্রিকভাবে যিনি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচার বিচারপতি হবেন তাকে ক্ষমতা বুঝিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না। বেগম জিয়া বিএনপির এককালের আন্তর্জাতিক সম্পাদক বিচারপতি কে এম হাসানকে সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে প্রধান বিচারপতি বানানোর স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। কিন্তু বাধ সাধলো বিচারপতি কে এম হাসানের বয়স। তার বিচারপতি হতে হলে বয়স ৬৫ থেকে ৬৭ করতে হবে আর সেটা নিশ্চিত করার জন্য বেগম জিয়া বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করে গেছেন। পরবর্তীতে এদেশে মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের সেনা শাসিত সরকার ৩ মাসের বদলে ২ বছর থেকেছে ক্ষমতায়। পরবর্তী ঘটনাবলী সবার জানা। খালেদা জিয়ার ক্ষমতা লিপ্সা দুর্নীতি-লুটপাটকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন নিজ দলীয় একজনকে প্রধান বানাতে। তার অনিবার্য পরিণতি সামরিক শাসন। সুতরাং আজ কেন আবার বিএনপি সেই কলংকিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেই চায় তা নিশ্চয় দেশবাসীর অজানা থাকার কথা নয়। 
 

শেয়ার করুন: