বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

ফিলাডেলফিয়া সিটি কাউন্সিল নির্বাচন এবং একজন  নিনা আহমেদ

হাবিব রহমান

আপডেট: ১৯:৩৬, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২

ফিলাডেলফিয়া সিটি কাউন্সিল নির্বাচন এবং একজন  নিনা আহমেদ

নিনা আহমেদ

গত ৩ ডিসেম্বর নিউইয়র্কের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় পেছনের পাতার একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে। শিরোনাম ছিলো -“ফিলাডেলফিয়া সিটি কাউন্সিলে লড়ছেন ড. নিনা আহমদ।” খবরে আরো বলা হয়, পেনসিলভানিয়ার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রাজনীতিক নিনা আহমেদ ১ ডিসেম্বর জানিয়েছেন তিনি ফিলাডেলফিয়া সিটি কাউন্সিল এ্যাট লার্জ পদে প্রতিদ্বন্ধিতা করবেন। 
উল্লেখ্য ড. নিনা এর আগেও ২০১৮ সালে পেনসিলভানিয়া স্টেট লিউটেনান্ট জেনারেল পদে নির্বাচন করে জন ফেটারম্যানের কাছে হেরে যান। ২০২০ সালে তিনি অডিটর জেনারেল পদে নির্বাচন করে তার রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্ধির কাছে পরাজিত হন।

আমরা জানি ২০১৪ সালে ড. নিনা আহমেদ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এশিয়ান-আমেরিকান অ্যান্ড প্যাসিফিক আইসল্যান্ডারস (এএপিআই) বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন।
আমাদের মনে আছে ২০১৪ সালের গত ৬ মে ওয়াশিংটনে স্বরাষ্ট্র দপ্তরে ওবামা প্রশাসনের ‘এশিয়ান-আমেরিকান অ্যান্ড প্যাসিফিক আইসল্যান্ডারস (এএপিআই) বিষয়ক উপদেষ্টা কমিশন’-এর সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠান হয়। কমিশনের অন্যতম সদস্য হিসাবে শপথ নেন ড. নিনা আহমেদ। ওবামা প্রশাসনে যোগ দেওয়া তিনিই ছিলেন প্রথম বাংলাদেশি আমেরিকান। ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপস্থিতিতে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর থেকেই কীর্তিমান এই বাংলাদেশি নারীকে ঘিরে আগ্রহ আর কৌতূহল ছিল সর্বত্র। আমরা নিউইয়র্কের প্রবাসীরা তো বটেই, আমেরিকার ৫০টি স্টেটে বসবাসরত বাংলাদেশিসহ সারা বিশ্বে বসবাসরত বাঙালিরা তার সাফল্যে সেদিন আনন্দিত হয়েছিলেন। তার সাফল্যে সেদিন আমদের বুকটা গর্বে ভরে উঠেছিলো।
মূলধারার নির্বাচনে ড. নিনার বারবার অংশ গ্রহন নি:সন্দেহে একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করা যায়। দেশীয় রাজধানীর বলয় ভেঙে মূলধারার রাজনীতিতে তার মত সেলিব্রেটি বাংলাদেশির অংশ গ্রহণ আগামীতে নতুন প্রজন্মকেও রাজনীতির দিকে আকর্ষণ করবে নিঃসন্দেহে। তবে এত আশার মাঝেও ড. নিনার ফিলাডেফিয়া সিটি কাউন্সিল এ্যাট লার্জ পদে নির্বাচনের ঘোষণা স্বস্তির মাঝেও একটা কাঁটার যন্ত্রনা দেয়। হৃদয়কে রক্তাক্ত করে তুলে।
ব্যক্তি জীবনে নিনা আহমদ একজন সফল মানুষ। তিনি লরেন্স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে রসায়নে বিএস ডিগ্রি নেন। এরপর ১৯৯০ সালে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া থেকে জীবতাত্ত্বিক রসায়নে (বায়োলজিক্যাল কেমিস্ট্রি ) লাভ করেন পিএইচডি ডিগ্রি। পোস্ট ডক্টরাল করেন থমাস জেফারসন বিশ্ববিদ্যালয়ে। রসায়নে পিএইচডি করা নিনা আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রের একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ। ডিএনএ বিশ্লেষক হিসেবে তিনি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কাজ করেন। কোলাজেন ও জিনগত প্রভাব নিয়ে গবেষণা ও আবিষ্কারের জন্য তার খ্যাতি রয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি প্যাটেন্টও রয়েছে তার।
আমার মনে যে প্রশ্নটা জাগে তাহলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত ক্ষমতাধর এবং প্রভাবশালী দেশের একজন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করার পর অন্যান্য পদে বিশেষ করে একটা সিটির কাউন্সিল অ্যাট লার্জ হিসাবে নির্বাচন করা কি খুবই একটা গৌরবের? যদি তিনি পাসও করেন তার এই পদবীটা কি একজন প্রেসিডেন্টের প্রাক্তন উপদেষ্টার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ও সম্মানের?
নিউইয়র্কে ইতোপূর্বে অত্যন্ত বেদনার সাথে লক্ষ্য করেছি বদরুন নাহার খান মিতা নামের একজন অত্যন্ত প্রত্রিুতিশীল নেত্রী যিনি এর আগে একবার কংগ্রেসে লড়েছেন। পরবর্তীতে কিছু সময়ের ব্যবধানে তিনি প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন নিউইয়র্ক সিটির কাউন্সিলম্যান পদে। হেলাল শেখ নামে আরো একজন বাংলাদেশি আমেরিকান যিনি এর আগে সিটি কম্পট্রোলার পদের জন্য নির্বাচনে লড়েছেন। কিছুদিন পর তিনিও নির্বাচন করছেন কাউন্সিলম্যান পদে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। এবং এতে দোষের কিছু নেই। তবে একটি পদে হেরে গিয়ে পরের টার্মের জন্য অপেক্ষা না করে সামনে যে নির্বাচনটা নাগালে এলো সে পদেই প্রার্থীতা ঘোষণা করে ভাল ফল যে ঘরে তোলা যায় না এসব প্রার্থীরা আমাদের জন্য তার প্রমাণ রেখে গেছেন ।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় নির্বাচনে অংশ নিয়ে কেউ খবরের শিরোনাম হন, আবার কেউ হন অংশ না নিয়েও হন। যেমন ২০১৪ সালে কোন নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বাংলাদেশে খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন কৃষক মো: সাদেক। তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে যতগুলো নির্বাচন হয়েছিলো সবগুলিতেই তিনি নিয়েছিলেন। ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার থেকে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত এমন কোন নির্বাচন নেই যেখানে তার অংশ গ্রহন ছিলো না। যদিও কোনো নির্বাচনেই তিনি জয়লাভ করতে পারেননি। তাকে দেখলেই সবাই জিজ্ঞাস করতেন-সাদেক ভাই, এবারও কি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন?
রবার্ট ব্রুসের গল্পটা দিয়ে লেখাটা শেষ করছি। তার মাকড়সা নিয়ে গল্পটা আমরা কমবেশি অনেকেই শুনেছি। রবার্ট ব্রুস একাধিকবার স্কটিশদের ঐক্যবদ্ধ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু বার বার তিনি পরাজিত হতে থাকেন। এক পর্যায়ে সবকিছু হারিয়ে একটি গুহার ভেতর আশ্রয় নিলেন তিনি। দেখলেন একটি মাকড়সা ছ’বার জাল তৈরিতে ব্যর্থ হলেও ৭ বার চেষ্টা করার পর জাল বুনতে সক্ষম হলো। ক্ষুদ্র মাকড়সার জাল বোনা দেখে তিনি উপলব্ধি করেন, সফল হতে হলে অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই।
এই ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রুশ আবার সৈন্যদের জড়ো করতে শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি জয়ী হন।
আমরা আশা করবো ড. নিনা আহমেদ যেন সাদেক রোল মডেল পরিণত না হন। শুধু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন না করে যেন পাশের জন্য তিনি নির্বাচন করেন। নির্বাচনের আগে মাঠ জরিপ করেন। পাশাপাশি নির্বাচনে হারার বেদনায় রণে ভঙ্গ না দিয়ে বার বার পদ পরিবর্তন না করে তার জন্য উপযুক্ত পদ বেছে নিয়ে রবার্ট ব্রুসের মত অধ্যবসায়ী হন এবং বিজয় মুকুট ছিনিয়ে এনে ইতিহাসে নাম লেখান। ৮ ডিসেম্বর ২০২২ ইংরেজি। লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক এবং সিইও, বাংলা ট্যুর, নিউইয়র্ক। 
 

শেয়ার করুন: