শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ...

শাহাব উদ্দীন, রাজনীতিক

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ১৫ এপ্রিল ২০২৩

এনেছিলে সাথে  করে মৃত্যুহীন  প্রাণ...

ফাইল ছবি

লেলিন বলেছিলেন, কোন কোন মৃত্যু পাখির পালকের চেয়েও হালকা আবার কোন কোন মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী। দেশ   জাতির জন্য যারা আজীবন কাজ করে অনুকরণীয়, হঠাৎ করে তার চলে যাওয়ায় মানুষ শোকে মুহ্যমান হয়ে যায়। তার নির্লোভ নিরহংকার জীবনের ত্যাগ কর্মের জন্য কোন ভাষা শব্দ প্রয়োগ যথার্থ হতে পারে না। সবাই হৃদয়ের গভীর থেকে বলে লাশ আমরা রাখবো কোথায় এমন যোগ্য সমাধি কই?’

গত ১১ এপ্রিল দেশবরেণ্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় বীরমুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ  চৌধুরীর মৃত্যুর সংবাদে সমগ্র জাতি শোকাকিভূত। এই কীর্তিমানের জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর, চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার সভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারে। দশ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাই পরিবারের সবাই তাকে বড়ভাই বলেই ডাকত। ধারাই তিনি বজায় রেখেছিলেন তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। প্রতিষ্ঠানের সবাই বড়ভাই বলেই ডাকত তাকে। তিনি বড় হয়েছেন ঢাকায় এবং বকশীবাজার স্কুল, ঢাকা কলেজ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৬৪ সালে এমবিবিএস পাশ করেন।

১৯৬৭ সালে লন্ডন রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে জেনারেল ভাস্কুলার সার্জারিতে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। যখন তিনি ফাইনাল পরীক্ষার জন্য পুরো দমে প্রস্তুত সুন্দর এক সোনালী উজ্জ্বল দিন সামনে হাতছানি দিচ্ছে. তখনই স্বাধীনতা যুদ্ধ শাসক শোষকগোষ্ঠী পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক আসে। ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে লন্ডনের হাইড পার্কে অন্যান্য বাঙালিদের সাথে তার পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিড়ে আগুন ধরিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রবিহীন হিসেবে ঘোষণা দেন। তারপর ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকের প্রত্যায়নপত্র নিয়ে ভারতের ভিসা নেন। ভারতের ট্রাভেল পারমিট নিয়ে তারই সহপাঠী শিক্ষার্থী বন্ধু ডা. এম. মোমিনকে নিয়ে দিল্লিগামী সিরিয়ান এয়ার লাইনে রওয়ানা দেন।

দামাস্ক বিমান বন্দরে তাদেরকে গ্রেফতার করার জন্য এক পাকিস্তানি কর্নেল খাপ ধরে বসে ছিল জেনে উনারা প্লেন থেকে না নামায় পাঁচ ঘন্টা বিলম্বিত হয়। কারণ প্লেন ইন্টারন্যাশনাল জোন হওয়ায় কাউকেও গ্রেফতারের আইন নেই। ধরনের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভারত এসে  পৌঁছান। সেখান থেকে তিনি যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য ভারতের আগরতলার মেঘালয়ে প্রশিক্ষণ নেন। তারপর তিনি দুই নম্বর সেক্টরে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ভারতের জিবি হাসপাতালের প্রধান সার্জন ডা. রথিন দত্তের সহযোগিতায় আগরতলার হাবুল ব্যানার্জির আনারস বাগানে তার বন্ধু ডা: এম,এম,, মোমিনকে নিয়ে ৪৮০ বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার জন্য প্রথম বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।

সেখানে কমান্ডিং অফিসার ছিলেন ডা. সিতারা বেগম (বীর প্রতীক) এবং দুই জন সেচ্ছাসেবিকা ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল তার বোন সাইদা কামাল। যুদ্ধকালীন সেই দিনে তাদের চিকিৎসা সেবায় অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার প্রাণে বাঁচেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ডা. জাফরুল্লাহকে খুবই ¯œ করতেন। তিনি ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন দেশ গড়ার জন্য রকম দেশ প্রেমিক মেধাবী দরকার। তাই বঙ্গবন্ধু গণস্বাস্থ্যের জন্য জায়গা এবং হাসপাতালের নাম ঠিক করে গরীব মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করে ছিলেন। আজ এই হাসপাতাল এবং ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানি দেশের গরীব মানুষের  চিকিৎসা জগতের এক মহিরুহ। তিনি ১৯৮২ সনে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর তাহার সাথে আলাপ করে জাতীয় ওষুধ নীতি প্রবর্তনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারই মেধা দূরদর্শিতার কারণেই দেশে ওষুধ শিল্পের সাফল্য এসে আজ শতকরা নব্বই ভাগ দেশে উৎপাদন করে বিদেশে রফতানি হয়।

তিনি আপদামস্তক একজন দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক লোক ছিলেন। স্বাধীনতার পর দেশে  হত্যা-ক্যু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হলে  ১৯৭৯  সনে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট গঠন করে নৌকার প্রার্থী জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করে মাঠে নামেন। সেই সময় বৃহত্তর সিলেটে তরুণ ছাত্র নেতা হিসাবে উনার সান্যিধ্য বিভিন্ন জায়গায় চষে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছিল। অত্যন্ত কাছে থেকে তার সাধাসিধে জীবন খাওয়া দাওয়া দেখে অবাক হয়েছি। এক কাপড়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলাফেরা করতেন। তিনি নিজেই বলতেন এত চাকচিক্যময় জীবন করে কি লাভ অপব্যয় আর অপচয় ছাড়া কিছুই নয়। যিনি কখনও বাজার থেকে স্যুট কিনে পরেননি। লন্ডনের রয়্যাল ফ্যামিলির প্রিন্স চার্লসের টেইলর এসে মাপ নিয়ে স্যুট বানিয়ে দিতো নিজের প্লেন চালানোর লাইসেন্স ছিল সেই ব্যক্তির সব চাকচিক্য পরিহার করে রকম সাধারণ জীবন যাপন রুপ কথার গল্পকেও যেন হার মানায়। 

এই কিংবদন্তি পুরুষ দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য স্বীকৃতি স্বরুপ স্বাধীনতা পুরষ্কার, ‘১৯৮৫ সনে রাসন ম্যাগসাইসাস, সুইডেন থেকে বিকল্প নভেল হিসাবে পরিচিত রাইট লাইভলিহুড পুরষ্কার ১৯৯২ সনে এবং আমেরিকার বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক  হেলথ হিরো, ২০০২ সনে মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে সম্মান সূচক ডক্টরেট ডিগ্রিসহ জাতীয় আন্তর্জাতিকভাবে অসংখ্য সম্মাননার স্বীকৃতি তার ঝুড়িতে আছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সম্মান বাংলার আপামর জনগণের হৃদয় নিংড়ানো উচ্ছ্বাস ভালবাসা। যিনি আজীবন ¯্রােতের বিরুদ্ধে লড়েছেন। ৮১ বছর বয়েসেও হুইল চেয়ারে বসে মিছিলের সামনে থেকে মানুষের ভোট ভাতের অধিকারের সংগ্রামে শেষ নি:শ্বাসের আগ পর্যন্ত ছিলেন। যার দেশে বিদেশে কোথাও নিজের একটা ফ্ল্যাটও নেই।  পৈত্রিক সম্পত্তি বোনদের দান করে শেষ মৃতদেহটাও মরোনোত্তর দান করে গেছেন। সুতরাং দাফন কাফন অথবা সাড়ে তিনহাত জায়গার দরকার নেই।

হে কিংবদন্তি ক্ষনজন্মা দেশপ্রেমিক তোমার কোন তুলনা নেই। তুমি অতুলনীয় তুমিই আমাদের প্রেরণা। তুমি বেঁচে থাকো তোমার কর্মে আগামী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। শ্রদ্ধাঞ্জলি-লাল সালাম।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা।

শেয়ার করুন: