বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

পশ্চিমারা রাশিয়াকে পারমাণু অস্ত্র ব্যবহারে চরম উস্কানী দিচ্ছে

সুব্রত বিশ্বাস, সভাপতি-যুক্তরাষ্ট্র উদীচী

প্রকাশিত: ১২:৫১, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

পশ্চিমারা রাশিয়াকে পারমাণু অস্ত্র ব্যবহারে চরম উস্কানী দিচ্ছে

প্রতিকী ছবি

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পুর্তি হতে চলেছে। এর শেষ কোথায় এখনও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হচ্ছে না। বরং অনিশ্চয়তার অশণিসংকেত হাতছানি দিচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। যুদ্ধের গতি প্রকৃতিতে অনেকেই তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন। এখনও তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরু না হলেও তার পাশর্^ প্রতিক্রিয়ায় ইতিমধ্যে বিশ^ব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে।   মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। পরিত্রাণের পথ দেখা যাচ্ছে না। বরং সম্পদ আর আধিপত্যের ক্ষুধায় মেতে উঠছে মানুষ খেকোরা।

যে অভিযোগের প্রেক্ষিতে যুদ্ধের সুচনা, প্রাথমিক অবস্থায় দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের ভয়াবহতা অনুধাবন করে অনেকের প্রচেষ্টায় নিরসনের একটা সম্ভাবনার উদ্যোগ সচল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু যুদ্ধ যাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট, যুদ্ধে মৃত মানুষের রক্ত-মাংস দিয়ে যাদের আয়ের পাহাড় গড়ার অন্যতম উৎস, সেই পশ্চিমারা হতে দিল না। অস্ত্রের প্রবল শক্তি অর্থের প্রাচুর্যের প্রভাব খাটিয়ে নিজেরা নিরাপদ দূরত্বে থেকে সহযোগি বন্ধু দেশের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার প্রবল প্রয়াস চলছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের জুজুর ভয় দেখিয়ে এসব দেশকে অস্ত্রে সজ্জিত করার অভিপ্রায়ে  ইতিমধ্যে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে মুনাফা লুটে নেওয়া হয়েছে। তুলনামূলক পিছিয়ে পড়া অস্ত্র ইউক্রেনকে দিয়ে একইভাবে কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। রাশিয়া থেকে সুদূর দুরত্বের কানাডাকে ভয় দেখিয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার মূল্যের ৮৫টি যুদ্ধ বিমান বিক্রি করা হয়েছে। চীনের জুজু দেখিয়ে তাইওযান, জাপান দক্ষিণ কোরিয়াকে অস্ত্র সজ্জিত করতে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করা হয়েছে। রাশিয়ার তেল গ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সেই তেল গ্যাস অন্যের মাধ্যমে নিয়ে ইউরোপে বিক্রি করে মুনাফা লুটা হচ্ছে।

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল প্রায় এক বছর আগে। সেই যুদ্ধ থামানো নিয়ে কুটনৈতিক কোনো প্রচেষ্টার চেয়ে আরও শক্তি দিয়ে যুদ্ধের মামামাকে আরও প্রবল করা হচ্ছে। সেই যুদ্ধের ধকল শুধু ইউরোপ নয়, যুদ্ধের ধকল সইতে হচ্ছে সারা বিশে^ মানুষকে। এই যুদ্ধে সমস্যা কেবল এশিয়া বা আফ্রিকার মানুষদের হচ্ছে না, সমস্যা হচ্ছে ইউরোপের জনগণেরও। যখন সারা বিশ^ অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে, তখন ন্যাটো সামরিক জোট বা ইউরোপীয় নেতারা রাশিয়াকে কাবু করতে ইউক্রেনকে আরও কত মারণাস্ত্র বা আধুনিক ট্যাংক দেওয়া যায়, তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত।

পশ্চিমা সাহায্য নিয়ে ইউরোপ মহাদেশের উত্তর-পূর্বাংশজুড়ে বিশাল রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে ইউক্রেন কতটা জয়ী হতে পারবে তা নিয়ে ইউরোপে সংশয় বাড়ছে। পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার আমেরিকান যুদ্ধ নীতি নিয়ে ইউরোপে ক্রমেই সমালোচনা জোরদার হচ্ছে।

ইউরোপে অর্থনীতিতে সবল দেশ জার্মানী ¦ালানি খাতে কম আয়ের মানুষদের ভর্তুকি দিয়েছে। ছাড়া ¦ালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক সহযোগিতা করছে, যাতে করে ¦ালানি ব্যবহারকারী জনগণের কাছ থেকে অতিরিক্ত মূল্য গ্রহণ না করে। তবে জার্মানির মতো ¦ালানি বা পরিবহন খাতে ভর্তুকি ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে সম্ভব হয়নি। বিদ্যুৎ খাতে অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধের কারণে সেই সব দেশের জনগণ নকাল হচ্ছেন। যুদ্ধের কারণে শুধু হাঙ্গেরী ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে রাশিয়ার গ্যাস আমদানি বন্ধ রয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে শুধু ¦ালানির দাম নয়, বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। আগামীতে এই যুদ্ধ কত দিন চলবে আর মানুষের নাভিশ^াস কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। মানুষ ক্রমেই এই যুদ্ধের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হচ্ছে, সোচ্চার হচ্ছে।

জার্মানীর বিখ্যাত নারীবাদী নেত্রী এমা পত্রিকার সঙ্গে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে, গত নভেম্বর মাসে মার্কিন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলির সঙ্গে সিএনএনের একটি সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করেছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে জেনারেল মার্ক মিলি বলেছিলেন যে, ’ইউক্রেনের সামরিক বিজয় আশা করা য়ায় না এবং আলোচনাই একমাত্র সম্ভাব্য উপায়। ইউক্রেনে যুদ্ধের অবসান ঘটাতে শান্তি আলোচনার জন্য একটি দরজা খোলা থাকতে পারে, নইলে এই যুদ্ধ কেবল মানবজীবনের অর্থহীন অপচয়ই ঘটাবে।জেনাররেল মিলির  এই বক্তব্যের পর ওয়াশিংটনের সরকারি মহলে এবং জনসমক্ষে তিনি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন। সম্পর্কে জার্মানির  জেনারেল এরিখ ভাদ মনে করেন, জেনারেল মার্ক মিলি একটি অস্বস্তিকর সত্য কথা বলেছেন।

ইউক্রেনে আজ যারা আরও অস্ত্র সরবরাহের কথা বলছেন, তাদের বোঝা উচিত, তাতে করে সংঘাত কমবে না বরং আরও বাড়বে। এই অস্ত্র সরবরাহ ইউক্রেনের উদ্দেশ্যহীন সংগ্রামকে আরও রক্তাক্ত দীর্ঘস্থায়ী করবে। পশ্চিমা কৌশল ইউক্রেনকে ধ্বংস করছে এবং আরও প্রবলভাবে ধ্বংস করবে।

ইউক্রেন যুদ্ধের গতি প্রকৃতি এবং পশ্চিমাদের সমরাস্ত্র সরবরাহের পরিণতি  নিয়ে একাত্তরের সাংবাদিকের সাথে ভারতের ফ্লাইট লেফটেনেন্ট গ্রুপ ক্যাপ্টেন অজয় সি বাস্তবের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। সি বাস্তব বলেছেন, পশ্চিমা শক্তি যুক্তরাষ্ট্র এপর্যন্ত ইউক্রেনকে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের যুদ্ধাস্ত্র যুদ্ধ সহযোগিতা দিয়েছে। কিয়েভকে অত্যাধুনিক অস্ত্র দেওয়ার মাধ্যমে রাশিয়াকে বাধ্য করছে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে। যা ওয়াশিংটনের বন্ধু রাষ্ট্র ইউরোপের নিরপরাধ জনগণই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করলে বা প্রচলিত অস্ত্রে মস্কোর অস্তিত্বকে হুমকি দিলে সম্ভাব্য সবধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হবে, পুতিন সতর্ক করেছিলেন এবং বলেছিলেন এটা কোন ভাওতাবাজি নয়। ভারতের ফ্লাইট অফিসার গ্রুপ ক্যাপ্টেন অজয় প্রকাশ শ্রীবাস্তব জানান, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানী ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক ট্যাংক দেওয়ার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে হয়তো রাশিয়ার ঠিক করে দেওয়া চুড়ান্ত সীমা লঙ্ঘন অতিক্রম করতে চলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিশোধ হিসেবে রাশিয়া কি পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে? অজয় জানান, হিমার্স রকেট সিস্টেম থেকে ট্যাংক, অত্যাধূনিক সব অস্ত্র ইউক্রেনকে দেওয়ার মাধ্যমে রাশিয়াকে প্রায় কোণঠাসা করে রেখেছে পশ্চিমারা। প্রতিশোধ নেওয়া ছাড়া মস্কোর কোন সুযোগই রাখছে না তারা। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে প্রায় ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের অস্ত্র সহযোগিতা দিয়েছে বিশে^ স্বঘোষিত শান্তিকামী যুক্তরাষ্ট্র। যার মধ্যে অস্ত্র সরঞ্জাম নিরাপত্তা সহায়তা ২৩ বিলিয়ন, সরাসরি আর্থিক মানবিক সহায়তা ২৫ বিলিয়ন, যুুক্তরাষ্ট্র সহ অন্তত ৪০টি রাষ্ট্র ইউক্রেনে সরাসরি সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। যুুক্তরাষ্ট্র হালকা অস্ত্র থেকে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য মিসাইল , বিস্ফোরক, নজরদারি, মনুস্যবিহীন বিমান, কামান, সাজোয়াযান, সামরিক ট্যাংক, সেটেলাইটে কমিউনিকেশন টার্মিনাল সহ বিভিন্ন ধরনের রাডার যোগাযোগের অন্যান্য সরঞ্জাম যন্ত্রপাতি ইউক্রেনকে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের দাবি গণতন্ত্রের রক্ষা, গণতন্ত্রের বিস্তার, মানবাধিকার সমুন্নত রাখার পক্ষে কাজ করছে তারা।

কিন্তু অজয় জানান, বিশে^ একমাত্র পারমাণবিক অপরাধী যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার জন্য রাশিয়াকে বাধ্য করছে তারা। গত বৃহস্পতিবার জার্মান পরাজয়ের আঁশিতম বর্ষপুর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে পুতিন জানান, দশক পর আবারও জার্মান ট্যাংকের হুমকিতে রাশিয়া। পুতিনের মুখপাত্র জানান, পশ্চিমের নতুন নতুন অস্ত্রের জবাবে মস্কো নিজের সর্বশক্তি অস্ত্রের সর্বোচ্চ ব্যবহার করবে। অজয় বলেন, বিশ^ কুটনীতির নজিরবিহীন উদাহরণ যে, স্বঘোষিত পারমাণবিক অপরাধী যুক্তরাষ্ট্র চক্রান্ত করে তার হাজার হাজার মাইল দুরের বন্ধু দেশের নিরপরাধ মানুষকে হিরোশিমা নাগাসাকির মতো নির্মম ভাগ্য বরণে রাশিয়াকে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারে সর্বোচ্চ উস্কানী দিচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর গত শতাব্দী থেকে ইউরোপ যে শান্তির পথে হাটছিল, আর যুদ্ধ নয়, স্লোগান দিয়ে ইউরোপীয় ঐক্য গড়ে তুলেছিল, তা এখন হুমকির মুখে পড়েছে।

লেখক: সভাপতি-যুক্তরাষ্ট্র উদীচী।

শেয়ার করুন: