বাবা দিবসের গিফট
দেশ-বিদেশে যেখানেই যাই ভালো খাবার হোটেলের সন্ধান করি। সে দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার খুঁজি। যতটুকু পারি চেখে দেখি। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে খেয়াল করি। বিশেষ করে বাথ রুম।
বিদেশে অনেক সাধারণ মানের রেস্টুরেন্টে বাথ রুম দেখে অবাক বিস্ময়ে থ’ মেরে যাই। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে চকচকে। তাদের রুচির প্রশংসা করি। মনে আছে স্পেনের বার্সেলোনার একটি সাধারন মানের রেস্টুরেন্টের বাথরুমে নামী শিল্পির আঁকা ছবি দেখে থমকে গিয়েছিলাম। মালিককে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম এজন্য শিল্পীকে তার অনেক সম্মানী দিতে হয়েছিলো। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতেও একটা নান্দনিক বাথরুম আমার নজর কেড়েছিলো।
কথাটা টানলাম এজন্য যে, গত রোববার বাবা দিবসে নিউইয়র্কের একটি রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ করতে গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম বল্লে ভুল হবে, বলা যায় যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। মেয়ে আমার বলতে গেলে কিডন্যাপের মত তুলে নিয়েছিলো আমার প্রবল অনিচ্ছাকে উপেক্ষা করে। কারণ বাবা দিবস বলে আমার নিজের মনের মধ্যে আলাদা করে কোনো আবেগ কাজ করে না। হয়তো বা আমি প্রাচীনপন্থী বলে। আমার কাছে প্রতিটি দিনই বাবা দিবস। আমার বাবা গত হয়েছেন বহু দিন। তাকে আমি কোনো বিশেষ দিবসে নয় বলা যায় প্রতিদিনই স্মরণ করি। তিনি বিরাজ করেন আমার হৃদয়ের গহীনে। তিনি মিশে আছেন আমার রক্ত কনিকায়। এখনো ভালো কাজে আমার বাবার উৎসাহ পাই। কষ্ট পেলে বাবাকে মনে করি।
যাকগে এগুলো হলো আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি। নতুন প্রজন্ম আমার মেয়ের কাছে বাবা দিবস অনেক কিছু। সে বাবাকে ভালোবাসে। সে বাবা দিবসকে ভালোবাসে। প্রতিটি বাবা দিবসে সে আমাকে বিশেষ ট্রিট দেয়। রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। ভালো গিফ্ট কিনে দেয়। তার বিয়ে হয়ে গেলেও সে আমার কাছে সেই ছোট্টটিই আছে। তার রাগ অভিমান, ভালোবাসা এখনো আমাকে চারিদিকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখে। তাই বাবা দিবসে যখন আমাকে সে ছিনতাই করে এখানে নিয়ে এলো তাকে বাঁধা দিতে পারিনি।
সে আমাকে নিয়ে এলো লং আইল্যান্ড সিটির মাঝারি মানের একটা রেস্তোরাঁয়। নাম সামী’স কিচেন। একটা আফগান কুজিন। চমৎকার ভাবে সাজানো। এক পলকেই নজর কাড়ে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। এখানে আফগান খাবারের সাথে উজবেকিস্তানের খাবারও পাওয়া যায়।
মেয়ে তার পছন্দেই খাবার অর্ডার করলো। কারণ আজ সেই হোস্ট। আমাকে সাথে মানিব্যাগটাও আনতে দেয়নি। সে যাক। মেয়ে জানে আমি ভোজন রসিক মানুষ। কম খাই। তবে পদ যত বেশী হোক তা চেখে দেখি।
আফগান-উজবেক মিলিয়ে মেয়ে অনেক খাবার অর্ডার করলো। মনের ক্ষুধা, চোখের ক্ষুধা মিলিয়ে খেলামও উদর পুর্তি করে। বাবা দিবস বলে কথা!
খাবারের সময় মালিকপক্ষের কেউ একজন এসে জানতে চাইলেন-সব ঠিক আছে কি না! খাবার যাই হোক মনটা ভালো হয়ে গেলো। কত জায়গায়ই ইতো খাই। ক’জন মালিক পক্ষ টেবিলে টেবিলে ঘুরে কাস্টমারদের খোঁজ নেয়! প্রশংসা করছিলাম মনে মনে। মেয়েকে ধন্যবাদ জানালাম এমন একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে বলে।
খাবার শেষে এলো উজবেক চা। তৃপ্তি সহকারে পান করলাম। বেরোনোর আগে বাথরুমে গিয়ে চমকে গেলাম। এক কোনায় স্টান্ড ফ্যান, বেসিনে তাজা গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। দেয়ালেও ফুল।
রেস্টুরেন্টে দুটো বাথরুম। উৎসুক্য নিয়ে অন্যটাতেও উঁকি দিলাম। দুটোই একইভাবে সাজানো। দুটোতেই তাজা গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো।
একজন কর্মচারীকে ডেকে জানতে চেয়েছিলাম, এটা কি আজকের বাবা দিবসের জন্য বিশেষভাবে সাজানো? বল্লো -না, প্রতিদিন তাজা গোলাপ দিয়েই এমনিভাবে বাথরুম সাজানো হয়।
একটু অবাক হলাম। মনে মনে মালিকের রুচির প্রশংসা করছিলাম। ভাবছিলাম এই যে ফুলে ফুলে সাজানো বাথরুম এতে কি মালিকের খুব কি বেশি অর্থ ব্যয় হয়? সম্ভবত না। অর্থের চেয়ে রুচিটাই এখানে বেশি কাজ করে।
আসার সময় দেখলাম দেয়ালে সাঁটানো নিউইয়র্ক টাইমসের একটা রিপোর্ট। মালিক একসময় ফেরি করে কফি বেচতেন প্রতিকাপ ৬৫ সেন্টস করে। একসময় ট্যাক্সিও চালাতেন। আর এখন এই প্রতিষ্ঠানটির গর্বিত মালিক।
ভালো মানের খাবারের হোটেল নিউইয়র্কেতো অনেকই আছে। তবে শুধু পেট নয় মনটাও ভরিয়ে দেয় এমন হোটেল কি খুব বেশি আছে! টাকা আছে অনেক হোটেল মালিকের। কিন্তু রুচি! তা আছে ক’জনের। সেটারইতো বড় দুর্ভিক্ষ চলছে সর্বত্র। আর যে হোটেলে খাবার আর রুচির সমন্বয় ঘটবে সে হোটেল যে গ্রাহক টানবে তা হলফ করেই বলা যায়।
সারা বছর দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াই। কিন্তু গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো এমন একটি বাথরুমওয়ালা হোটেল দেশে বা বিদেশের কোথাও আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। রুচির দুর্ভিক্ষ দেখে দেখে ক্লান্ত এ চোখে এটা আজ এক বড় পাওয়া! হয়তো এবছর ফাদার্স ডে তে এটাই আমার সবচেয়ে বড় গিফ্ট!