সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

খাইরুল ইসলাম পাখি’র কিচিরিমিচির-চৌদ্দ

বাচ্চাদের সাথে কথা বলুন, সময় দিন

খাইরুল ইসলাম পাখি

প্রকাশিত: ০৪:০০, ১৩ এপ্রিল ২০২৪

বাচ্চাদের সাথে কথা বলুন, সময় দিন

খাইরুল ইসলাম পাখি

আমাদের শিশুরা যারা এদেশে (ইউএসএ) জন্ম নিয়েছে বা যে শিশুরা ছোটবেলায় এখানে এসেছে তারা ধীরে ধীরে এখানকার মূল্যবোধ, আচার-আচরণ শিখতে শিখতে বড় হতে হচ্ছে। কারণ তারা যখন স্কুলে যেতে থাকে, তখন থেকেই তারা নি¤েœাক্ত বিষয়গুলো রপ্ত করা শুরু করে- অন্যকে সাহায্য করা, বড়দের শ্রদ্ধা করা, আরেকজনের কথার উপর কথা না বলা, লাইনে দাঁড়ানো, সরি বলা, অন্যের আনন্দে আনন্দিত হওয়া, আরেকজনের ভাল কাজে বাহবা দেয়া, আস্তে কথা বলা, নিজের কাজ নিজে করা, যেখানে সেখানে ময়লা, থুতু এসব না ফেলা, অন্যের কাজে সাহায্য করা, অন্য ধর্ম, বর্ণ, মত, জাতি বা জাতকে সম্মান করা, সবাইকে সম চোখে দেখা, মিথ্যা না বলা ইত্যাদি। আরো বহু বিষয় তাদের শেখানো শুরু হয় স্কুলের প্রথম দিন থেকেই। প্রতিদিন এসব বিষয়ে এমনভাবে শেখানো বা প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, যাতে একটা সময় বাচ্চাদের মনোজগতে এসব ভালো গুণ প্রোথিত হয়ে যায়। সময়ে এসব তাদের অভ্যাসে চলে আসে। তাই এই বাচ্চাগুলো যখন একটু বড় হয় তখন থেকেই তাদের আচার-আচরণে, কথায় ওই মূল্যবান মানবিক শিক্ষাগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। আর তখন থেকেই অভিভাবকদের অনেক বিষয় তাদের অপছন্দ হতে থাকে এবং কখনো সখনো বাচ্চারা তাদের প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করে ফেলে। কারণ আমরা অভ্যাস বশে এমন কিছু করি যা বাচ্চারা একেবারেই পছন্দ করে না।

ধরুন আপনি ড্রাইভ করছেন এবং অপ্রয়োজনে হর্ন দিচ্ছেন, এটা  তারা পছন্দ করেনা। আমরা কথায় কথায় অন্যের সমালোচনা করি, দ্রুত জাজমেন্টাল হই, যা ওরা পছন্দ করে না। আমরা অনেক জায়গায় ফোনে বা এমনিতে জোরে কথা বলতে থাকি, এসবও ওদের অপছন্দ। সরি বা থ্যাঙ্ক ইউ বলায় আমাদের যে অলসতা, এটা ওরা ভালোভাবে দেখেনা। অন্য জাতি ধর্মকে আমরা কটাক্ষ করে কিছু বললেও ওরা দেখবেন আপত্তি করে। মানসিক ও শারীরিকভাবে পিছিয়ে আছে যারা তাদের নিয়ে নেতিবাচক কিছু বললেও এখানকার বাচ্চারা প্রতিবাদ করে। কে মোটা কে চিকন এমন আলোচনাও এদের অপছন্দ। ঈর্ষাপরায়ণতা, জাহির করা এসব এদের চর্চার মাঝে নেই বললেই চলে, যা আমাদের মাঝে বিদ্যমান। এরকম বহু বিষয় আছে যা কিনা আমাদের সাথে আমাদের বাচ্চাদের মেলেনা। এরা অনেক আত্মসচেতন এবং স্বাধীনচেতা হয়।
এখানকার স্কুলে শাসন বা বারণও বেশ অন্যরকম। আমি স্কুলে কাজ করি বলে এ বিষয়গুলো জানি। বাচ্চাদের সাথে বন্ধুর মত মিশে, অত্যন্ত নরম আচরণে তাদের সব বোঝাতে হয়। এ বিষয়ে এখানে শিক্ষা বোর্ডের অধীনে স্কুলের স্টাফদের এবং টিচারদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিতে হয়। স্কুলে বাচ্চাদের কথা, মতামত আমরা গুরুত্বের সাথে শুনি এবং সম্মান করি। তাদের কোন ভুল ভাবনা বা ধারণা থাকলে তা শোধরানোর জন্য কথা বলি, সাহায্য করি। এভাবেই তাদের মানসিক গঠন তৈরি হয় এবং এরা বড় হয়।

তাই ধুম করে আমরা আমাদের অভ্যাসবশত কোন কিছু যদি আমাদের বাচ্চাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি, তবে বড় ভুল হবে। ওরা ছোট হলেও ওদের কথা শুনতে হবে, বুঝতে হবে, গুরুত্ব দিতে হবে। ওদেরকে সম্মান করতে হবে। তারপর যুক্তি দিয়ে ওদের বোঝাতে হবে ভালো বা মন্দ কোনটা। ওদের সময় দেয়াটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এ বিষয়ে আমরা কিন্তু বেশ উদাসীন। আমাদের এই ব্যস্ত জীবনেও, এই দিকটা আমাদের সবসময়ই মনে রাখা উচিত। পরিবার কিন্তু বড় শিক্ষালয়। পরিবার থেকে বাচ্চারা যেমন সঠিক শিক্ষা পায় তেমনি পারিবারিক পরিবেশ যদি ঠিক না থাকে তখনও শিশুরা কিন্তু সুশিক্ষা পায় না।

একটা গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা বলে শেষ করব, সেটা হলো বাচ্চারা কিন্তু ঘরের পরিবেশ বা পরিবারে কি ঘটে, স্কুলে সেসব অনেক সময় বলে ফেলে। কিংবা বাচ্চাদের ব্যবহারেই আমরা বুঝে নিই ঘরের পরিবেশ বা পরিস্থিতি। ওরা মন খারাপ করে শিক্ষকদের সাথে অনেক কথা শেয়ার করে, যাতে অনেক সময় মনে হয় ওরা হয়তো ভুল ব্যবস্থাপনা ও শাসনের শিকার।

অনেক কিছু অভিভাবকরা বাচ্চাদের উপর চাপানোর চেষ্টা করেন, যা অনেকাংশেই অনুচিত। বাচ্চা বলেই আমরা তাদের উপর অনেক কিছু চাপিয়ে দিব, তা কি সব ক্ষেত্রে সঠিক? বাচ্চারা যেন বিভ্রান্ত না হয় বা মানসিক পীড়নের সম্মুখীন না হয়, তা খেয়াল রাখতে হবে। এমন করলে আমাদের সাথে বাচ্চাদের মানসিক দূরত্ব তৈরি হতে পারে। মনে রাখতে হবে আমাদের মূল্যবোধের সাথে তাদের মূল্যবোধের অনেক ফারাক। আমরা যেভাবে বড় হয়েছি তারা সেভাবে হচ্ছে না। আপনি আমি নিজের পার্টনারকেও ‘আই লাভ ইউ’ বলতে লজ্জা বোধ করি। ওদের কাছে এসব দুধভাত।

এ কথাটা অভিভাবক হিসেবে আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে এরা কিন্তু এখানে বড় হচ্ছে। সবসময় নিজেদের প্রতিচ্ছবি সন্তানের মাঝে খোঁজাটা বাতুলতা। গেড়ো শক্ত করতে গিয়ে রশি যেন ছিড়ে না যায়, তা আমাদের মনে রাখতে হবে। কারণ সবসময় কিন্তু ফলাফল এক রকম হয় না, হিতে অনেক সময় বিপরীতও হয়। “আমাদের সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”
পরিশেষে এটাই ঐকান্তিক কামনা।

লেখক: অভিনেতা।

শেয়ার করুন: