শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

খাইরুল ইসলাম পাখি’র কিচিরমিচির-বারো

বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি অযত্ন অবহেলা বন্ধ হোক

খাইরুল ইসলাম পাখি

আপডেট: ০০:৩০, ৩১ মার্চ ২০২৪

বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি অযত্ন অবহেলা বন্ধ হোক

খাইরুল ইসলাম পাখি

গত সোমবারের ঘটনা। ব্রঙ্কসের স্টারলিং এভিনিউ। সময় আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। একজন বয়োজ্যষ্ঠ মহিলাকে ঘিরে আছে উৎসুক কিছু মানুষ। আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম, বোঝার চেষ্টা করলাম কি হয়েছে। বৃদ্ধা মহিলার চোখে জল, আর্দ্র কন্ঠে বলছেন- আমি ঠিক আছি, আমার কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি, আমার কিছু লাগবে না। একজন ওনাকে বললেন বাসার ঠিকানা বলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

তিনি রাজি হলেন না। আরেকজন বললেন, বাসার কারো ফোন নাম্বার জানা থাকলে বলুন, আমরা ফোন করে কাউকে আসতে বলছি। তাতেও বৃদ্ধা সায় দিলেন না। কিন্তু তাঁর কান্না, গোংগানী থামছে না। বৃদ্ধা বলেছেন, তিনি কয়েক মাস পরে বাইরে এসেছেন কাউকে কিছু না বলে। এখন আর ফিরতে চাইছেন না ভয়ে। কারণ তিনি বুঝেছেন এটা তার করা অন্যায় হয়েছে এবং তার উপলব্ধি হলো সে বাসায় ফিরলে তাকে বকাঝকাসহ অনেক অনাকাঙ্খিত কিছু সইতে হবে। বৃদ্ধা এই যে এভাবে বেরিয়েছেন তার কারণ, বৃদ্ধার ভাষ্যমতে তাকে এক ধরনের আটকে রাখা হয় এবং তার বের হওয়ার অনুমতি নেই। তার সাথে এমন আচরণ পরিবারের কে বা কে কে করে তা তিনি বলতে চাননি। তিনি বলছেন, তিনি একাই ঘরে ফিরতে পারবেন। তিনি চেনেন তাদের বিল্ডিং বা কন্ডো। যা ধারে কাছেই। তিনি ঘরেই থাকেন সবসময়। তিনি  বললেন, তিনটি শিশুর দেখভাল করেন। এদের মধ্যে বড় শিশুটি নাকি তাঁকে মাঝে মধ্যে আঘাত করে, বকে! তিনি আরো বলেন, ঘরের সব কাজকর্মও তিনি করেন। ডাক্তারের কাছে যাওয়া ছাড়া তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় না কখনো। কোন দাওয়াতেও না। দেশে যাওয়ার জন্য পরান কাঁদে কিন্তু  দেশে যাওয়ার কথা বলা বারন। স্বামী নেই তাঁর। এ দেশে আসতেও চাননি স্বামীর কবর ছেড়ে। কিন্তু আপনজনদের কথা ফেলতেও পারেননি। তাকে বলা হয়েছিল প্রতিবছর নিজ ভিটায় যেতে পারবেন কিন্তু তা আর ঘটছে না। নিজের ঘর দেখতে ইচ্ছে করে। গ্রামময় ঘুরে বেড়াবে, মিশে যাবে ভিড়ে-কোলাহলে। কিন্তু আদৌ তা পারবে কিনা সে জানে না। এটা তার পৃথিবী নয়। সে এই বন্দীত্ব থেকে মুক্তি চায়।

ঘরে মানুষজন আসলেও তার সামনে আসা মানা, কথা বলা তো দূরের কথা। সে সব রান্না-বান্না করলেও তার পছন্দের খাবার রান্নার স্বাধীনতা তার নেই। সে বোঝে, তার জন্য পাওয়া সব রকম আর্থিক সুবিধার ছিঁটে ফোঁটাও তার কপালে জোটে না। তাঁকে ব্যবহার করা হচ্ছে মাত্র। তাঁর এই বেঁচে থাকা মৃতের শামিল। এসব মর্মকথা তিনি  অনেকটা বিলাপের মতোই এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলছেন। এখন আর কিছু বলছেন না শুধু কাঁদছেন। হঠাৎ একজন মাঝ বয়সী ভদ্রমহিলা খালাম্মা বলে এগিয়ে আসেন এবং বৃদ্ধাকে ধরে বলেন, কি হয়েছে আপনার? চলুন আমার সাথে আমি আপনাকে পৌঁছে দেব। ভদ্রমহিলার আহবানে সাড়া দিলেন বৃদ্ধা। সাহায্যকারী মহিলাটি সবার উদ্দেশ্যে বললেন, তিনি আমাদের পাশেই থাকেন। আমি নিয়ে যাচ্ছি তাঁকে। আপনাদের ধন্যবাদ।

উপস্থিত সবাই এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে যে যার কাজে পথ নিল। সবার চোখে মুখে একটা সহমর্মিতা আর বেদনার ছাঁপ। সবাই যেন সমব্যথী ওই বৃদ্ধার কষ্টে। এই বৃদ্ধার কথাগুলো যদি সত্যি হয়, তাহলে ভাবুন তো কতটা নিরুপায় তিনি? কতটা অবজ্ঞা আর অবহেলায় সে দিনাতিপাত করছে? কিভাবে নির্যাতিত আর অবরুদ্ধ জীবন পার করছেন তিনি! তাও কিনা তারই পরিবার আর স্বজনদের দ্বারা! না জানি এমনি করে কত শত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মানবেতর আর অনাকাঙ্খিত জীবন যাপন করছেন আমাদের চারপাশে আর আমাদের ঘরে ঘরে। উনাদের চাহিদা কি খুব গগনচুম্বী? যা মেটানোর মত নয়? কি চায় আমাদের বাবা মায়েরা? একটু আদর-যতœ, একটু ভালো-মন্দ খাওয়া, একটু আরামে থাকা বা সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা।  কিংবা মাঝে মাঝে মুক্ত বাতাসে হাঁটা, আকাশ দেখা। তাঁদের কি এসব পাওয়ার অধিকার নেই? এই জীবন সায়াহ্নে এসে তাঁদেরতো স্বজন বা সন্তানদের দ্বারা এতটা দুর্ভোগ পোহানোর কথা না! আমরা জানি প্রবাসের সব ঘরের চিত্র একরকম নয় কিন্তু কোথাও কোথাও এমন ঘটছে বলেইতো এক মা পথে নেমে আসে শিকল ছিঁড়ে! জনারন্যে।

কি হৃদয় বিদারক! ভাবুন? এহেন অযত্ন ও নির্যাতন বন্ধ হোক। আমরা সবাই যেন গুরুজনদের যতœ করি সম্মান করি। তাঁদের প্রাপ্য, তাঁদের মানবিক অধিকার থেকে যেন তাঁদের বঞ্চিত না করি।

সেদিন বেশি দূরে নয় যখন আপনার আমার বয়সও এঁদের মত হবে। তখন আমাদের সন্তানেরাও ঠিক ঠিক এমনটি করবে আমাদের সাথে। কারণ বাচ্চারা এখন আমাদের এসব দেখছে এবং শিখছে। “হোয়াট গোউস অ্যারাউন্ড কামস্ অ্যারাউন্ড”। এই সত্যটি ভুললে চলবে না।
তাই আসুন নিজেদের মানসিকতা বদলাই। যতœ নেই তাঁদের, যাঁদের সুবাদে আমরা আজ এই পৃথিবী দেখছি। যাঁদের আদর যতœ বা সাহায্য ছাড়া আপনার আমার আজকের এই পৃথিবী তৈরি হতো না।

মানবতার জয় হোক, মানবিক হোক বসুন্ধরা।

লেখক: অভিনেতা।

শেয়ার করুন: