শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

পাবলিক হেলথ এর দৃষ্টিতে মোরাকাবা-মোশাহেদা ও বর্তমান বিশ্ব

খাজা মাছুম বিল্লাহ কাওসারী

প্রকাশিত: ২৩:৩৯, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

পাবলিক হেলথ এর দৃষ্টিতে মোরাকাবা-মোশাহেদা ও বর্তমান বিশ্ব

খাজা মাছুম বিল্লাহ কাওসারী

নিশ্চয় আসমানসমূহ যমীনের সৃষ্টি এবং রাত দিনের বিবর্তনের মধ্যে রয়েছে বিবেক সম্পন্নদের জন্য বহু নির্দশনা। যারা দাঁড়িয়ে, বসে শুয়ে আল্লাহ্র স্মরণ করে এবং আসমানসমূহ যমীনের সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে, আর বলে, ‘হে আমাদের রব! আপনি এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করেননি, আপনি অত্যন্ত পবিত্র অতএব আপনি আমাদেরকে আগুনের শাস্তি হতে রক্ষা করুন’।

মোরাকাবা অর্থ ধ্যান, গভীর চিন্তা, আত্মনিমগ্নতা,পর্যবেক্ষণ করা, অনুসন্ধান করা, নিয়ন্ত্রণ করা, নজরে রাখা, মনোযোগ দেওয়া, পাহারা দেওয়া ইত্যাদি। আরো সহজে বলা যায়, সুফি বা সুফী তরিকা পন্থীদের মধ্যে প্রচলিত বিশেষ এক তন্ময়তা বা সম্মোহিত অবস্থা।

আদি পিতা হযরত আদমকে (.) মহান আল্লাহ তিনটি ইবাদাত শিখিয়েছিলেন- জিকির, মোরাক্বাবা এবং মোশাহেদা। এই তিনটি এবাদাতই ছিল তার নামাজ। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) একাধারে সুদীর্ঘ ১৫ বছর হেরা গুহায় ধ্যান বা মোরাকাবা করেছেন আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য। নবী করিম (সা.) হেরাগুহায় ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে আত্মাকে আলোকিত করেছেন খোদা পাকের নূরের মাধ্যমে এবং আত্ম উপলব্ধির সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হয়ে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেছেন।মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এরশাদ করেন- ‘আমার প্রভুকে আমি অতি উত্তম সুরতে দেখেছি (তাফসীরে রুহুল বয়ান)

Indeed, in the creation of the heavens and the earth and the alternation of the night and the day are signs for those of understanding.

হাদিসে কুদসিতে আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘যখন আমার বান্দা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করে, তখন আমি তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করি, এমতাবস্থায় আমি তার কর্ণ হই, যার দ্বারা সে শ্রবণ করে; আমি তার চক্ষু হই, যার দ্বারা সে দর্শন করে; আমি তার হাত হই, যার দ্বারা সে ধারণ করে; আমি তার পদযুগল হই, যার দ্বারা সে হেঁটে বেড়ায়। এমন অবস্থায় সে আমার কাছে যা কিছু চায় আমি সঙ্গে সঙ্গে তা দান করি (সহী বুখারি: ৬০৫৮)

এর ব্যাখ্যা এভাবে দাঁড়ায়, মোরাকাবা সাধকের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মোরাকাবার মাধ্যমে যদি কারো অন্তরের কালিমা বিদূরিত হয়, তিনি নামাজে আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথন করেন। তাই প্রতি ওয়াক্ত নামাজ ইবাদত শেষে অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও নিয়মিত মোরাকাবা করা উচিত। এতে সাধক ধীরে ধীরে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছে যেতে সক্ষম হবেন।

হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বর্ণনা করেন- আল্লাহ বলেছেন, ‘বান্দা যখন আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয়, আমি তখন তার দিকে একহাত পরিমাণ অগ্রসর হই। আর সে যখন আমার দিকে একহাত পরিমাণ অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে দুই হাত পরিমাণ অগ্রসর হই। আর বান্দা যদি আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দৌড়ে যাই (বুখারি: ৭০২৮)

মানব জীবনে প্রশান্তি ছাড়া অর্-বিত্ত, খ্যাতি, সাফল্য সবকিছুই অর্থহীন। সেই প্রশান্তির সন্ধান মিলেছে মোরাকাবা বা মেডিটেশনে। মেডিটেশন আত্মার প্রশান্তি সুখানুভূতি বাড়ানোর পাশাপাশি আত্ম উন্নয়ন জাগরণ ঘটায়।জরা-জীর্ণতা,কুপ্রবৃত্তি, মোহ,লোভ-লালসা ইতিবাচক চিন্তার মাধ্যমে মানুষ সমস্যা দুর্দশাগ্রস্ত জীবনধারাকে বদলে ফেলতে সক্ষম হয় এবং মহান খোদা পাকের নৈকট্য হাসিল করে। যেভাবে নবী রাসূলগণ ওলি আউলিয়ারা আমাদেরকে মোরাকাবা মোশাহেদার তালিম তালকিন দিয়ে থাকেন। এর মাধ্যমে আত্মার উন্নয়ন ঘটানো, শারীরিক মানষিক নানা রকম দুরারোগ্য থেকে নিরাময় লাভ করা যায়। হার্বাড বিশ্ববিদ্যালয় এর মাইন্ড বড়ি ইনস্টিটিউটের প্রধান ডঃ হার্বার্ড বেন্সন বলেছেন- মানুষের প্রায় ৯০ ভাগ রোগই মনোদৈহিক। যা মানুষের মনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক জরিপে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৫২ ভাগ প্রতিষ্ঠানই তাদের কর্মীদের মোরাকাবা বা মেডিটেশনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। কারণ, তারা দেখছে, মেডিটেশন করা কর্মীর উৎপাদন ক্ষমতা মেডিটেশন না করা কর্মীর চেয়ে শতভাগ বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও সেদিকে ঝুঁকছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

গবেষণার এক তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে এখন প্রায় ৫০ কোটি মানুষ নিয়মিত মোরাকাবা বা ধ্যান করে থাকে। স্ট্রেস বা মানসিক চাপ নিয়ে যখন একজন মানুষ ধ্যানমগ্ন হন বা মেডিটেশন করেন তার ট্রেসের মাত্রা কমে যায় শতকরা ৬০ ভাগ। গবেষণার তথ্য মতে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার অন্তত ৮৭ ভাগ কমে গেছে মেডিটেশন করা ব্যাক্তিদের। শতকরা ৯১ ভাগ মানুষ ঘুমের ওষুধ বা শ্লিপিং পিল খাওয়া বাদ দিতে পেরেছেন মেডিটেশন করে। অথচ কোন ওষুধ বা প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে এমন সাফল্য কখনও দেখা যায়নি।

মোরাকাবা বা মেডিটেশন মস্তিষ্কের ভিটামিনের মতো কার্যকর, এটি উদ্বেগ, হতাশা, নৈরাশ্যবাদ এবং একাকীত্বের মতো ক্ষতিকর স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে মানুষ কে সুন্দর অনাবিল প্রশান্তির মাধ্যমে সুখী সমৃদ্ধ উন্নত জীবন পরিচালনায় সহায়তা করে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। মোরাকাবা মস্তিষ্কের উন্নতি সাধন করে, নিজের এবং সামাজিক জীবন সম্পর্কে আরও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী করে, স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে একাগ্রতা নিষ্ঠাবান হিসেবে প্রস্তুত করে সর্বোপরি মানসিক চাপ বা ট্রেস কমায়। সুস্-সফল কর্মময় সুখী জীবন লাভে বিশ্বজুড়ে মোরাকাবা বা মেডিটেশন হয়ে উঠেছে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নিরাময়ের বিকল্প পদ্ধতি। সাফল্যের অব্যর্থ প্রক্রিয়া প্রশান্তির লাগসই টেকনিক হিসেবে দিন দিন মোরাকাবার গুরুত্ব সচেতন মহলে ব্যাপক প্রসারিত।

সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, একজন মানুষের গড়ে .০৯ সেকেন্ড পর্যন্ত কোনো জিনিসের প্রতি ফোকাস করতে পারে। যদি আমাদের ফোকাস এতো কম সময় জন্য হয় তবে আমরা কিভাবে নতুন জিনিসের প্রতি মনোযোগ দেব। তাই মেডিটেশন আমাদের আরও ক্রিয়েটিভিটিকে বাড়ায় যাতে করে আমরা যে দিকে মনে হয় সেদিকে মনোনিবেশ করতে পারি গভীর ভাবে

গবেষণায় দেখা গেছে যে মোরাকাবা বা মেডিটেশনের এমন ক্ষমতা রয়েছে যা প্রীফ্রন্টাল কর্টেক্সকে উদ্দীপিত করে এবং শরীরে অবস্থিত ডোপামিন, সেরোটোনিন এবং এন্ডোরফিন নামক হরমোনকে নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে, যারফলে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি এবং স্ট্রেসলেস মাইন্ডসেট আমাদের ভীতর তৈরি হয়। আধুনিক গবেষণা বলছে আলঝইমার্স, এডিএইচডি, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, ইনসমনিয়া থেকে শুরু করে অ্যাংজায়িটি, ডিপ্রেশন, ফিয়ার সাইকোসিস প্রভৃতি রোগের ক্ষেত্রে মোরাকাবা বা মেডিটেশনের কয়েকটি পদ্ধতি খুব ভালো কাজ করে। প্রথাগত চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে সঠিক পদ্ধতিতে মেডিটেশন করলে সুফল লাভ হয়। মেডিটেশন এবং সাইক্রিয়াটিক একে অপরের পরিপূরক।

মোরাকাবা বা মেডিটেশন মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে। আজকের দিনে ভালো থাকার অনুভূতি খুঁজে পাওয়াটাই সবথেকে কঠিন কাজ। এক্ষেত্রে নিয়মিত ধ্যান করতে পারলে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকতে পারে। দূর হয় অবসাদ, উৎকণ্ঠা, ভয়-ভীতি, হতাশা-নিরাশা নিজের প্রতি ফেরে আত্মবিশ্বাস। গবেষণায় আরও দেখা গেছে ২০ মিনিটের মোরাকাবা বা ধ্যান আপনার শরীরকে ঘন্টা গভীর ঘুমের মতো বিশ্রাম দিতে পারে এবং আপনার রক্তচাপকেও নিয়ন্ত্রনে আনতে পারে এটা দীর্ঘদিন ধরে প্র্যাকটিস করলে যেকোনো মানুষের অনিদ্রার রোগ কেটে যায় বলে মত দিয়েছেন অনেক বিশেষজ্ঞ মহল।

In an 8-week study, a meditation style called “mindfulness meditation” reduced the inflammation response caused by stress (2). Furthermore, research has shown that meditation may also improve symptoms of stress-related conditions, including irritable bowel syndrome, post-traumatic stress disorder, and fibromyalgia. (Health Line)

Another study in 47 people with chronic pain found that completing an 8-week meditation program led to noticeable improvements in depression, anxiety, and pain over 1 year. (PubMed Central)

সমীক্ষায় দেখা গেছে, যাঁরা নিয়মিত মোরাকাবা বা মেডিটেশন করেন, তাঁদের অহঙ্কার কমতে থাকে ক্রমশ, আত্মার সঙ্গে গড়ে ওঠে নিবিড় বন্ধন।

মনের মধ্যে যে সব রাগ আর ক্ষোভ আমরা পুষে রাখি, তার অনেকটা থেকেই মুক্তি দেয় নিয়মিত ধ্যানের অভ্যেস। স্ট্রেস বা অ্যাংজাইটি বাড়লে বেড়ে যায় হৃদস্পন্দনের হারও। মেডিটেশনের অভ্যেস সেই গতিও কমাতে পারে। তা ছাড়া মন শান্ত হয়, নিয়ন্ত্রণ আসে রাগের উপর। রাগ কমে এলেই মানুষের মায়া-দয়া বাড়ে। সব মিলিয়ে আপনি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন অনেক ভালোভাবে।

২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যা ৭৫৩ কোটি। বিশ্ব জনসংখ্যা প্রসপেক্টাসের মতে ২০৫০ সালে এর সংখ্যা দাঁড়াবে ৯২০ কোটিতে। ২০১২ সালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ মতে পৃথিবীতে প্রায় কোটি ২৬ লক্ষ মানুষ অস্বাস্থ্যকর কাজ করার কারণে মারা যান। যারা কোনো ভাবেই জানা সত্বেও মোটেও স্বাস্থ্য সচেতন নয়।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর প্রায় ৫৩৫,০০০ জন হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়, যার মধ্যে প্রতি ১০,০০০ জনের মধ্যে ১৩ জনের (৩২৬,০০০ বা ৬১%) হাসপাতালের বাহিরে সংঘটিত হয় এবং বাকিদের (২০৯,০০০ বা ৩৯%) হাসপাতালের অভ্যন্তরে। হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার পর হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসার মাধ্যমে আরোগ্যর সম্ভাবনা প্রায় % যারা বেঁচে থাকেন তাদের মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হারে বিকলাঙ্গতা দেখা যায়। যদিও বিভিন্ন আমেরিকান টিভি অনুষ্ঠানে ৬৭% এর মতো অবাস্তব উচ্চমাত্রার আরোগ্য সম্ভাবনা দেখানো হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব বলছে, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগে থাকেন বিশ্বের প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ। আর এই সমস্যায় সারা বিশ্বে প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও বলছে, জীবনমান নির্ভর করে চারটি বিষয়ের ওপর: শারীরিক স্বাস্থ্য, মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্য, সামাজিক সম্পর্ক পরিবেশ। ব্যথা বা অস্বস্তি, ওষুধের ওপর নির্ভরতা, ক্লান্তি, চলাচলের ক্ষমতা, ঘুম বিশ্রাম, কর্মক্ষমতার মাধ্যমে একজন মানুষের শরীরিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানা যায়। চিন্তা, শিখন, স্মৃতি, মনোযোগ, শারীরিক ভাবভঙ্গিএসব থেকে মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্যের অবস্থা জানা যায়।

লেখক: সাবেক গবেষক কর্মকর্তা, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি

 

শেয়ার করুন: