
ফাইল ছবি
বৈশাখী উৎসবের আয়োজন করে ছায়ানট, চারুকলা। আমাদের কী দুর্ভাগ্য নিউইয়র্কে বৈশাখী উৎসবের আয়োজন করে ঘজই ডড়ৎষফরিফব; নামটি লিখতে গেলেও প্রিয় বাংলা ভাষার কি-বোর্ড পাল্টে ভিনদেশী ভাষায় লিখতে হয়। নতজানু ঔপনিবেশিক মানসিকতা আমাদের মাথা এখনও ইংরেজদের পায়ের নিচেই ঠেসে ধরে আছে। ইংরেজ গেল বটে কিন্তু যায়নি ওদেরই তৈরী করে দিয়ে যাওয়া নতজানু ব্যক্তিত্ব। আমাদের বঙ্কিম মেরুদ- এমন এক জায়গায় গিয়ে স্থির হয়ে আছে, চাইলেও এখন আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারি না।
এখনও দেখি কোনো সভা সমাবেশে সাদা চামড়ার কেউ এলে আয়োজকেরা যারপরনাই খুশি হন, তার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, অথচ সাদা চামড়ার লোকটি যোগ্যতার বিচারে দশবার প্রণাম করেন যে বাঙালি মেধাবী মানুষটিকে, তাকে আমরাই কনুইয়ের গুতোয় ঠেলতে ঠেলতে মঞ্চের পেছন দিক দিয়ে ফেলে দিই। আমি বলছি না সাদা চামড়ার মানুষকে আমরা শ্রদ্ধা করবো না, ভালোবাসবো না, অবশ্যই ভালাবাসবো, শ্রদ্ধা করবো কিন্তু নতজানু মানসিকতা আমাদের অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
ঐক্যের সম্ভাবনা তো ঝুড়ির একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছেই, যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও নিঃশেষ হবার উপক্রম হয়েছিল এই বৈশাখে। বাঙালির সবচেয়ে বড়ো অসাম্প্রদায়িক, সার্বজনীন একটি উৎসব পহেলা বৈশাখ। সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘটা করে একটি বড়ো উৎসব পালন করাই যথার্থ কিন্তু সেই ঐক্য নিউইয়র্কে নেই। বিভিন্ন সংগঠন নিজেদের মত করে আয়োজন করে বৈশাখী উৎসব। রোজার মধ্যে এবারের পহেলা বৈশাখ হওয়াতে কেউ কেউ অনুরোধ করেছিলেন ঈদের পরে যেন আয়োজনগুলো করা হয়। অনেক সংগঠন তা মানলেও একটি সংগঠন তা কিছুতেই মানতে চায়নি। তারা ‘শতকণ্ঠে বর্ষবরণ’-এর একটি সুন্দর আহ্বান করেছেন বটে কিন্তু তা সার্বজনীন করে তুলতে পারেননি। শুনেছি যারা ঈদের পরে করবার অনুরোধ করেছিলেন তাদের কেউ কেউ অত্যন্ত ন্যাক্কারজনকভাবে অনুষ্ঠানটি বানচাল করার জন্য আইনী ব্যাবস্থাও নিতে চেয়েছিলেন। বাঙালির গলায় বাঙালি ছুরি না বসালে আর কে বসাবে? বৈশাখকে রমজানের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বিষয়টিকে প্রায় হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলেন দুই পক্ষ। আমার অত্যন্ত কাছের একজন সংস্কৃতি-কর্মী, ছড়া লেখক, যিনি ধর্মে হিন্দু, আমাকে জানালেন, ‘আমরা হেরে যেতে পারি না, প্রয়োজন হলে এই অনুষ্ঠান সফল করার জন্য যত টাকা লাগে আমি দেব’। আমি তখন রীতিমতো কেঁপে উঠি। এখানেও হিন্দু-মুসলমান সংঘাত? আবার রায়ট? এই শিক্ষিত, উন্নত দেশে! যে দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির হাজারো দৃষ্টান্তের জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে উজ্জ্বল? নিউইয়র্কে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলার মানুষ বিভক্ত, নেতৃত্বের কোন্দলে প্রতিটি জেলার নামে একাধিক সমিতি আছে, উত্তর আমেরিকার বাঙালি সংগঠনগুলোর ফেডারেশন যে ফোবানা তা এখন তিন/চার খন্ডে বিভক্ত, রাজনৈতিক বিভাজন তো আছেই, এসবের ওপর আবার কি গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো যুক্ত হবে ধর্মীয় বিভাজন? ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিলাম, তা যেন কিছুতেই না হয়।
যে ভদ্রলোক যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখিয়ে বলেছিলেন, কিছুতেই হেরে যাওয়া যাবে না, আমি তাকে বলি, আপনি তো ওদের অনেক টাকা দেবেন, ওরা নিশ্চয়ই আপনার কথা শুনবে। ওদের অনুষ্ঠান সূচিতে দেখলাম ইফতারের কোনো বিরতি নেই। আপনি ওদের বলেন অন্তত ইফতারের সময় যেন ৩০ মিনিটের বিরতি দেয়, এতে করে রোজার প্রতি সম্মান দেখানো হবে, বাঙালি মুসলমানেরা খুশি হবে। হিন্দু-মুসলমান বিভাজন যেন কিছুতেই বাঙালিদের মধ্যে বিষবাষ্প ছড়াতে না পারে সেজন্য আমাদের চেষ্টা করা উচিৎ। তিনি আমার কথা শুনলেন এবং অনুষ্ঠানের পরে ফোন করে জানালেন, ইফতারের বিরতি দেবার বিষয়টি তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, আয়োজকেরা প্রথমে মানতে না চাইলেও পরে মেনেছেন। বিরতি দেয়া হয়েছে। আমি আশ্বস্ত হই।
পহেলা বৈশাখের প্রভাতে পৃথিবীর রাজধানী-খ্যাত নিউইয়র্ক শহরের বিখ্যাত টাইমস স্কয়ারে শতকণ্ঠে বাংলা গান, আহা কী অসাধারণ সেই দৃশ্য, বর্ষীয়ান নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান টাইমস স্কয়ারের পিচঢালা রাস্তায়, খোলা আকাশের নিচে, নাচের মুদ্রায় ছড়িয়ে দিলেন আবহমান বাংলা সংস্কৃতির ঐতিহ্য। বাঙালি হিসেবে এটি শুধু আনন্দেরই না, গর্বেরও। এটি একটি ইতিহাসও বটে। এর ধারাবাহিক সাফল্য দেখার প্রত্যাশায় আমার চোখ খোলা রাখবো সব সময়। তবে আমার একটি প্রত্যাশা ও অনুরোধ, পরের বছর যেন এই অনুষ্ঠানটি ‘ঘজই ডড়ৎষফরিফব’ নামের একটি বিজাতীয় ব্যানারে না হয়। বাঙালি হিসেবে এটি আমাদের জন্য খুব লজ্জার যে একটি নান্দনিক বাংলা ব্যানারে এই অনুষ্ঠানটি আমরা করতে পারিনি।
আমরা যখন বঙ্কিম মেরুদ- আর নতজানু মস্তিস্ক নিয়ে তাকিয়ে থাকি সাদা চামড়ার মানুষদের পায়ের দিকে তখন একদল সাদা চামড়ার মানুষ আমাদের মাথা উঁচু করে দিতে এগিয়ে এলেন, উঠলেন বৈশাখী মঞ্চে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির এই শক্তি তাদের রক্তের মধ্যে প্রোথিত করেছেন এক বাঙালি মহাপুররুষ শ্রী চিন্ময়। ঐক্য, শান্তি ও মানবতার নীল পতাকা তিনি উড়িয়েছিলেন নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় আজ থেকে বহুবছর আগে। ২০১১ সালে আমি নিউইয়র্কে আসি। জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশ পার্মানেন্ট মিশনের স্থায়ী প্রতিনিধি তখন ড. একে এ মোমেন, যিনি এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রী, তার আমন্ত্রণে মিশনের একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি একদল সাদা চামড়ার মানুষ নীল শাড়ি আর নীল পাঞ্জাবি পরে প্রায় শুদ্ধ উচ্চারণে গাইছেন বাংলা গান। আমি বিস্মিত হই বাংলা ভাষার প্রতি তাদের প্রেম, ভক্তি এবং দরদ দেখে। এরা কারা? পরে জেনেছি এরা সকলেই শ্রী চিন্ময় সেন্টারের সদস্য। আরো অবাক হয়েছি জেনে, এদের কারো নাম অর্পন, কারো নাম চন্ডিকা, কারো নাম নয়না, কারো নাম অপরাজিতা, অভিনব, তৃষাতুর ইত্যাদি। ভেবেছিলাম, বাঙালিদের সঙ্গে সহজে মেশার জন্য হয়ত ওরা এই নাম বলে বেড়ায় কিন্তু যখন আমার স্ত্রীর সহকর্মী তৃষাতুর আমাদের বাড়িতে এলেন তখন জানলাম ওরা এভিডেভিড করে নিজেদের আমেরিকান নাম বদলে পাকাপোক্তভাবে বাংলা নাম গ্রহণ করেছেন এবং অধিকাংশ নামই আধ্যাত্মিক সাধক গুরু শ্রী চিন্ময় নিজেই ওদের দিয়েছেন। বাংলার প্রতি এই মানুষগুলোর নিখাঁদ প্রেম আমাকে মুগ্ধ করে। ওরা যখন বাংলা চর্চার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে নিজেদের পৈত্রিক নাম বদলে বাংলা নাম ধারণ করছে, আমরা তখন কোন অনুপ্রেরণায় ইংরেজি নামের সংগঠনের ব্যানারে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করি! এই লজ্জা কোথায় রাখি। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা নিশ্চয়ই ভাবছেন, নিউইয়র্কে নিশ্চয়ই সংস্কৃতিমনা মেধাবী কোনো বাঙালি নেই, থাকলে এমন লজ্জাজনক ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটতে দিতেন না।
এ বছর নিউইয়র্কের বৈশাখী মঞ্চে গান গাইতে ওঠেন শ্রী চিন্ময় সেন্টার নিউইয়র্ক এবং নেদারল্যান্ডসের শিল্পীরা। তারা গুরু চিন্ময় রচিত এবং সুরারোপিত ছয়টি বাংলা গান পরিবেশন করে বৈশাখী উৎসবকে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন শ্রী চিন্ময় সেন্টারের একজন একনিষ্ঠ অনুসারী মিডিয়া ব্যক্তিত্ব দিমা নেফারতিতি। শ্রী চিন্ময় সেন্টার নেদারল্যান্ডসের শিল্পীরা আসেন হাঙ্গেরি, মেসিডোনিয়া, জার্মানী এবং নেদারল্যান্ডস থেকে।
আমাদের কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা লিখেছেন, ‘যতদূর বাংলা ভাষা ততদূর বাংলাদেশ’, ভিনদেশি শিল্পীরা নিরন্তর বাংলা সংস্কৃতির চর্চা করার মধ্য দিয়ে এই সত্য আমাদের জানিয়ে দিলেন। ভিন দেশিদের বাংলা চর্চা বলে দিচ্ছে বাংলা ভাষা ক্রমশ বাঙালির চেয়েও বড়ো হয়ে উঠছে। জয় হোক বাংলা ভাষার, জয় হোক বাংলা সংস্কৃতির।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৮ এপ্রিল ২০২৩।