শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

অর্থ গেছে ক্যাসিনোতে 

বাংলাদেশ দূতাবাসে মিলিয়ন  ডলার চুরি, ফাইল গায়েব

মিজানুর রহমান 

প্রকাশিত: ১৭:২১, ৭ জুন ২০২৪

বাংলাদেশ দূতাবাসে মিলিয়ন  ডলার চুরি, ফাইল গায়েব

ছবি - নবযুগ

ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে কয়েক মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রভাবশালী চক্র। আত্মসাৎ করেছে দূতাবাসের ১ লাখ ৭৬ হাজার ডলারের ইমার্জেন্সি ফান্ড। তাছাড়া দূতাবাসের অ্যাকাউন্ট থেকে কৌশলে সরানো হয়েছে আরও প্রায় সোয়া ৩ লাখ ডলার। সেই চুরির প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, শুধু সিডর ইমার্জেন্সি ফান্ড বা দূতাবাসের অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ লোপাট নয়, রাষ্ট্রদূতের বাসভবন (বাংলাদেশ হাউস) মেরামতেও ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।

রাষ্ট্রদূতের রিপোর্ট, পররাষ্ট্র দপ্তরে জমা পড়া অভিযোগ, এ প্রতিবেদকের সরজমিন ওয়াশিংটনে অনুসন্ধান, হাতে আসা নথি এবং সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপে অভিযোগগুলোর সত্যতা মিলেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময়ে দূতাবাসের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এই ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না।
জানা গেছে, সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হয়েছে ওয়াশিংটন ডিসি লাগয়ো মেরিল্যান্ডে বেথেসডা হাইবরো এলাকায় থাকা বাংলাদেশ হাউস নির্মাণে। বাড়ির জমিসহ বাজারমূল্য (রিয়েলটর প্রতিষ্ঠান রেডফিন ও জিলোর তথ্য) ৪.২৩ মিলিয়ন থেকে সর্বোচ্চ ৫.১ মিলিয়ন ডলার। বাড়িটি মেরামতেই (কাঠামোগত সংস্কার এবং সৌন্দর্য্য বর্ধনে) বিল দেখানো হয়েছে ৬ মিলিয়ন ডলার। ৬০ কোটি টাকায় সংস্কার করা বাড়িতে এতটাই নি¤œমানের সামগ্রী ব্যবহার হয়েছে যে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাড়িটি উদ্বোধনের কয়েক মাস পর ছাদে ফাটল ধরেছে।
সামান্য বরফ জমলে বা ঝড়বৃষ্টিতে ঘরের বিভিন্ন অংশে পানি প্রবেশ করে। ওই বাড়িতে রাষ্ট্রদূত, তার পরিবার এবং ব্যক্তিগত কর্মচারীরা বসবাস করলেও মান-সম্মান হারানোর ভয়ে কূটনৈতিক পার্টির আয়োজন বন্ধ রাখা হয়েছে। বিষয়টি সরজমিন দেখে দ্রুত পুনঃসংস্কারের ব্যবস্থা নিতে ঢাকায় দফায় দফায় আর্জি জানাচ্ছেন বর্তমান রাষ্ট্রদূত ইমরান আহমেদ। ওয়াশিংটনে সিস্টেমেটিক দুর্নীতি নিয়ে রহস্যজনক কারণে শুরু থেকেই লুকোচুরি চলছে। ওয়াশিংটন মিশনের ১ লাখ ৪৬ হাজার ডলার গেল কই? এই শিরোনামে ঘটনার অংশবিশেষ তুলে ধরে গত বছরের মার্চে মানবজমিন একটি রিপোর্ট করেছিল। সেই রিপোর্টের প্রেক্ষিতে পুরো বিষয়টি তদন্তে তখন ৩ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নাম প্রস্তাব করে একটি ফাইল উঠেছিল। কিন্তু আজ অবধি তদন্তটি হয়নি।
ওয়াকিবহাল সূত্রের দাবি, ওয়াশিংটনের পুকুর চুরির বিস্তৃত তদন্ত এবং প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করতে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আবদুল মোমেন অবধি ফাইলটি উঠেছিল। মন্ত্রী বদল হয়েছে, কিন্তু আজও নামেনি ফাইলটি। এটি রহস্যজনক মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকের তথ্য, দূতাবাসের অর্থ গেছে ক্যাসিনোতে: ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের ডরমেন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে বেহাত হওয়া কয়েক লাখ ডলারের (ইমার্জেন্সি তহবিল) একটি বড় অংশ ক্যাসিনোতে গেছে বলে দূতাবাসকে জানিয়েছে আমেরিকান সিটি ব্যাংক। তারা এর প্রমাণ হিসাবে দূতাবাসের একজন কর্মকর্তার এটিএম কার্ডের বিস্তারিত শেয়ার করেছে। আচমকা দূতাবাসের ডরমেন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন এবং কয়েক মাসের ব্যবধানে অ্যাকাউন্টটি খালি করার বিষয়টি সন্দেহজনক ঠেকে আমেরিকান সিটি ব্যাংকের ম্যানেজার (ভাইস প্রেসিডেন্ট) সাচা খানের কাছে। তিনি চিঠি দিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রদূত এম শহীদুল ইসলামকে বিষয়টি অবহিত করেন। ডকুমেন্ট বলছে, ওয়াশিংটনে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনকারী রাষ্ট্রদূত এম জিয়াউদ্দিনের বিদায় এবং পরবর্তী রাষ্ট্রদূত এম শহীদুল ইসলামের দায়িত্ব গ্রহণের মুহূর্তে (ট্রানজিশন পিরিয়ডে) অ্যাকাউনটটি খালি করার ঘটনা ঘটে। তখন দূতাবাসের তৎকালীন হেড অব চ্যান্সারি (ডিডিও’র বাড়তি দায়িত্ব) ছিলেন ৩০ ব্যাচের কর্মকর্তা মাহমুদুল ইসলাম। তার স্বাক্ষরে ব্যাংকের হিসাবটি ক্লোজ করা হয়। ২০২১ সালের মার্চে অ্যাকাউন্টটি ক্লোজ হলেও তা নিয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সন্দেহ দূর না হওয়ায় পরবর্তীতেও দূতাবাসের সঙ্গে চিঠি চালাচালি চলতে থাকে। ওয়াশিংটন দূতাবাস এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি জানাজানির পর রীতিমতো তোলপাড় শুরু হয়। কিন্তু বিষয়টি যাতে কোনো অবস্থাতেই গণমাধ্যমে প্রকাশ না পায় এজন্য অফিসারদের নিয়মিত বিরতিতে ডেকে ব্রিফ করে সম্ভাব্য সব ছিদ্র বন্ধ করা হয়। অনেকটা নীরবেই তথ্যানুসন্ধান শুরু হয় এবং ঘটনার সত্যতা পায় সরকার। দায়িত্বশীলরা জানান, কী অজুহাত দেখিয়ে মোটা অঙ্কের ওই অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে, এর ব্যয় কীভাবে দেখানো হয়েছে? অর্থ উত্তোলনের প্রক্রিয়া এবং কার কার মধ্যে এটি ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে তা-ও তখন খোঁজা হয়। কিন্তু ততক্ষণে একটি পক্ষ তৎপর হয়ে উঠে সেই অনুসন্ধান বন্ধ করতে।
২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র‌্যাবের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা জারির প্রেক্ষিতে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হলে তৎকালীন রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়। সঙ্গত কারণেই অর্থ লুটের বিষয়টি তখন ছাইছাপা পড়ে যায়। স্মরণ করা যায়, যেকোনো দূতাবাসের আয়-ব্যয়ে একটি অ্যাকাউন্ট থাকে। যাকে মাদার বা মূল অ্যাকাউন্ট বলা হয়। সরকারের অনুমতি নিয়ে বাড়তি অ্যাকাউন্ট খোলা বা বন্ধ করতে হয়। ‘সেভিংস ফর ইমার্জেন্সি’ ছিল ওয়াশিংটন মিশনের স্বতন্ত্র অ্যাকাউন্ট। যার নাম্বার ছিল সিটি বিজনেস আইএমএমএ-১৫২৮৩৩২১। সূত্রমতে, ২০০৭ সালে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর ইমার্জেন্সি ওই হিসাব খোলা হয়েছিল। শুরুতেই এতে জমা হয়েছিল বেশ অর্থ। কিন্তু অনেক দিন এতে লেনদেন না হওয়ায় অ্যাকাউন্টটি ‘ডরমেন্ট’ অবস্থায় চলে যায়।
নির্মাণ ব্যয় থার্ড পার্টি দিয়ে নিরীক্ষার চেষ্টা সফল হয়নি: রাষ্ট্রদূতের বাড়িটির নির্মাণকাজে কতোটা অনিয়ম হয়েছে তা বুঝতে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নিরীক্ষার চেষ্টা করেছিলেন একজন রাষ্ট্রদূত। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির চাপে এনিয়ে তিনি বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। স্থানীয় রিয়েলটরদের বিবেচনায় বাংলাদেশ হাউসে যে নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার হয়েছে তার ব্যয় কোনো অবস্থাতেই ৩ মিলিয়নের বেশি হওয়ার কথা নয়। স্মরণ করা যায়, জমির পরিমাণ, বিদ্যমান অবকাঠামো এবং ইন্টেরিয়র বিচেনায় বিভিন্ন রিয়েলটর প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বাড়িগুলোর ইভালুয়েশন করে দাম নির্ধারণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম রিয়েলটর প্রতিষ্ঠান জিলো তাদের ওয়েবসাইটে ৪ ঐরমযনড়ৎড় ঈঃ, ইবঃযবংফধ, গউ ২০৮১৭, টঝঅ (বাংলাদেশ হাউস) বাড়িটির জমিসহ মূল্য দেখিয়েছে ৫.১ মিলিয়ন ডলার। অন্য প্রতিষ্ঠান রেডফিন পুনর্র্নিমাণকৃত ওই বাড়িটির জমিসহ মূল্য দেখিয়েছে ৪.২৩ মিলিয়ন ডলার।
তদন্ত ফাইল গায়েব এবং: ওয়াশিংটনে চুরির তদন্তের ফাইল গায়েবের বিষয়টি অস্বীকার করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রশাসন অনুবিভাগ। দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন, ফাইলটি গায়েব নয় বরং এটি প্রক্রিয়াধীন আছে। গত বছরে নেয়া তদন্তের নীতিগত সিদ্ধান্ত এখনো বহাল রয়েছে জানিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচনের আগে ফাইলটি উঠেছিলো বলে তা এখন অনেকটাই অকার্যকর। মন্ত্রী পদে পরিবর্তনসহ নানা কারণে পূর্বের প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি নতুনভাবে উপস্থাপন করে তার মতামত নিয়েই স্পর্শকাতর ওই ঘটনার তদন্ত করতে হবে, এটাই সঙ্গত। বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সদ্য সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে আবদুল মোমেন আলাপে বলেন, সার্বিক দিক বিবেচনায় মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়ার এডিমিরাল (অব.) খুরশেদ আলমকে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনে প্রস্তাব করেছিলাম। যদিও পররাষ্ট্র সচিবের প্রস্তাব ছিল নিউইয়র্কস্থ জাতিংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মোহাম্মদ মুহিতকে প্রধান করার। তদন্ত কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন প্রতিনিধিকেও রাখা হয়েছিল জানিয়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ওয়াশিংটন মিশনের অ্যাকাউন্ট থেকে ৪ লাখ ৯০ হাজার ডলার চুরির তথ্য পাই। সেইসঙ্গে রাষ্ট্রদূতের বাড়ি নির্মাণ প্রকল্পে মিলিয়ন ডলার দুর্নীতির তথ্য আসে। বিদায়ের আগে অনেক কাজ হলো কিন্তু দুর্ভাগ্য, চুরির তদন্তটি শুরু করে আসতে পারিনি। তিনি বলেন, আউটসাইডার হলেও এডমিরাল খুরশেদ আলম পররাষ্ট্রে বহু জটিল তদন্ত করেছেন এবং এসব কাজে তিনি দক্ষ। ড. মোমেন মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া এই তদন্ত বেশিদূর অগ্রসর হবে না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানান, ওয়াশিংটনের ঘটনার ব্যাপারে এখনো তিনি অবহিত নন। গত ৫ মাসে বিষয়টি মন্ত্রীর নোটিশে আনা হয়নি বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন। লিখিত প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে জনসংযোগ কর্মকর্তা (পরিচালক) মীর আকরাম উদ্দিন আহম্মদ বলেন, ওয়াশিংটনের তহবিল তছরুপ বিষয়ে মন্ত্রী অবহিত নন। তিনি এখন হয়তো খোঁজখবর নেবেন এবং আশা করি এ ব্যাপারে পরবর্তী নির্দেশনা দেবেন।
 

শেয়ার করুন: