
ছবি: সংগৃহীত
সকাল ৬টা ৩৮ মিনিটে টোকিও সেন্ট্রাল রেল স্টেশান থেকে সিনকানসেন (বুলেট) ট্রেন যোগে রওয়ানা হয়েছি পারমাণবিক বোমার ধ্বংসলীলার স্মৃতি বিজড়িত শহর হিরোশিমার উদ্দেশ্যে। হিরোশিমা-নাগাসাকির ঘটনা মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায়। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট ‘লিটল বয়’ নামের এক পারমাণবিক বোমা জাপানের হিরোশিমায় নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এর ঠিক তিন দিন পর নাগাসাকি শহরে নিক্ষেপ করা হয়েছিল আরও একটি পারমাণবিক বোমা।
এই দুই পারমাণবিক বোমার আঘাতে জাপানের এই দুটি শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সবাই ধরেই নিয়েছিল শহর দুটি আর কোনোদিনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু সব ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে হিরোশিমা ও নাগাসাকি বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদের স্বকীয় অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
পারমাণবিক বোমার আঘাতে প্রায় নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে পড়া হিরোশিমা শহরটি আজ বিশ্বের অন্যতম এক সমৃদ্ধ শহর। আধুনিকতার ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত শহরটি পারমাণবিক বোমার স্মৃতি কী পুরোপুরি মুছে ফেলতে পেরেছে? উত্তর, অবশ্যই না। কারণ জাপান সরকার ও হিরোশিমার অধিবাসীরা কখনোই চাননি এ নির্মম হত্যাকা- ও নিষ্ঠুর ধ্বংসলীলা ইতিহাস থেকে মুছে যাক। বিশ্বের মানুষ ভুলে যাক সেসব ভয়ঙ্কর মুহূর্তগুলোর কথা যেখানে মানবতার বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদেছিল। হিরোশিমা শহরের চারপাশে সেসব ভয়ঙ্কর স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য একাধিক স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। কীভাবে হিরোশিমা তার পারমাণবিক বোমার স্মৃতিকে ধরে রেখেছে তা দেখতেই আমি নিউইয়র্ক থেকে উড়ে এসেছি জাপানে।
গত এপ্রিল মাসে আমার আসার কথা ছিলো জাপানে। চেরি ব্লসম ফেস্টিভল দেখে হিরোশিমা ভ্রমনের প্রোগ্রাম ছিলো। টোকিও থেকে হিরোশিমা যাবার জন্য বিমানের টিকিটও কেটেছিলাম। কিন্তু ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে আসা হয়নি। এবার ভেবেছিলাম টোকিও এসে টিকিট কাটবো। কিন্তু প্রথম দিন যে ট্যাক্সি ড্রাইভার নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম আমার হিরোশিমা যাবার কথা শুনে সে বল্লো, আমি আরো কম খরচে বুলেট ট্রেনে প্রথম শ্রেনীতে ভ্রমণ করতে পারি। আমি রাজী হওয়ায় সে আমাকে সাথে নিয়ে স্টেশনে গিয়ে টিকেট কিনতে সাহায্য করে।
সকাল ৯টায় আমার টিকিট ছিলো। মাউন্ট ফুজি থেকে বুলেট থেকে টোকিও স্টেশনে নেমে বের হতে হিমশিম খেতে হয়। বিশাল বড়স্টেশন। তাই আজ সকাল ৬ টায় এসেছি যাতে নিদৃষ্ট প্লাটফর্ম খুঁজে বের করতে সহজ হয়।
আমি রেলের একজন কর্মকর্তাকে আমার টিকিটটি দেখিয়ে প্লাটফর্মটা জানতে চাইলে তিনি বল্লেন, তোমার ট্রেন তো নয়টায়-এতক্ষণ প্লাটফর্মে অপেক্ষা করবে? তুমি চাইলে এখন যে ট্রেনটা আসবে তার জন্য টিকিটটা পরিবর্তন করে দিতে পারি।
আমি সানন্দে রাজী হলাম। তিনি আমাকে সাথে করে টিকিট পরিবর্তন করে প্লাটফর্মে নিয়ে এলেন। আমার ফাস্ট ক্লাসের কম্পার্টমেন্ট যে স্থানটিতে দাঁড়াবে তাও দেখিয়ে দিলেন।
প্রতিটি ক্ষেত্রে জাপানীদের বদান্যতা দেখে মুগ্ধ হচ্ছি।
বুলেট ট্রেনের মধ্যে কয়েক রকম ট্রেন আছে। ঘড়ুড়সর হচ্ছে এর মধ্যে সর্বোচ্চ বেগে চলা ট্রেন। এই ট্রেনগুলো প্রায় ৩০০ কিমি/ঘণ্টা (প্রায় ১৮৬ মাইল/ঘন্টা) বেগে চলতে পারে। আমি যাচ্ছি এই দ্রুতবেগের ট্রেন নজমিতে। টোকিও এবং হিরোশিমার মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৮২০ কিমি (৫১০ মাইল)। ৪ ঘন্টা লাগবে হিরোশিমা পৌঁছাতে।
প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ট্রেনটিকে মনে হচ্ছিলো যেন এক লম্বা রুপালি ড্রাগন। নাক বরাবর সূচালো ডিজাইন, চকচকে বডি আর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা কর্মচারীদের স্যালুট সব মিলিয়ে মুহূর্তটা যেন সিনেমার দৃশ্য।
ভেতরে ঢুকতেই প্রথমেই চোখে পড়ে প্রশস্ত সিট। বড় বড় জানালা, নরম রিক্লাইনিং চেয়ার, সামনে টেবিল, আর পাশে চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা। সিটে বসে মনে হয় যেন বিমানযাত্রার মতোই আরাম, তবে চারপাশের নীরবতা ভিন্ন শুধু ট্রেনের মৃদু ছন্দ শুনতে পাওয়া যায়।
ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা শোনা গেল গভীর অথচ কোমলকণ্ঠে। ট্রেন যখন গতি বাড়াতে শুরু করল, তখন বুঝতেই পারলাম না কবে ২০০ কিমি/ঘন্টা থেকে ৩০০ কিমি/ঘন্টায় পৌঁছে গেল।
ভেতরে একটু পরপর সুন্দরী ওয়েট্রেস এসে নাস্তা, কফি আর চা বিক্রি করছিল। সকালের যাত্রীদের বেশিরভাগের হাতেই কফির কাপ। আমি এক কাপ কফি আর আইসক্রিম নিলাম। জানালার পাশে বসে কফি চুমুক দিতে দিতে ভোরের আলোর সঙ্গে ট্রেনের গতি যেন মিলেমিশে যাচ্ছিল।
ট্রেনের ভেতরে টয়লেট, ওয়াশবেসিন, এমনকি ছোট্ট ধূমপান কেবিনও রয়েছে। সবকিছু এত পরিষ্কার আর পরিপাটি যে ভ্রমণকারীর মনে হয় এটাই যেন ভ্রমণের প্রকৃত আরাম।
ট্রেন যখন স্টেশন থেকে মৃদু শব্দে ছুঁটে বের হলো, তখন টোকিওর আকাশ পুরো রৌদ্র করোজ্জল হয়ে উঠেনি। শহরের উঁচু অট্টালিকা যেন আধো আলোয় স্বপ্নময় প্রতিচ্ছবি হয়ে আছে। ট্রেনের গতি যত বাড়তে থাকে, জানালার বাইরের দৃশ্য দ্রুত বদলে যেতে থাকে। কংক্রিটের জঙ্গল থেকে সবুজে ভরা বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। ছোট ছোট গ্রাম, আর মাঝে মাঝে পুরনো মন্দিরের লাল তোরণ ট্রেনের গতির সঙ্গে মিলেমিশে চলে থাকে যেন এক চলন্ত চিত্রপট।
মাঝেমাঝে ট্রেন সুড়ঙ্গে ঢোকে এক নিমিষে বাইরের সব আলো-আঁধার ঢেকে যায়, ভেতরে শুধু নিজের প্রতিচ্ছবিই দেখা যায় কাঁচে। আর সুড়ঙ্গ পেরোতেই হঠাৎ যেন নতুন পৃথিবীতে প্রবেশ করি একদিকে পাহাড়ি সবুজ, অন্যদিকে ছোট ছোট নদী বয়ে যাচ্ছে। নদীর জলে সকালের আলো ঝিকমিক করছে, যেন শিশিরে লেখা কবিতা।
শিনকানসেনের ছন্দময় শব্দ, বাইরের দ্রুত পাল্টে যাওয়া দৃশ্য আর ভেতরের নিস্তব্ধতা মিলে আমার যাত্রাটাকে যেন করে তুলেছে একেবারেই ধ্যানময়। মনে হয়, প্রতিটি মাইল পাড়ি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরের কোলাহল ঝরে যাচ্ছে, আর আমি ক্রমশ ইতিহাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি হিরোশিমার মাটিতে, যেখানে সময়ের ঘড়ি একদিন থেমে গিয়েছিল।
এমন যাত্রায় মনে হয় ট্রেন কেবল একটি যানবাহন নয়, বরং সময়ের স্রোতে ভেসে যাওয়া এক নৌকা। টোকিও থেকে হিরোশিমার দিকে এই ভোরের ছুটে চলা শুধু ভৌগোলিক ভ্রমণ নয়, বরং এক আত্মিক যাত্রা—যেখানে প্রতিটি জানালার দৃশ্য একেকটি কবিতার পংক্তি হয়ে পথচলার সাথী হয়।
টোকিও ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা মিললো ইয়োকোহামা সিটির। ট্রেনটা এখানে দাঁড়ালো কিছুক্ষণ। এটি সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটি শিল্পনগরী, আধুনিক বন্দর আর বিশাল ফেরিস হুইল নিয়ে একটি চমতকার শহর।
প্রায় দেড় ঘণ্টা পর আসে নাগোয়া। এটি জাপানের শিল্প ও প্রযুক্তির কেন্দ্র। জানালার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে উঁচু ভবন আর বিশাল স্টেশন। ট্রেন এখানে থামে মাত্র কয়েক মিনিট এরপর আসে জাপানের প্রাচীন রাজধানী কিয়োটো। চারপাশে পাহাড়ে ঘেরা শহর, যার প্রতিটি কোণ ইতিহাসে সমৃদ্ধ। মন্দির, বাগান, পুরোনো রাস্তাবায়নে অতীত থেকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে। শিনকানসেন থেকে বাইরে তাকালে কিয়োটোর সৌন্দর্য ভেসে ওঠে রঙিন ছবির মতো।
কিয়োটোর পর আসে ওসাকা আধুনিকতার প্রাণকেন্দ্র। আকাশচুম্বী ভবন, ব্যস্ত সড়ক, আর দূরে ভেসে ওঠে ওসাকা ক্যাসলের আভাস। ওসাকার প্রাণবন্ত পরিবেশ যেন ট্রেনের জানালা দিয়েও ছড়িয়ে পড়ে যাত্রীদের মনে।
তারপর ট্রেন চলে যায় কোবি আর ওকায়ামার দিক দিয়ে। পাহাড়, সমুদ্র আর সবুজ মাঠ মিলেমিশে এক অপূর্ব দৃশ্য তৈরি করে। কোথাও দেখা যায় ছোট্ট গ্রাম, কোথাও আবার বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তর।
অবশেষে ১১ টা ৩০ মিনিটে এই দৌড় শেষ হয় হিরোশিমা স্টেশনে।
ট্রেন যখন ধীরে ধীরে হিরোশিমা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঢুকল, তখন সকালের আলো আরও পরিণত হয়েছে। জানালার বাইরে শহরের পরিচিত দৃশ্য নয়, বরং এক অদ্ভুত নীরবতা যেন বাতাসে ভেসে আছে। মানুষের কোলাহল আছে বটে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা স্থিরতা অনুভব করা যায় যেন শহরটি প্রতিদিন নতুন করে জন্ম নেয়, আবারও অতীতকে বুকে ধরে রাখে।
প্ল্যাটফর্মে নামতেই প্রথম যে বিষয়টি মনে হলো, তা হলো ইতিহাসের ভার। অথচ চারপাশে দেখলে বোঝা যায় না ঝকঝকে পরিষ্কার রাস্তাঘাট, ব্যস্ত মানুষজন, আধুনিক বিল্ডিং। কিন্তু মনের ভেতর যেন এক অদৃশ্য সুর বাজে, যা বলে দেয়, এ মাটিতে সময় একদিন থমকে গিয়েছিল।
রোদে ভেজা সকালের বাতাসে হিরোশিমা যেন আমাকে নীরবে স্বাগত জানাল। মনে হলো, এ শহর শুধু ভ্রমণের গন্তব্য নয়, বরং জীবনের এক গভীর পাঠশালা। শিনকানসেনের জানালা দিয়ে যে ভোরের কবিতার যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা এখানে এসে যেন ইতিহাসের অধ্যায়ে মিলেমিশে গেল।
হিরোশিমায় পৌঁছে মনে হলো এ শুধু এক শহর নয়, বরং সময়, বেদনা আর পুনর্জন্মের এক জীবন্ত কাব্য। শহরটি আধুনিক, সাজানো-গোছানো, মানুষজন ব্যস্ত তাদের প্রতিদিনের জীবনে, কিন্তু বাতাসের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক নীরব সুর যেন প্রতিটি পাথর, প্রতিটি বৃক্ষ, প্রতিটি গলি অদেখা কোনো ইতিহাসের গল্প বলছে।
টোকিও থেকে বুলেট ট্রেনে হিরোশিমা যাত্রা শুধু কয়েকশ কিলোমিটারের পথ নয়। প্রতিটি শহর তার নিজস্ব ইতিহাস, স্বাদ, সংস্কৃতি আর গল্প নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জানালার বাইরে। মনে হয় ট্রেন কেবল গন্তব্যে পৌঁছে দেয় না, বরং পথের প্রতিটি মুহূর্তে জাপানকে নতুনভাবে চিনতে শেখায়। (চলবে)
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও ভ্রমণপিপাসু ব্যক্তিত্ব।