শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

নির্মাণ কৌশলেও ‘অনন্য’ পদ্মা সেতু

নবযুগ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:২২, ২৪ জুন ২০২২

নির্মাণ কৌশলেও ‘অনন্য’ পদ্মা সেতু

অনন্য নির্মাণ কৌশলের পদ্মা সেতু

খরস্রোতা পদ্মায় যে সেতু দুই পাড়কে বাঁধল, তার নির্মাণে সর্বোচ্চ মান নিশ্চিতের চেষ্টা আর কারিগরি চ্যালেঞ্জ সামলাতে গিয়ে বিশ্বের সামনে বেশ কিছু নজির স্থাপন করেছে বাংলাদেশ।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শামীম জেড বসুনিয়া তুলে ধরেছেন এ নির্মাণ যজ্ঞে গত ছয় বছরের অভিজ্ঞতা।

ভূ-প্রাকৃতিক কারণে পদ্মাকে ‘অদ্ভুতুড়ে’ নদী অভিহিত করে নিজেদের অর্থ এবং ব্যবস্থাপনায় ‘জটিল’ এই প্রকল্পের কাজ হওয়ায় ভবিষ্যতে বড় নির্মাণযজ্ঞ সামলানো সহজ হবে বলে মনে করেন তিনি।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বসুনিয়া জানান, ২০১৩ সালের মার্চ কিংবা এপ্রিলে এই সেতুর কাজ ৬ মাসের মধ্যে শুরু করা যাবে কি না সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন।

তিনি বলেন, “আমি একটু ঘাবড়ে যাই। আমি তখন বলি, আমার স্যার অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী যেহেতু আছেন, উনি থাকলে আমি পারব। উনি তখন স্যারকে ডাকলেন। স্যার বললেন, পারবেন। আমি স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি। স্যার বললেন, সবকিছু রেডি আছে। আমি বুঝে ফেললাম; সবকিছু রেডি আছে, শুধু টাকা নাই।”

মূল সেতু, নদী শাসন, জাজিরা সংযোগ সড়ক, মাওয়া সংযোগ সড়ক ও দুই পাড়ে সার্ভিস এরিয়া তৈরি- এই পাঁচ ভাগে সেতুর কাজ শুরু হয়।

এর মধ্যে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মূল সেতু নির্মাণ ও নদী শাসন কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।

নির্মাণ কাজে বেগ পেতে হলেও নিজেদের ব্যবস্থাপনায় কাজ করায় সক্ষমতা ও সাহস দেখানোর বড় সুযোগ পেয়েছেন জানিয়ে অধ্যাপক বসুনিয়া বলেন, “নদী শাসনে বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছিল, যা করেছে চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন।

“তাদের নামে অনেক অভিযোগ আসল। আমরা ক্রসচেক করে দেখলাম ওয়ার্ল্ড ওয়াইড নদী শাসনে তাদের অভিজ্ঞতা ভালো। তিনটা কোম্পানি বিট করল, তারা প্রথম হল। আমরা তাদেরই কাজ দিলাম।”

ঝুঁকিপূর্ণ মাওয়া ঘাটের নদী শাসন কাজ শেষ হতে আরও এক বছর লাগবে বলে জানান পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান বসুনিয়া।

এরই মধ্যে পদ্মার দুই পাশে ১৪ কিলোমিটার এলাকার তীর তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “সেতু রক্ষায় ব্যবহার করা হয়েছে ৮০০ কেজি ওজনের একেকটি জিওব্যাগ।”

“নদীর তলদেশে ঢাল তৈরির জন্য ভারতের ঝাড়খ- থেকে আনা একেকটি এক টন ওজনের পাথর ফেলা হয়েছে। নদী শাসনে ব্যয় হয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা, যা এ কাজে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল।”

বেশি বৃষ্টি হলে প্রমত্তা পদ্মায় সাধারণ নদীর তুলনায় স্রোত ও ঘনত্ব বেড়ে যায়। পলি জমে অনেক বেশি। সে কারণে নৌযান চলতে যাতে সমস্যা না হয়, সেজন্য পানি থেকে ৭০ ফুট উঁচুতে সেতু করা হয়েছে।

অধ্যাপক বসুনিয়া বলেন, “এক বছরে ২৫-৩০ ফুট পলি জমে পদ্মায়। দুই তলার সমান পলি জমে গেলে বড় নৌকা যাবে কী করে? সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”

সেতুর নিচে নদীতে ৪০টি ও দুই পাড়ে দুটি পিয়ার (খুঁটি) বসানো হয়েছে। সেতুকে টেকসই করতে নদীর অংশের খুঁটির নিচে চীন থেকে আনা তিন মিটার ব্যাসার্ধের ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত ইস্পাতের পাইল বসানো হয়েছে; যা বিশ্বের সবচেয়ে গভীর ও মোটা পাইল।

“কোনো নদীতে এত গভীরতম পাইল হয় নাই। এটা করতে আমাদের এক বছরের চেয়ে সময় বেশি লেগেছিল। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।”

পানির গভীরতা বেশি থাকায় মাওয়া অংশে পাইল বসাতে সমস্যা হওয়ার কারণে সেতুর নকশায় পরিবর্তন আনতে হয়েছে বলেও জানান এই প্রকৌশলী।

“টেকনিক্যাল ভিউ থেকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, এক জায়গায় আমরা দেখলাম পাইলের মাথায় মাটি ভালো না। মাটি একটু দুর্বল। ওই মাটির মধ্যে ক্লে আছে। হয় ক্লে লেয়ার পার করে দিতে হবে, নইলে ক্লে লেয়ারের তিন মিটার ওপরে পাইল ছাড়তে হবে। তিন মিটার উপরে ছাড়তে হলে পাইলের সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে হবে। আমরা তখন ৬টার জায়গায় ৭টা পাইলে গেলাম। জাপানের দুইজন সয়েল এক্সপার্টসহ আরও কয়েকজন দেখলাম। পরে ২২টা পিলারে ৭টা করে পাইল দেওয়া হয়েছে।”

তিনি বলেন, “পাইলগুলো করার পরে ওয়েল্ডিংয়ে কোনো ক্র্যাক আছে কিনা সেটার জন্য এক্সরে করতে হয়। সেটা করা হয়েছে। তৈরির পর গুণগত মান আবার যাচাই করা হয়েছে। কোথাও কোনো গাফিলতির স্কোপ নাই।”

কংক্রিট এবং স্টিল দিয়ে তৈরি দ্বিতল এই সেতুর নকশা করেছে এইকম, স্পেক ইন্টারন্যাশনাল, এসিই কনসালটেন্স এবং নর্থ ওয়েস্ট কনসালটেন্স লিমিটেড।

অধ্যাপক বসুনিয়া বলেন, “চীনারা কাজ পেয়ে জানাল, স্টিল দিয়ে কাজ করবে না। স্টিলের প্লেট কেটে কেটে করবে। সবকিছু চীনে হবে, সেখানে কোয়ালিটি কন্ট্রোল হবে।

“আমরা প্রথমবার উহানে গেলাম। প্লট, কোয়ালিটি দেখে সন্তুষ্ট হলাম। এসে বললাম, এখানকার ইঞ্জিনিয়ার ওখানে পাঠাতে হবে। সে ওখানে থাকবে, দেখভাল করবে।”

“ওখান থেকে প্লেটগুলো এসেছে, পাইলের প্লেটগুলো প্রথমে এসেছে। পাইলগুলো ১০ ফুট ডায়ামিটারের। প্লেটগুলো বাঁকিয়ে ওয়েল্ডিং করেছে। এই ওয়েল্ডিং বেশিরভাগই বাঙালিরা করেছে, চীনারাও ছিল।”

তিনি জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পের ৪ হাজার প্রকৌশলী, কারিগর ও টেকনিশিয়ানের মধ্যে পাঁচশ’র বেশি ছিল বাঙালি।
সেতুর সব উপকরণে সর্বোচ্চ মান নিশ্চিতের চেষ্টা করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ব্রিজটা যে বিয়ারিংয়ের ওপর বসেছে, সেটা একটা লেটেস্ট বিয়ারিং, পেন্ডুলাম বিয়ারিং।”

“আমরা চীনে এর কোয়ালিটি টেস্টে গেলাম। এসময় ফুল স্কেলে লোড দেওয়ার পরে এখানে ভূমিকম্প দেখানো হয়। অনেকখানি নড়ে আবার জায়গায় চলে আসল। বিয়ারিং খুলে দেখা হল- ভেতরে কোনো ফাটল, স্ক্র্যাচ নাই। তিনবার করা হল এমন। তারপরও আমরা সেটা আমেরিকায় পাঠিয়ে টেস্ট করাই।”

পদ্মা সেতুতে যে ধরনের বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে তা পৃথিবীর অন্য কোথাও ব্যবহার হয়নি বলে জানান শামীম জেড বসুনিয়া। এসব বিয়ারিং ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও সেতুকে টিকিয়ে রাখবে।

মাঝে বেশ কয়েকবার আলোচনায় এসেছে পদ্মা সেতুর খুঁটিতে ফেরির ধাক্কার ঘটনা। তবে পদ্মা সেতুতে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করায় এসব নিয়ে সংশয়ের কিছু নেই বলে জানান এই অধ্যাপক।

ফেরি কীভাবে পিয়ারে ধাক্কা দিয়েছে সে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “দুই পিয়ারের মাঝে পরিষ্কার সাড়ে ৪০০ ফুট জায়গা আছে। ফেরির প্রস্থ ৫০ ফুট। তাহলে ধাক্কা লাগবে কেন?

“কোণায় না লেগে যদি পেটে সরাসরি লাগত, তখন ফেরিটা উল্টে যেত। পিয়ার তো ফেরির চেয়ে ১০ গুণ শক্তিশালী। পিয়ারের কিছু হবে না।”

পদ্মা সেতুতে প্রায় ৩ লাখ টন রড, আড়াই লাখ টন সিমেন্ট, সাড়ে ৩ লাখ টন বালু, প্রায় ২ হাজার ১০০ টন বিটুমিন লেগেছে। এসব উপকরণ দেশ থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে।

দেশের সিমেন্ট এবং রডের মান আন্তর্জাতিক মানসম্মত দাবি করে অধ্যাপক বসুনিয়া বলেন, “দেশীয় যে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করেছে, তারা খুব স্মার্টলি কাজ করেছে। তাদের যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। শুধু তারা যথাযথ ইকুইপমেন্ট পাচ্ছে না।”
২০২০ সালে নদীতে ভাঙন শুরু হলে লুক্সেমবার্গ থেকে আনা ১৯২টি গার্ডারসহ অনেক নির্মাণ উপকরণ পানিতে চলে যায়।

শামীম জেড বসুনিয়া জানান, এই সেতুতে ২০টির বেশি দেশের জনবল, যন্ত্র ও উপকরণ ব্যবহার হয়েছে। সাড়ে ৩ হাজার টন ওজনের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হ্যামার এই সেতুতে ব্যবহার হয়েছে। ক্রেন ব্যবহার হয়েছে ৪ হাজার টনের।

সেতুতে ব্যবহার করা কংক্রিটের কিছু পাথর দেশ থেকে নেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগই আনা হয়েছে ভারত, ভুটান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। কংক্রিটের গুণগত মান যাচাই করে তারপর কাজ করা হয়েছে।

বিশেষ কিছু রড আনা হয়েছে চীন থেকে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাজ্য থেকে অ্যালুমিনিয়াম নেওয়া হয়েছে।

পদ্মা সেতু তৈরি হওয়ায় পুরো দেশ যেমন গর্বিত হয়েছে, তেমনি অনেকের মধ্যে কৌতূহলও রয়েছে। এই সেতু ‘জান চায়, রক্ত চায়’ এ ধরনের কথাও শুনতে হয়েছে বলে জানান ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের এই এমিরেটাস অধ্যাপক।
 

শেয়ার করুন: