রোববার, ০৫ মে ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

পরিবেশ হায়েনাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ 

ড. আবু জাফর মাহমুদ

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ২১ জুলাই ২০২৩

পরিবেশ হায়েনাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ 

ফাইল ছবি

অনেকে যেভাবে দেখে আমি সেভাবে দেখি না, দেখতে চাই না। শুধু কষ্ট  পেয়ে নিজেকে আড়াল করতে চাই না। বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে কিছুটা সময়ের জন্য নিজেকে নিবেদন করে দায়িত্ব শেষ করার তৃপ্তিও আমাকে  পেয়ে বসে না। শুধু মনে হয় যুদ্ধের কথা। যুদ্ধই যে জীবনের ব্রত, সেই জীবনে যুদ্ধের বিকল্প কিছু নেই। যে স্বপ্ন ও অঙ্গীকার নিয়ে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম, মাউন্টেন ব্যাটালিয়ানের দায়িত্ব নিয়েছিলাম, স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার মধ্য দিয়ে সে যুদ্ধের প্রথম পর্ব শেষ হয়েছিল। তারপর বায়ান্ন বছর পেরিয়েছে। যুদ্ধের সকল পর্বই অসম্পূর্ণ  রয়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময়ে বেদনা ও ক্ষোভের সাথে প্রতিমুহূর্তেই  দেখেছি আমার প্রিয় মাতৃৃভূমি শুধু ক্ষত বিক্ষত হয়েই চলেছে। প্রকৃতি, পরিবেশ বিপর্যন্ত হয়েছে। গ্রাম, শহর, নগর নির্বিশেষে মানুষের বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পৌঁছে গেছে।

গত ত্রিশ বছর আমি বাংলাদেশ থেকে দূরে। শারিরীকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী নাগরিক হয়ে উঠলেও বাংলাদেশের জীবন বাস্তবতা থেকে এক মুহূর্তও বিচ্ছিন্ন হতে পারিনি। আমার শেকড় বাংলাদেশে। পৃথিবীর এক নয়নাভিরাম প্রকৃতির কোলে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বঙ্গোপসাগরের গর্জন শুনে আমার ঘুম ভেঙেছে। প্রকৃতির অসাধারণ শীতল ছায়ায় জীবনে প্রশান্তি অনুভব করেছি। দিনে দিনে নগর সংস্কৃতি সম্প্রসারিত হতে দেখেছি। কিন্তু ওই সম্প্রসারণের সঙ্গে কোনো সমৃদ্ধশীল পরিকল্পনার অভাবে সবখানে আজ এক বিপন্ন দশা দেখছি। আমাদের রাজনীতি, ক্ষমতার পালাবদল ও জনজীবনের দুর্দশার মতোই পরিবেশ প্রকৃতিও আজ এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। আমরা যখন ক্ষমতা ও রাজনীতির সঙ্গে দখল ও লোপাটের প্রতিযোগিতা দেখতে পাই, একইভাবে দুবৃত্ত কবলিত হয়েছে পরিবেশ ও প্রকৃতি। বাংলাদেশের নদীনালা খালবিল তো বটেই বঙ্গোপসাগরও এই দুর্দশা  থেকে মুক্ত নেই।

আজকের পৃথিবী জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সংকটে।  বৈরী জলবায়ুর অভিঘাত থেকে কেউই মুক্ত নয়। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষসৃষ্ট সংকটগুলো আমাদের দেশকে বেশি বিপন্ন করে তুলেছে। ষড়ঋতুর বাংলাদেশের ভূমিরূপ পাল্টে দিচ্ছে এক শ্রেনীর লুটেরা ও ঘাতকেরা। সকল পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় কাটার মহোৎসব চলছে। ক্ষমতার ছায়ায় একটি শ্রেনী একদিকে পাহাড় কেটে ভবন, রাস্তা নির্মাণ থেকে শুরু করে মাটির ব্যবসা পর্যন্ত করছে। আরেকটি শ্রেনী পাহাড়ের পাদদেশে প্রাচীনকাল থেকে বসবাসকারীদের উচ্ছ্বেদ করে পাহাড়ের সর্বশেষটুকু  গিলে খাবার পথ করে চলেছে। একই গতিতে শহর নগরের পানি নিষ্কাশনের খাল ও জলাশয় ভরাট  করা গেছে। নালা নর্দমাগুলোর আবর্জনা অপসারণ না করতে করতে সেগুলোও এখন রাস্তা ও সমতল ভূমির সঙ্গে একাকার। যত্রতত্র দখল ও অবৈধ স্থাপনা প্রতিটি শহরের পানি নিষ্কাশনের পথগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে। দেশের অধিকাংশ শহরের  ভেতর দিয়ে প্রবাহমান নদীর শাখা, প্রশাখা ও ক্যানেলগুলিও ভরাট করে  ফেলা হয়েছে। এখন বাংলাদেশের যেকোনো শহরই সামান্য বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়। মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ে। জলাবদ্ধতায় সড়ক অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সব মৌসুমেই শুধু মানুষ সৃষ্ট কারণে দুর্ভোগ, দুর্দশা ও জানমালের ক্ষতি অবধারিত হয়ে উঠেছে।

আমরা বঙ্গোপসাগর নিয়ে অনেক বড়াই করি। এই সাগর-পাড়ের সন্তান বলেই বলতে পারি, আমরা বিপুল সম্পদে ভরপুর সাগরের মর্যাদা দিতে জানি না। সাগর থেকে পরিকল্পিতভাবে মাছসহ অন্যান্য সম্পদ আহরণ করতে যেমন পারি না, একইভাবে সাগরের পানিকে দুষণমুক্ত রাখতেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছি। বঙ্গোপসাগর থেকে মৎস্য আহরণের নামে হাজারো মাছ ও জলজ প্রাণির রেনুপোনা ধংস করে চলেছি। এগুলো নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা শুনেছি। বিজ্ঞানীরা সেমিনার করেন, নীতি নির্ধারকরা অনেক বড় বড় বক্তব্য রাখেন, কিন্তু কাজটি সেখানেই  থেমে থাকে।

আমাদের হাওড়াঞ্চলের পরিবেশও আগের মতো নেই। হাওড়ে প্রতিবছর ফসলহানী ঘটে। প্রতি বছর একই মৌসুমে হাওড়ের অবকাঠামো নির্মাণ বাবদ দেশের মানুষের বিপুল অংকের টাকা লোপাট করা হয়। পরিবেশ ঘাতকরা যোগসাজশ করে কাজটি করে থাকে। এর কোনো প্রতিকার  নেই। বছরের পর বছর এসব অনিয়মের বিষয়গুলো খবরে আসে। জড়িত ব্যক্তিদের সম্পর্কে জানাও যায়। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। অন্যায় আরো বাড়তে থাকে। যার পরিণতিতে পরিবেশ ও প্রকৃতির অবস্থা এখন ভয়াবহ। যা মনুষ্যবসবাসের অনুপযোগী হয়ে গেছে।  

বাংলাদেশের খোদ রাজধানী ঢাকাকে যে বুড়িগঙ্গা নদী বেষ্টন করে  রেখেছে, সে নদীর ভেতর প্রবাহিত হচ্ছে এক গাঢ় কালো অভিশাপ। ওই তরল বর্জ্যের প্রবাহ যে শহরে প্রবাহিত হয়, সেই শহরে বসেই রাষ্ট্র পরিচালনা করেন ক্ষমতাধররা। ওই শহরে বসেই মানুষকে স্বপ্ন দেখানো হয়েছে গত বায়ান্ন বছর। কিন্তু বাস্তবতায় সেই স্বপ্নগুলোর চিহ্নমাত্র  নেই।
পরিবেশ দিনকে দিন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। মানুষসহ সব প্রাণির জন্যই শ্বাসপ্রশ্বাসে বিষাক্ততা হজম করে চলতে হচ্ছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার  নেই। এখন ১ শতাংশ মানুষ যেমন ৯৯ শতাংশ মানুষের সম্পদের অধিকারকে কুক্ষিগত করে চলেছে। ওই এক শতাংশ মানুষের মধ্যেই রয়েছে ভূমি দস্যু, বন দস্যু, নদী দস্যুসহ পরিবেশের দুষমণ, হায়েনার দল। হায়েনা যেভাবে রক্তপান করতে করতে একটি প্রাণিকে তিলে তিলে হত্যা করে, এরাও তেমনি পরিবেশের ক্ষতি করতে করতে আমাদের জনজীবনকে হত্যা করছে। এরা হত্যাকারী। এরা ঘাতক।

পরিবেশ নিয়ে যারা কথা বলেন, যারা স্বপ্ন দেখান ও স্বপ্ন দেখেন, সারা পৃথিবীর পরিবেশ বিষয়ক বড় বড় সিদ্ধান্ত ও কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গণমাধ্যমে বড় বড় বক্তৃতা ছাড়েন, তাদের কেউই পরিবেশের কল্যাণে এক বিন্দু ভূমিকা রাখতে পেরেছেন কি-না আমি সন্দেহ পোষণ করি। শুরুতেই বলেছি পরিবেশের জন্য যে আন্দোলন, সে আন্দোলন প্রচলিত কথামালা আর চিন্তা প্রনয়ণের মধ্যে সীমিত রাখলে হবে না। এই আন্দোলনকে পরিণত করতে হবে প্রতিরোধের আন্দোলনে। পরিবেশ প্রকৃতির ঘাতকরা গণহত্যাকারী। এদের ভয়াল নিষ্ঠুরতা থেকে দেশ জাতিকে নিরাপদ করার শাসন জরুরি। পরিবেশের হত্যাকারী হায়েনাদের প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য চাই রাষ্ট্র, সরকার ও জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ।

বিগত পঁচিশ বছর ধরে ‘বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক’ পরিবেশ সুরক্ষা নিয়ে মানুষকে জাগ্রত করে চলেছে, এটি ধন্যবাদ পাবার দাবি রাখে। আরো যারা পরিবেশ সুরক্ষা নিয়ে কাজ করছেন তারা আরো  বেগবান হোক, তাদের জন্য শুভকামনা।  

লেখক: গ্লোবাল পিস অ্যামব্যাসেডর, প্রেসিডেন্ট, পিপল ইউনাইটেড ফর  প্রোগ্রেস ও জয় বাংলাদেশ ইনক্, প্রেসিডেন্ট এন্ড সিইও, বাংলা সিডিপ্যাপ সার্ভিসেস ও অ্যালেগ্রা হোম কেয়ার ইনক্।  
 

শেয়ার করুন: