 
										ছবি: সংগৃহীত
ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে উঠানামা করছে বিশ্ব রাজনীতির প্রতীকী নগর নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনের পারদ। আর মাত্র ৩ দিন পর অর্থ্যাৎ আগামী ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য মেয়র নির্বাচন নগরকে এমন নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে যে এটি কেবল নেতৃত্বের পরিবর্তন নয়; বরং এমন এক মঞ্চ, যেখানে ধর্ম, বর্ণ, অভিবাসন ও সব শ্রেণির বাস্তবতা মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।
দুই প্রার্থীর ক্ষমতার দ্বৈরথে ব্যাপারটা এতটাই প্রাসঙ্গিক যে, ইতিহাসের এই কঠিন বাস্তবতায় শুধু মার্কিনীদেরই নয় বরং গোটা দুনিয়াবাসীর প্রশ্ন কোমো না মামদানী, কে হ”েছন নিউইয়র্কের নতুন নগর পিতা? 
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নিউইর্য়ক সিটির মেয়র নির্বাচন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক রাজধানী সংশ্লিষ্টই নয়, বরং বৈচিত্র্য, সহাব¯’ান ও সামাজিক টানাপোড়েনেরও জীবন্ত প্রতি”ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে বিষয়টি। কারণ, এই নির্বাচনের কেন্দ্রবিন্দুতে একদিকে ৩৪ বছর বয়স্ক তরুণ প্রগ্রেসিভ নেতা জোহরান মামদানি এবং অন্যদিকে সাবেক গভর্নর এন্ড্রু কোমোও বেশ আলোচিত।
মুসলিম পিতা ও হিন্দু মাতার সন্তান, আফ্রিকার উগান্ডা থেকে আসা অভিবাসী পরিবারে জন্ম নেওয়া মামদানি দক্ষিণ এশীয় উত্তরাধিকার ও আমেরিকান বাস্তবতার এক অনন্য সংমিশ্রণ। তাঁর উত্থান ঘিরে শুরু হয়েছে নানা বিতর্ক। যদিও এর কোনো দায় তাঁর ব্যক্তিগত নয়; এটি স্রেফ জন্ম ও নিয়তির ব্যাপার।
শুধু তাই নয়, ২০২৫ সালের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিতে জোহরান মামদানি বিপুল ব্যবধানে পরাজিত করেন বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস ও সাবেক গভর্নর এন্ড্র্রু কোমোকে। তখন তার এই জয় ছিল প্রায় অপ্রত্যাশিত। কারণ প্রাইমারি ভোটে সাধারণত ভোটারদের অংশগ্রহণ কম থাকে এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের নজরও তুলনামূলক কম। কিš‘ মামদানির এই জয়ে নিউইয়র্কের রাজনৈতিক মানচিত্র নড়ে ওঠে।
মামদানির প্রাইমারি জয়ের পর থেকেই রাজনৈতিক খেলা শুরু হয়। “একজন মুসলমানের সন্তান” এবং “একজন ভারতীয় হিন্দুর গর্ভজাত” এই পরিচয়কে ব্যবহার করা হ”েছ দুই প্রান্ত থেকে। 
সুত্রগুলো জানায়, একপক্ষে রক্ষণশীল ও কট্টরপš’ীরা বলছেন, তিনি মুসলিম স্বার্থে রাজনীতি করছেন। অন্যদিকে কিছু ভারতীয় ও বাংলাদেশি হিন্দু গোষ্ঠী তাঁকে বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন এই যুক্তিতে যে, “তিনি মুসলমান।”
অদ্ভুতভাবে একই সময়ে কিছু বাংলাদেশি মুসলিম গোষ্ঠীও তাঁর বিরোধিতা করছে। কারণ তাঁর মা একজন ভারতীয় বিখ্যাত চল”িচত্র নির্মাতা মীরা নায়ার, যে একজন হিন্দুও বটে। এই দ্বৈত প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করছে ধর্মীয় বিভাজন নিউইয়র্কের রাজনীতিতেও কত গভীরে প্রোথিত।
প্রাইমারিতে পরাজয়ের পর কোমো স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র রেসে থাকছেন। তিনি একসময় নিউইয়র্কের গভর্নর ছিলেন, কিš‘ যৌন হয়রানি সংক্রান্ত কেলেঙ্কারির কারণে পদত্যাগে বাধ্য হন। এবার তাঁর লক্ষ্য প্রতিশোধ ও প্রত্যাবর্তন।
বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস নির্বাচনে না দাঁড়িয়ে কোমোকে সমর্থন দিয়েছেন। ফলে নিউইয়র্কের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একই দলের (ডেমোক্র্যাট) দুই প্রার্থী মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এতে করে রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া কার্যত প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছেন, আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ হয়েছে ডেমোক্র্যাটদের ভেতরেই।
এবারের নির্বাচনে আগাম ভোট (বধৎষু াড়ঃরহম) অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে। প্রথম দিনেই ভোট পড়েছে ৭৯,৪০৯টি, যা ২০২১ সালের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি। দুই দিনের শেষে মোট ভোটের সংখ্যা ১,৬৪,০০০-এর বেশি। এটি স্পষ্ট করে যে, এবার নিউইয়র্কবাসী তাদের শহরের ভবিষ্যৎ নিয়ে আগের চেয়ে অভূতপূর্বভাবে সক্রিয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, “মানুষ এবার ভোট দি”েছ কেবল পরিচয় নয়, নীতির প্রশ্নে।” 
নিউইয়র্ক সিটিতে বসবাসরত বাংলাদেশি ও মুসলিম সম্প্রদায় এবারের নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা নি”েছ। কুইন্স, জ্যাকসন হাইটস, ব্রুকলিন ও ব্রঙ্কসে মুসলিম ভোটারদের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। “গঁংষরস উবসড়পৎধঃরপ ঈষঁন ড়ভ ঘবি ণড়ৎশ” এবং “গঁংষরস অসবৎরপধহং ভড়ৎ গধসফধহর” নামের দুটি সংগঠন ভোটার সচেতনতা, ভাষাগত সহায়তা ও “উড়ড়ৎ-ঃড়-উড়ড়ৎ” প্রচারণা চালা”েছ।
বাংলাদেশি ভোটারদের অংশগ্রহণও বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। ¯’ানীয় মসজিদ, দোকানপাট ও কমিউনিটি সেন্টারে ভোটার নিবন্ধন ও প্রচারণা কার্যক্রম চলছে। তাদের প্রধান ইস্যু বাস¯’ান সাশ্রয়, রেন্ট নিয়ন্ত্রণ, ন্যায্য মজুরি ও অভিবাসী সেবা। এই বাস্তব জীবনের ইস্যুগুলোর কারণে মামদানি তাঁদের কাছে “আশার প্রার্থী” হয়ে উঠেছেন।
জোহরান মামদানির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন মার্কিন রাজনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী প্রগ্রেসিভ নেতারা। মার্কিন সিনেটর ও প্রগ্রেসিভ রাজনীতির প্রধান মুখ বার্নি স্যান্ডার্স, যিনি “ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিজম”-এর ধারক-বাহক হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত। তিনি মামদানির প্রচারণাকে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন “গধসফধহর ৎবঢ়ৎবংবহঃং ঃযব পড়হংপরবহপব ড়ভ ড়িৎশরহম ঘবি ণড়ৎশ.”
এছাড়া নিউইয়র্কের ১৪তম কংগ্রেশনাল ডিস্ট্রিক্টের প্রতিনিধি ও মার্কিন কংগ্রেসওমেন আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কোর্তেজ (অঙঈ) মামদানির সঙ্গে একাধিক র্যালিতে মঞ্চ ভাগ করেছেন।
মার্কিন কংগ্রেসের হাউস মাইনরিটি লিডার হাকিম জেফ্রিজ, নিউইয়র্ক রাজ্যের গভর্নর ক্যাথি হোকুল, এবং প্রগ্রেসিভ নীতিনির্ভর রাজনৈতিক সংগঠন ডড়ৎশরহম ঋধসরষরবং চধৎঃু (ডঋচ)  সবাই প্রকাশ্যে মামদানির আনুষ্ঠানিক সমর্থন ঘোষণা করেছেন।
অন্যদিকে, মার্কিন সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা চাক শুমার (ঈযঁপশ ঝপযঁসবৎ) এখনো প্রকাশ্যে কোনো বিবৃতি দেননি, তবে ডেমোক্র্যাটিক সূত্রগুলো জানা”েছ যে, তাঁর সমর্থনও “সময়ের ব্যাপার।”
এই সব উ”চপর্যায়ের সমর্থনের ফলে জোহরান মামদানি এখন কেবল একজন প্রার্থী নন; তিনি হয়ে উঠেছেন প্রগ্রেসিভ ব্লকের ঐক্যের প্রতীক।
রোববার নিউইয়র্কবাসী প্রত্যক্ষ করেছে স্মরণকালের অন্যতম বড় রাজনৈতিক শোডাউন। কুইন্সের ঋড়ৎবংঃ ঐরষষং ঝঃধফরঁস-এ মামদানির সমর্থনে প্রায় ২০ হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন (অফিশিয়াল হিসেবে ১০–১৪ হাজার)। মঞ্চে উপ¯ি’ত ছিলেন স্যান্ডার্স, অঙঈ, হোকুল ও জেফ্রিজয়া ডেমোক্র্যাটিক রাজনীতিতে বিরল ঐক্যের ইঙ্গিত। র্যালির মূল স্লোগান ছিল ‘ঘণঈ ওং ঘড়ঃ ঋড়ৎ ঝধষব’. এই বার্তা দিয়ে মামদানি তরুণ ভোটারদের মন জয় করেছেন।
নিউইয়র্কের মতো বহু জাতি-গোষ্ঠীর শহরে ধর্মীয় পরিচয় সাধারণত প্রাধান্য পায় না। কিš‘ এবার ব্যতিক্রম। কট্টরপš’ীরা মামদানির ধর্ম ও বংশধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। তারা বলেন, “একজন মুসলিম ও হিন্দুর সন্তান কি এই শহরের নেতৃত্বের উপযুক্ত?” অন্যদিকে, উদারপš’ীরা বলছেন, “যে শহর বৈচিত্র্যের প্রতীক, সেখানে এই প্রশ্নটিই অপ্রাসঙ্গিক।”
রাজনীতিবিদ ও পর্যবেক্ষকদের মতে, মামদানির নীতি-ভিত্তিক রাজনীতি তাঁকে আঘাতের মধ্যেও এগিয়ে রাখছে। তাঁর অব¯’ান ফিলিস্তিনের মানবিক সহায়তা, খএইঞছ অধিকারের সমর্থন, ও শ্রমিক অধিকারের পক্ষে। তাঁকে একদিকে মুসলিম তরুণদের কাছে সাহসী নেতা, অন্যদিকে রক্ষণশীলদের চোখে বিতর্কিত করে তুলেছে।
সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, মামদানি ৬৮ শতাংশ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন কুওমোর তুলনায়। তবে পার্থক্য দ্রুত কমছে। অ্যান্ড্রু কুওমো তাঁর প্রচারণায় বলছেন, “আমি ঐক্যের রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে চাই।” অন্যদিকে মামদানির বক্তব্য, “আমি এমন এক নিউ ইয়র্ক গড়তে চাই যেখানে সবাই থাকবে ধর্ম, বর্ণ বা আয়ের পার্থক্যের ঊর্ধ্বে।” রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটের এই শেষ সপ্তাহটাই নির্ধারণ করবে নিউইয়র্কের ভবিষ্যৎ।
জোহরান মামদানি এখন কেবল একজন প্রার্থী নন; তিনি এক স্পষ্ট টিমবিল্ডার, যিনি শহরের ভেতর বিভাজনের রেখা মুছে দিতে চা”েছন। তাঁর চারপাশে গড়ে উঠেছে এক জোট; যেখানে মুসলিম, বাংলাদেশি, প্রগ্রেসিভ আমেরিকান, আফ্রিকান-আমেরিকান, ইহুদি ও লাতিনো নাগরিক একত্রে কাজ করছে। যদি তিনি জয়ী হন, তবে নিউইয়র্ক ইতিহাস সৃষ্টি করবে। প্রথম মুসলিম মেয়র, দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত নাগরিকের প্রথম নগরপিতা, এবং এক ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতীকী অধ্যায় সূচিত হবে।
একজন বাংলাদেশি ক্যাবচালকের ভাষায়, “মেয়র যদি মামদানি হন, প্রথমবার মনে হবে এই শহরে আমরাও আছি।”
আগাম ভোটের রেকর্ড, প্রগ্রেসিভ ঐক্য এবং সাধারণ মানুষের আগ্রহে জোহরান মামদানির বিজয়ের আভাস ইতিমধ্যেই নিউইয়র্কের আকাশে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তবে লড়াইটা হবে সমানে সমান এবং তারা দুই জনই ইতিহাসে নতুন রথে। 
 
 
				
















