শনিবার, ০২ আগস্ট ২০২৫

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

বর্ণাঢ্য শেষ যাত্রা দেখলো নিউইয়র্কের মানুষ

দিদারুলকে ‘বীরোচিত’ অন্তিম  বিদায় এনওয়াইপিডির

নবযুগ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১৬:৪২, ১ আগস্ট ২০২৫

দিদারুলকে ‘বীরোচিত’ অন্তিম  বিদায় এনওয়াইপিডির

ছবি: সংগৃহীত

শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর চোখের জলে এক বীরকে চির বিদায় জানালো এনওয়াইপিডি এবং নিউইয়র্কের মানুষ। ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, পেশা কিংবা দল-মত সব কিছুর সীমা পেরিয়ে পুলিশ অফিসার দিদারুল ইসলামকে অন্তিম বিদায় জানানো হয়েছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে জীবন দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত দিদারুল ইসলামকে বিদায় জানাতে গিয়ে চোখের জল বিসর্জন করতেও ভুলেননি তার সহকর্মী এনওয়াইপিডির কর্মকর্তারা। 

গতকাল বহস্পতিবার দিদারুল ইসলামের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশি অধ্যুষিত ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টার জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে জানাজায় অংশ নেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ। পরে তাঁকে নিউজার্সির লোরেল গ্রোভ কবরস্থানে দাফন করা হয়। দিদারুল ইসলামকে মরণোত্তর প্রথম শ্রেণীর ডিটেকটিভ হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
জানাজা এবং দিদারুলকে শেষ বিদায় জানানোর আয়োজন দেখতে পার্কচেস্টার জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে সকাল থেকেই জড়ো হতে থাকে হাজারো মানুষ। আমেরিকার নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা পুলিশ সদস্য, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু এবং সাধারণ মানুষ সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এই বীরকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।
অশ্রু আর সম্মানে মোড়ানো ছিল অন্তিম যাত্রা। বৃহস্পতিবার দিনটি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য যেমন ছিল শোকের, তেমনি গর্বেরও। ঝড়-বৃষ্টি আর বন্যার সতর্কতা উপক্ষো করে ভয়াবহ বন্দুক হামলায় নিহত দিদারুল ইসলামের জানাজায় উপস্থিত হয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। শুধু নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগেরই ৫ হাজার সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেরই কণ্ঠে ছিল দিদারুলের আত্মত্যাগের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা। 
জানাজা শেষে দিদারুলের মরদেহ দাফনের উদ্দেশে নেয়া হলে রাস্তার ধারে হাজার হাজার পুলিশ সদস্য তাঁকে শেষবারের মতো স্যালুট জানায়। আকাশ পথেও হেলিকপ্টারে দেওয়া হয় গার্ড অব অনার। দিদারুলের শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতায় ছিলেন নিউইয়র্কের গভর্নর, সিটি মেয়র, পুলিশ কমিশনার, আইন প্রণেতা-সহ বিভিন্ন কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং আসন্ন মেয়র নির্বাচনের প্রার্থীরা। তাদের বক্তব্যে বারবার উচ্চারিত হয়েছে বাংলাদেশের নাম। 
জানাজার নামাজের আগে বক্তব্য দেন নিউইয়র্ক স্টেটের গভর্নর ক্যাথি হকুল, সিটি মেয়র এরিক অ্যাডামস, পুলিশ কমিশনার জেসিকা টিশ, প্রিসিনকটের কমান্ডিং অফিসার আশরাফ জাহাঙ্গীরসহ অন্যান্য প্রশাসনিক ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। তারা বারবার উচ্চারণ করেছেন বাংলাদেশের নাম, স্মরণ করেছেন দিদারুলের উৎস, তাঁর শিকড়। বক্তারা দিদারুলের স্ত্রী ও সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের নাম বলে তাদের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানান। 
মসজিদ প্রাঙ্গণে কান্না ছড়িয়ে পড়ে যখন উঠে আসে দিদারুলের বাবা-মা, বিধবা স্ত্রী, তাঁর দুই শিশু সন্তান এবং গর্ভে থাকা অনাগত সন্তানের প্রসঙ্গ। বুকফাটা আর্তনাদে ভেঙে পড়েন অনেকেই। জানাজা পড়ান পার্কচেস্টার জামে মসজিদের ইমাম ডা. জাকির আহমেদ।
মেয়র এরিক এডামস বলেন, একজন মানুষের কোটি মাইল পাড়ি দিয়ে, এক অটোমেটিক অস্ত্র নিয়ে এসে নিরপরাধ প্রাণ নিয়ে যাওয়ার এই ঘটনা আমাকে বারবার প্রশ্ন কওে আমরা আরও কী করতে পারতাম?  
পুলিশ কমিশনার জেসিকা টিশ বলেন,“দিদারুল আমাদের জন্য যা করছিলেন, সেটাই তাঁর কর্তব্য ছিল। জীবনকে বাজি রেখে তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন। নিজের জীবনের বিনিময়ে অন্যদের রক্ষা করেছেন। তিনি যেমন দায়িত্ববান ছিলেন, তেমনই ছিলেন এক নিঃস্বার্থ বীর।”
জানাজার পরে, পতাকা মোড়ানো কফিনটি যখন বাইরে আনা হয়, তখন হঠাৎ করেই আকাশ ভেঙে নামে বৃষ্টি। যেন প্রকৃতিও কাঁদছিল একজন সৎ, নিষ্ঠাবান পুলিশ অফিসারের বিদায়ে। পুলিশের গাড়ির বহর, আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী, সাধারণ মানুষ সবাই মিলিত হন দিদারুলের শেষ যাত্রায়। ব্রংঙ্কস থেকে নিউ জার্সির টোটোয়া অব্দি চলে এই অন্তিম শোভাযাত্রা। 
দিদারুল ইসলামই হলেন নিউইয়র্ক পুলিশের ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশি-আমেরিকান, যিনি লাইনে অফ ডিউটিতে শহীদ হলেন। মৌলভীবাজারের বড়লেখা থেকে আসা এক তরুণ, মাত্র বিশ বছর বয়সে পাড়ি জমিয়েছিলেন স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়। ২০১৯ সালে স্কুল সেফটি এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করে মাত্র চার বছরেই হয়ে উঠেছিলেন নিউইয়র্ক পুলিশের অন্যতম উদীয়মান সদস্য।
সন্ত্রাসীর গুলিতে নিহত নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট-এনওয়াইপিডির কর্মকর্তা দিদারুল ইসলামের জানাজায় যোগ দিয়ে নিউইয়র্কের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে জীবন দিয়ে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
দিদারুলের পরিবারকে সব ধরনের সহযোগিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাকে মরণোত্তর ডিডেকটিভ ফার্স্ট গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়ার ঘোষণা দেয় এনওয়াইপিডি। জানাজায় যোগ দিয়ে সবার কাছে দোয়া চান দিদারুলের স্ত্রী।
ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টার জামে মসজিদে জোহরের নামাজের পর দিদারুল ইসলামের জানাজায় নেমে আসে শোকের ছায়া। মসজিদের ভেতর অনুষ্ঠিত জানাজায় ইমামতি করেন ড. জাকির আহমেদ।
দীর্ঘদিন যে মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়তেন এ পুলিশ কর্মকর্তা, সেখানেই অনুষ্ঠিত হয় তার শেষ নামাজ।
মসজিদের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এ জানাজায় যোগ দিতে নিউইয়র্ক সিটির বাইরে থেকেও আসেন অনেকেই।
ওই সময় দিদারুলের বৃদ্ধ বাবাকে সমবেদনা জানান গভর্নর ক্যাথি হোকুল।
জানাজা পূর্ববর্তী বক্তৃতায় তিনি বলেন, বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে আজ যে শোক বিরাজ করছে, তা তার আরেক পরিবার এনওয়াইপিডির সদস্যদের মধ্যেও কাজ করছে।
মেয়র এরিক অ্যাডামস দিদারুলের পরিবারের সদস্যদের সবসময় সহায়তা করার আশ্বাস দেন।
বক্তৃতা দেওয়ার সময় চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি এনওয়াইপিডি কমিশনার জেসিকা টিশ। তিনি বলেন, নিজের জীবন দিয়ে শুধু মানুষের নিরাপত্তা নয়, নিজের দুই সন্তান ও অনাগত সন্তানের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিও দিয়ে গেলেন দিদারুল।
গত সোমবার সন্ধ্যায় ম্যানহাটানের পার্ক অ্যাভিনিউয়ের সেই ভয়াবহ হামলায় বন্দুকধারীর প্রথম শিকার হন অফিসার দিদারুল ইসলাম। তিনি বিভাগ-অনুমোদিত একটি প্রাইভেট নিরাপত্তা দায়িত্বে ছিলেন, ইউনিফর্ম পরে কাজ করছিলেন ঠিক তখনই ঘটে নারকীয় হামলা।
হামলাকারী ২৭ বছরের শ্যেন ডেভন তামুরা নিজেও আত্মহত্যা করে। গান ভায়োল্যান্স আর্কাইভের তথ্য অনুসারে, এবছর এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ২৫৪টি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন শত শত মানুষ।
 

শেয়ার করুন: