বয়সের লাগাম থাকুক নিজের হাতে
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন-‘বার্ধক্যকে সব সময় বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না। বহু যুবককে দেখিয়াছি যাহাদের যৌবনের উর্দির নিচে বার্ধক্যের কঙ্কাল মূর্তি। আবার বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি যাঁহাদের বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘলুপ্ত সূর্যের মতো প্রদীপ্ত যৌবন’।
ঘড়ির কাঁটার মত বয়সের কাঁটা যতই সামনে এগিয়ে যাক মন ও শরীরটাকে সুস্থ রাখুন। বয়স যতই বাড়–ক চিন্তা ভাবনায় পজিটিভ থাকুন। বয়সের ভারে শরীরটা একটু আধটু এদিক ওদিক হতেই পারে। তেমন সিরিয়াস না হলে বেশি ভাবতে যাবেন না। মনে মনে বলুন- ও কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে।
মনে রাখবেন শরীরের মত মনেরও খোরাকি দরকার। আর মনের খোরাক মনের মতো মানুষ। যদি পান, পুরোপুরি সুস্থ্য থাকবেন, বিশ্বাস করুন। মনের মানুষের সঙ্গে সুখ, দুঃখ ভাগ করে নিন। প্রত্যেক মুহুর্তটাকে উপভোগ করুন।
বয়স হয়েছে আর পারছি না’, শরীরে কুলোয়না -এ জাতীয় কথাগুলো যাদুঘরে পাঠিয়ে দিন। শরীর সচল রাখতে কিছু না কিছু করুন। যোগব্যায়াম, হাঁটা, সাঁতার... যে কোন একটা বেছে নিন। মনে রাখবেন বয়স বাড়লে শারিরীকভাবে ফিট থাকাটা কিন্তু জরুরি। আর এজন্য রোজকার নিজের কাজ নিজেই করার চেষ্টা করুন। তাতে শরীরের মুভমেন্ট হবে। তবে বয়সজনিত কোনও সমস্যা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
শুধু শরীর নয় একই সাথে আপনাকে মনের যতœও করতে হবে। চাকরি হারিয়েছেন? প্রিয়জন জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে? তারপরও হতাশা বর্জন করে জীবনের দিকে ঘুরে দাঁড়ান। ব্যস্ত জীবন হলেও সময় বের করে নিজেকে একটু সময় দিন।
শরীর ও মন ভালো রাখতে কিছু পরামর্শ-
সুগার-ফ্রি বাঁচুন:
চা-কফি বা অন্য কোনও পানীয়, চেষ্টা করুন চিনি ছাড়া খাওয়ার অভ্যাসটা রপ্ত করে নেওয়ার। তাতেই দেখবেন আপনার চেহারায় বয়সের ছাপ কম পড়বে। ত্বক বিশেষজ্ঞেরা বলেন, অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার যারা খেতে ভালবাসেন, তাদের চেহারায় বয়সের ছাপ তাড়াতাড়ি পড়ে। কারণ, চিনি শরীরে প্রবেশের পর ত্বকের স্বাভাবিক দুটো প্রোটিনের (কোলাজেন এবং ইলাস্টিন) কার্যপ্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। এই দুটি প্রোটিন স্বাভাবিক বয়স প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। ফলে অতিরিক্ত মিষ্টি খেলে শরীরে বয়সের ছাপ পড়ে তাড়াতাড়ি।
শরীরচর্চা করুন নিয়মিত:
সকালে ঘুম থেকে উঠে হালকা কিছু খেয়ে সম্ভব হলে সোজা চলে যান জিমে। ইন্সট্রাক্টরের পরামর্শমত কিছু ব্যায়াম করুন। মনে রাখবেন, শরীরচর্চার অর্থ কিন্তু শুধু বডিবিল্ডিং নয়। ব্যায়াম কিংবা যোগাসন যা-ই করবেন, নিজের বয়সের দিকে খেয়াল রেখে তবেই করুন।
জিমে আপনার পাশের মানুষটি হেভিওয়েট ট্রেনিং করছেন বলে আপনাকেও সেটা করতে হবে- এমনটা কিন্তু নয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে হালকা শরীরচর্চা করলে শরীর-মন দুইই ভাল থাকবে। যার প্রভাব পড়বে চেহারায়। জিমে যেতে না চাইলে, সকালের শান্ত পরিবেশে বাড়ির পাশের পার্কে গিয়ে একটু হাঁটুন বা সম্ভব হলে কয়েক চক্কর দৌড়েও নিতে পারেন। মনে রাখবেন, মানসিক সুস্থতার জন্য শারীরচর্চার বিকল্প নেই। নিয়মিত ব্যায়াম করলে হরমোনের নিঃসরণ মন ভাল রাখতে সাহায্য করে।
ফাস্টফুডকে বিদায় জানান:
যে কোনও রকমের ফাস্টফুডকে খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিন। তার বদলে খান টাটকা শাক-সবজি। চেষ্টা করুন সেদ্ধ করা খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়ার। প্রয়োজন মনে করলে কোনও ডায়েটিশিয়ানের কাছ থেকে ডায়েট চার্ট বানিয়ে নিতে পারেন।
সঠিক খাদ্যাভ্যাস অভ্যাস করুন:
বয়স বাড়ার বিষয়টি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও সবাই চান নিজের ত্বকের বয়সটা ধরে রাখতে। সঠিক খাদ্যাভ্যাসই পারে ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে। এজন্য আপনার খাদ্য তালিকায় যুক্ত করতে হবে ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার। সবুজ মটর, সোয়া বীজ, ফুলকপি, আখরোট, বাদাম, স্যামন মাছ ইত্যাদিতে প্রচুর ভিটামিন বি-৭ রয়েছে, যা ত্বকের নানা সমস্যা বিশেষ করে অ্যাকজিমা, সেব্রিরিয়া ডার্মাটাইটিস প্রতিরোধে সহায়তা করে। ফলে ত্বক হয় কোমল ও উজ্জ্বল।
গ্রীণ টি পান করুন:
গ্রিন টি দীর্ঘায়ু করতে সাহায্য করে। নিয়মিত গ্রিন টি পান করলে আলঝেইমার এবং পারকিনসন রোগ কম হয়। ক্যান্সার প্রতিরোধে এবং হার্ট ভালো রাখতে গ্রিন টি অতুলনীয়। এ ছাড়াও চা, কফি বা অন্য কোনো পানীয় পানের ক্ষেত্রে চিনি ছাড়া খাওয়ার অভ্যাসটা রপ্ত করে নিন। তাতেই দেখবেন আপনার চেহারায় বয়সের ছাপ কম পড়বে। কারণ অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবারের ফলে চেহারায় বয়সের ছাপ তাড়াতাড়ি পড়ে।
রসুনের ব্যবহার:
রসুনের মধ্যে রয়েছে এলিসিন নামক অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। অ্যান্টি অক্সিডেন্ট বলিরেখা কমাতে এবং অকাল বার্ধক্য রোধে সহায়তা করে। এ ছাড়াও কাঁচা রসুনও খুব উপকারী। তাই নিয়ম করে রসুন খেতে পারেন।
পরিমিত ঘুম:
অকাল বার্ধক্য রোধ করে তারুণ্য ধরে রাখতে পরিমিত ঘুমের বিকল্প হয় না। দৈনিক অন্তত সাত-আট ঘণ্টা টানা ঘুম শরীরকে সতেজ করার সঙ্গে মনকেও প্রফুল্ল করে। তাই রাত গভীর হওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করুন।
ভ্রমণ করুন মাঝে মাঝে:
শরীরের বয়সটা কয়েকটা সংখ্যা ছাড়া কিছুই নয়। মনের বয়সটাই আসল! তাই মনের দিক থেকে তরুণ থাকার জন্য চেষ্টা করুন অল্প বয়সীদের সঙ্গে মেলামেশা করার। আর বার্ধক্যকে কাছে ঘেঁষতে দিতে না চাইলে ঘুরতে বেরিয়ে পড়–ন। বছরে অন্তত দু’বার বেড়াতে যাওয়ার জন্য সময় বের করে রাখুন। মনকে তারুণ্যদীপ্ত রাখতে প্রকৃতির ছোঁয়া অসাধারণ ভূমিকা পালন করে।
সময় পেলেই বই পড়–ন:
বইয়ের জগতে ডুব দিলে, মনটা অন্য দিকে ঘুরবে। ফিকশন, রান্নার বই, হাল্কা ম্যাগাজিন, কবিতা- যা ভাল লাগে পড়তে পারেন। বই পড়ার অভ্যেস মস্তিষ্কের কোষগুলিকে উজ্জীবিত করে। মনঃসংযোগ, সৃষ্টিশীলতার অনুশীলন হয়। এ সবই মনের ভাল গুণ বা শক্তি। সেই মনের জোরই বিষাদকে আপনা হতেই ঠেলে সরিয়ে দেবে। শান্ত মনে কাজও ভাল হয়।
মন ভাল না থাকলে সাজগোজের ইচ্ছে হয় না। বিষয়টাকে উল্টে দিন। বাড়িতে একটা সুন্দর পোশাক পরুন। শীতে পা ফাটছে কি না, খেয়াল রাখুন। পেডিকিউর কিট আনিয়ে বাথসল্ট দিয়ে পা ঘষে পরিষ্কার করুন। রোজকার জীবন যাপনে বৈচিত্র রাখুন। নতুন বেডশিট পাতুন বা কার্পেটটা বদলে ফেলুন। গাছের টব রং করে দেখুন, এইটুকুতেও মন কতখানি উজ্জ্বল হয়! এ সব কাজে শরীরও সচল এবং সুস্থ থাকবে।
গান শুনুন। মন মুহূর্তে ঝলমলে হবে। বয়স্কদের প্রেশার, সুগার ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে আছে কি না খেয়াল রাখুন। আপৎকালীন ব্যবস্থা, ওষুধের দোকানের নম্বর হাতের কাছে রাখুন।
অনেকদিন আগে চ্যানেল আইয়ে একটা অনুষ্ঠান দেখেছিলাম। নাম সম্ভবত- তারকা কথন। গেস্ট ছিলেন শিল্পি মুস্তাফা মনোয়ার। তিনি বলেছিলেন -‘মনের বয়সটাই আসল। বয়সটা দুই রকম, একটা অঙ্কের ব্যাপার, আরেকটা মনের তৃপ্তির ব্যাপার। পৃথিবীকে দেখার ব্যাপার, পৃথিবীকে ভালোবাসার ব্যাপার। সেইখানে বয়স বাড়ে না।’