শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

মসজিদে এসি ও শাক দিয়ে মাছ ঢাকা তত্ত্ব  

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ২০:১৮, ২৪ জুলাই ২০২২

মসজিদে এসি ও শাক দিয়ে মাছ ঢাকা তত্ত্ব  

মসজিদে এসি ও শাক দিয়ে মাছ ঢাকা তত্ত্ব

শ্রীলঙ্কায় যখন রাবনরা বদ হচ্ছে তখন বাংলাদেশে চলছে নানান খেলা। এই খেলায় যতটা না সরকার-বিরোধী রাজনীতিকরা জড়িত তার চেয়ে বেশি জড়িয়ে পড়েছে সাধারণ জনগণ। ঈদুল আযহার আগে পদ্মা সেতু নিয়ে এক ধরণের উত্তাপ ছিলো। সেই উত্তাপ এখন শ্রাবন মাসে গড়িয়েছে সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে। ঋতু নির্বাসনের এই দেশে এখন কাগজে-কলমে কিংবা প্রবাদ-প্রবচনে অঝোর ধারার শ্রাবন মাস চললেও দেশের একটি বিশাল অংশে বৃষ্টির দেখা নেই প্রায় মাস খানেক। মাঠ-ঘাট ফেটে একাকার। আমন আবাদের সময় হলেও কৃষক পানির অভাবে জমি চাষ করতে পারছে না। তার ওপর একটু পরপর লোডশেডিং।

গত বৃহস্পতিবার থেকে উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে রয়েছি। জীবনের সবচেয়ে উষ্ণতম সময় পার করছি এখানে। কোথাও শান্তি নেই, না ঘরে না বাইরে। কখনো স্বস্তি নেই, না রাতে না দিনে। এই যখন অবস্থা তখন মনের অস্বস্তিকে রীতিমত উষ্মায় পরিণত করেছে সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত। সোমবার দেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এই ঘোষণায় সারা দেশের মানুষের মধ্যে রীতিমত তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের সমালোচনা হচ্ছে। অনেকে শ্রীলঙ্কায় রাবনদের পরিণতির কথা মনে করিয়ে দিতে চাইছে। তাদের বক্তব্য লুটপাট করে দেশটাকে ফতুর করার পর সকল দায় জনগণের ওপর চাপানোর খেসারত সরকারকে একদিন না একদিন মেটাতেই হবে। 

প্রিয় পাঠক এতোক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন সরকারের কোন সিদ্ধান্তের কথা বলছি। কিংবা বিতর্কই বা কি নিয়ে? মসজিদের এসি বন্ধে সরকারের যে সিদ্ধান্ত সে বিষয়টিই বলা হচ্ছে। যদিও ওই সিদ্ধান্তের পর জনগণের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পিছু হটেছে সরকার। তারা এখন বলছে কেবল নামাজের সময় এসি চালিয়ে বাকি সময় বন্ধ রাখার কথা। কিন্তু একটি বিষয় খুব পরিষ্কার। সেটি হলো সরকার খুব ভালো করেই জানে মসজিদে কেবল নামাজের সময়ই এসি চালানো হয়। একটি নিদিৃষ্ট সময় পর মসজিদে কেউ থাকতে পারে না। কেউ চাইলেও এসি ওয়ালা মসজিদে গিয়ে দু’দন্ড ঘুমাতে পারে না। তাহলে কেন এই আইন? তাহলে কি কারনে আলাদা করে মসজিদকে টার্গেট করা? তা হলে কোন প্রেশারে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো ‘কেবল নামাজের সময় এসি চালিয়ে বাকি সময় বন্ধ রাখা?

এর আগে করোনার প্রাদুর্ভাবের সময় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারের বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়েছে। সরকারী দলের অনেক সভা-সমাবেশ হয়েছে। মাস্ক বিতরণ করতে বিশাল জমায়েতের আয়োজন করা হয়েছে। এমনকি করোনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর চারপাশে একগাদা কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দেখা গেছে কোনো প্রকার স্বাস্থ্যবিধি মানা ছাড়াই। এরকম আরো অনেক কর্মকান্ড ঘটেছে যেটি করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়ানোর জন্য সহয়াক পরিবেশ বলে মনে করা হয়। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে বিধি-নিষেধ আরোপ করার সময় মসজিদকেই সবার ওপরে রাখা হয়েছে। ঈদের নামাজ ময়দানে হয়নি। মনে হয়েছে করোনার প্রাদুর্ভাব কেবল মসজিদেই ছিলো। 

এবারও বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবিলায় সরকার যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সেখানেও মসজিদকে এগিয়ে রাখা হয়েছে। সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা বলছেন, ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সঙ্গে পরামর্শ করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো- এসি কি কেবল মসজিদেই চলে? নাকি দেশে আরো অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। 

মসজিদের এসি বিতর্ক যখন চরমে তখন দৈনিক দেশ রূপান্তর নামক একটি পত্রিকার খবরে হইচই পড়ে গেছে। দৈনিকটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে সরকারের ১৩ টি ভবনেই কিভাবে এসি বিলাস চলছে। দেশের জনগণের টাকায় প্রজাতন্ত্রের যে কর্মচারীরা চলেন তাদের শরীরের উত্তাপ কমাতে কত টাকা ঢালা হচ্ছে। অথচ মসজিদের মুসুল্লীরা (যেসব মসজিদে এসি আছে) চার ওয়াক্ত (ফজরের নামাজে এসির প্রয়োজন হয় না) নামাজ একটু এসির মধ্যে পড়বে সেখানেও সরকারের নোংরামি করতে হয়। 

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’ নামক একটি টার্ম ব্যবহার করতে থাকে। যার সারকথা হলো মানুষের ভোটাধিকারের প্রয়োজন নাই। দেশের উন্নয়নই আসল। তাই যারা দেশের উন্নয়ন করবে তাদের জন্য অনেক কিছুই মাফ। তাদের ক্ষমতায় আসতে নির্বাচন, ভোট কিংবা জনসমর্থন এর কোনো কিছুই বাধ্যতামূলক নয়। এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে তারা দৃশ্যমান উন্নয়নকে প্রাধান্য দেয়। হাজার হাজার কোটি টাকার বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হয়। রাতারাতি সবার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে কাজ শুরু করা হয়। আর এইসবই ছিলো জনগণের মুখ বন্ধ করার জন্য। তারা যাতে উন্নয়নের মোহে পড়ে নাগরিক অধিকার, সুশাসন কিংবা গণতন্ত্রের কথা ভুলে যায় সেটি চেয়েছিল সরকার। হয়েছেও তাই। যে কারনে ২০১৮ সালের নির্বাচন ৩০ ডিসেম্বরের পরিবর্তে আগের দিন ২৯ ডিসেম্বরের রাতে হলেও জনগণ সেটি মেনে নিয়েছে। বিষয়টি অনেকটা এমন যে জনগণ মনে করেছে, ভোট কিভাবে হলো, কিংবা কিভাবে কে ক্ষমতায় থেকে গেলো  তার চেয়ে বড় কথা হলো দেশের উন্নয়ন হচ্ছে কি না?

বেশ কিছুদিন ধরে রাজধানীসহ দেশের সবখানে ব্যাপক লোডশেডিং চলছে। এর কোনো টাইমটেবিল নেই। এখন দেখছি সরকার তালিকা তৈরি করেছে লোডশেডিংয়ের। তবে এই তালিকা অতীতের অনেক কিছুর মতোই যে নিয়ম মেনে চলবে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কেননা সরকার ইতোপূর্বে জনসম্পৃক্ত এমন কোনো ইস্যু নেই যেখানে সফলতা দেখাতে পেরেছে। জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সবগুলো ইস্যুতেই এদেশের বুর্জোয় শ্রেণিদের জয়জয়াকার হয়েছে। এবার জনগণের প্রতিপক্ষ যেহেতু সরকার সেহেতু এখানেও যে জনগণের স্বার্থ রক্ষা হবে না সেটা বলাই বাহুল্য। আগে থেকেই যেখানে ২৪ ঘণ্টার অন্তত ১০ ঘণ্টা  লোডশেডিং চলে আসছে সেখানে নিশ্চয়ই এই নিয়ম মানা হবে না। কেননা এখানে নিয়ম মানতে গেলেই সরকারের লস। সারা দেশের গ্রামাঞ্চলের যেখানে এই অবস্থা সেখানে সরকারের নতুন এই নীতিমালা করার আসলে উদ্দেশ্য কী? 

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ক্যাপটিভ পাওয়ারসহ দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৫০.৭৫ শতাংশ বা ১১ হাজার ৩৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্যাসচালিত কেন্দ্রে উৎপাদিত হয়। ৭ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে কয়লানির্ভর কেন্দ্র থেকে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি  থেকে উৎপাদিত হয় ২২৯ মেগাওয়াট। আর এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আসে ৩৬.২ শতাংশ বা সাত হাজার ৮২২ মেগাওয়াট। ৮৬.৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনই গ্যাস ও জ্বালানি তেলনির্ভর। সরকার পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করতে না পারায় ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

শ্রীলঙ্কায় সরকারর পতনের পর দেশের অর্থনীতির বিষয়টি ফের আলোচিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারের নাজুক অবস্থার বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। রিজার্ভ তলানীতে ঠেকেছে। অবস্থার উন্নতি না হলে আমাদের দেশেও জনঅসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে এমন আশঙ্কার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এইসব আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে সাধারণ জনগণ স্বস্তিতে নেই। ওষুধ থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের বাজারের উত্তাপ বাড়ছেই। সেই উত্তাপের সঙ্গে এবার লোডশেডিংয়ের উত্তাপ যোগ হলো। এই উত্তাপকে পাশ কাটাতে সরকার  জেনে-বুঝে ইচ্ছে করেই মসজিদের এসি বিতর্ককে সামনে এনেছে। যাতে উত্তাপটা মসজিদের এসি আর মসজিদ নিয়ে যারা মাথা ঘামায় তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কি জানি একে হয়তো শাক দিয়ে মাছ ঢাকা পদ্ধতিও বলা হয়ে থাকতে পারে। যদি বিষয়টি তেমন হয় তবে এবারও জনগণ সেই উন্নয়নের গণতন্ত্র মন্ত্রে বুঁদ থাকবে। নিজের জীবন বিপন্ন করে হলেও সে গেয়ে যাবে তথাকথিত উন্নয়নের গান। এক্ষেত্রে মসজিদের এসি অচল না সচল সেটি বড় বিষয় নয়। সরকারের সুরম্য অট্টালিকায় এসি বিলাস চলছে কিনা  সেটা তার কাছে মূখ্য হয়ে দাঁড়াবে। বিদ্যুতের অভাবে নিজের ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা শিকায় উঠলো তাতে কি সরকারি ভবন, সেতু-সড়ক থেকে তো ঠিকই ঠিকরে পড়ছে বাহারি আলোর ঝর্ণা।

লেখক: সাংবাদিক ও কথাশিল্পী। 
 

শেয়ার করুন: