শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

ত্রাণ নয় বাড়ি মেরামত চায় বানবাসীরা  

সমীর কুমার দে

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২৪ জুন ২০২২

ত্রাণ নয় বাড়ি মেরামত চায় বানবাসীরা  

সিলেটের একটি আশ্রয় কেন্দ্রের সামনে খাবারের জন্য বানবাসী মানুষের দীর্ঘ লাইন

সিলেটের ভোলাগঞ্জের বর্ণি গ্রামের ৯০ বছরের বৃদ্ধা পেয়ারা বেগম ভোলাগঞ্জ রাস্তার পাশে এসেছেন ত্রাণের খাবার নিতে। তার বাড়িতে এখনো কোমরপানি। দুই বেলা খাবারের জন্যই এখন তার সংগ্রাম। ছেলেরা তাদের সংসার নিয়েই ব্যস্ত। নিজের সন্তানদের জন্য খাবারের সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছেন পেয়ারা বেগমের দুই ছেলে। তার দিকে নজর দেওয়ার সময় কই? ফলে নিজের খাবারের সন্ধান তাকেই করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে ত্রাণ নিতে এসেছেন হাফিজুন নেছা।

সত্তরোর্ধ্ব এই নারী বললেন, ঘরে এখনো হাঁটুপানি, দুর্গন্ধে থাকা যায় না। সেখানেও নেই কোনো খাবারের ব্যবস্থা। রিলিফ দেওয়া বন্ধ হলে কীভাবে চলবেন, তা নিয়েও রয়েছে তার দুশ্চিন্তা। এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকায় ত্রাণের নৌকা বা গাড়ি দেখলেই ছুটে আসছে শত শত মানুষ। দুই বেলা খাবারের জন্য তাদের প্রাণান্তকর যুদ্ধ।

সিলেটের বিভিন্ন দুর্গত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক জায়গা থেকেই পানি নামতে শুরু করেছে। অনেকেই ফিরছেন ঘরে। কিন্তু তাতেও শত বাধা। আশ্রয়কেন্দ্রে দুই বেলা খাবারের নিশ্চয়তা থাকলেও বাড়িতে ফিরে সেই নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না অনেকেই। বিপর্যস্ত বাড়িঘর কীভাবে মেরামত করবেন, তা নিয়েও চিন্তার শেষ নেই। সিলেটের সাহেবের বাজারে ত্রাণ নিতে আসা মগবুল হোসেন (৫৬) জানালেন, তার বাড়ি থেকে পানি নেমে গেছে। কিন্তু মাটি আর বাঁশ দিয়ে বানানো ঘর এখন সোজা করবেন কীভাবে? কোথাও কোনো কাজ নেই। দিন এনে দিন খেয়ে চলে তাদের সংসার। তার কাছে মনে হচ্ছে, খাবারের চেয়ে বিধ্বস্ত বাড়িঘর মেরামতেই এখন তাদের সবচেয়ে বেশি সহায়তার প্রয়োজন।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সুনামগঞ্জের বাদাঘাট হাইস্কুল মাঠ, আমবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিশ্বম্ভরপুর থানায় আশ্রয় নেওয়া মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন পুলিশপ্রধান ড. বেনজীর আহমেদ। সেখান থেকে ফিরে সিলেটের সাহেবের বাজার ও ভোলাগঞ্জে ত্রাণসহায়তা দেন তিনি। এর মধ্যে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উদ্যোগে সাহেবের বাজারে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়। ত্রাণ বিতরণ শেষে পুলিশপ্রধান বলেন, ‘আমাদের মানুষের উঠে দাঁড়াবার অদম্য শক্তি রয়েছে। আমি অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। অনেকেই আমাকে বলেছেন, ত্রাণ নয়, বরং বাড়িঘর মেরামতে তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। পুলিশ যতদূর সম্ভব মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে।’

সিলেট শহরের নিচু এলাকায় এখনো পানি আটকে রয়েছে। এসব জায়গার মানুষ শহরের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো রয়েছে। শহরের মীরাবাজারের কিশোরী মোহন (বালক) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি বিল্ডিংয়ে ১২০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। সিলেট শহরের যতনপুর এলাকা থেকে এসে দুই সন্তান নিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন ৩৮ বছরের সুফিয়া বেগম। এই নারী বলেন, ‘মাসে ৩ হাজার টাকায় একটি বস্তিঘরে থাকতাম। এখনো ঘরে হাঁটুপানি। দুর্গন্ধে ঐ এলাকায় যাওয়া যাচ্ছে না। এই আশ্রয়কেন্দ্রে তা-ও কিছু খাবার পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু বাড়ি ফিরলে আমরা কী খাব? আমার স্বামী একটি সবজির দোকানে কাজ করতেন। মালিকের সব সবজি পচে গেছে। এখনো দোকান চালু হয়নি। এখান থেকে এখন চলে যেতে বলছে, আমরা কোথায় যাব? সন্তান দুটিকে নিয়ে কীভাবে বাঁচবো?’ একই আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন ৭৬ বছরের ইসমাইল শেখ। খাঁপাড়া থেকে তিনি এসেছেন। সন্তানেরা খাবারের সন্ধানে বের হয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রের বিছানায় শুয়ে আছেন তিনি। দুই ছেলে কীভাবে আবার ঘর নির্মাণ করবেন, টাকা পাবেন কোথায় এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে সময় যাচ্ছে ইসমাইল শেখের। কিন্তু কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না।

শাহজালাল জায়েয়া ইসলামিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের আশ্রয় কেন্দ্রেও ঠাঁই হয়েছে ১৫০ পরিবারের। এখানকার অধিকাংশ মানুষ এসেছে যতনপুর থেকেই। ৪৬ বছরের আয়েশা খাতুন বললেন, ছয় জনের সংসার তাদের। এক ছেলে কাজের উপযোগী। সকালেই তিনি বের হয়েছেন কাজের সন্ধানে। তার কাছে মনে হয়েছে, যে খাবার পাচ্ছেন, তাতে কোনোভাবে চলে যাচ্ছে। কিন্তু ছেলের দুইটা বাচ্চা নিয়ে মহাসংকটে পড়েছেন তিনি। নিজেরা ভাত-খিচুড়ি যা খাচ্ছেন, এক বছর বয়সি বাচ্চাকেও তা-ই খাওয়াতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কেউ বাচ্চাদের কোনো খাবার দেয়নি। হাতেও কোনো টাকা নেই যে, বাচ্চাদের জন্য কিছু কিনবেন। তিনি বলেন, এই আশ্রয়কেন্দ্রে অন্তত ৫০টি বাচ্চা আছে। তাদের সবারই খাওয়ার কষ্ট হচ্ছে।

সিলেটের ভোলাগঞ্জের অধিকাংশ বাড়িতে এখনো পানি। বর্তমানে বন্যার পানি কিছুটা কমলেও ঘরে খাবার নেই, বাইরে কাজ নেই। বেশির ভাগ দোকানপাট এখনো খুলতে পারেননি দোকানিরা। এ অবস্থায় জেলার বেশির ভাগ এলাকায় খাদ্যের সংকট দেখা গেছে। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সবাই মহাবিপদে পড়েছেন। নৌযান দেখলেই ত্রাণের আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন নারী, পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধরা। বর্ণি গ্রামের রফিকুল মোড়ল বললেন, ‘এক প্যাকেট ত্রাণ পাওয়ার আশায় সকাল থেকে রাস্তার পাশে বসে আছি। নৌকা গেলেই ডাকছি। গাড়ি আসলেই থামার সংকেত দিচ্ছি। কিন্তু কেউ ত্রাণ দিচ্ছে না।’

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার নিশারুল আরিফ বলেন, ‘এখনো শহরের মধ্যে অনেকগুলো আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। অনেক জায়গার পানি নামলেও নিচু এলাকাগুলোতে এখনো পানি আছে। ফলে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নিয়মিত খাবার দেওয়া হচ্ছে। পুলিশের পক্ষ থেকে যা যা করা সম্ভব, আমরা তার সবকিছুই করছি।’
 

শেয়ার করুন: