সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

 প্রতিষ্ঠান ‘জবরদখল’র অভিযোগ

বাংলাদেশে আমরা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে : ড. ইউনূস

ঢাকা অফিস

প্রকাশিত: ০২:৪১, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বাংলাদেশে আমরা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে : ড. ইউনূস

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে নিজেদের প্রতিষ্ঠান ‘জবরদখল’ হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জীবনে সবচেয়ে ‘ভয়ঙ্কর’ পরিস্থিতিতে পড়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘আমার বাড়িতে এসে একজন বলল, এটা আমার বাড়ি, আপনি চলে যান।’’
কেন চলে যাব? কারণ হিসেবে তারা বলল, এটা আমার বাবার সম্পত্তি ছিল। তোমরা দখল করে ফেলেছ। এভাবে কী দখল হয়, দেশে আইন আদালত আছে না? আইন আদালত এখন কোথায় গেল?”

মিরপুরের চিড়িয়াখানা রোড়ে অবস্থিত টেলিকম ভবনের নিচতলায় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘‘গত চারদিন ধরে এখানে অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করছে। আজ আমাদের অত্যন্ত দুঃখের দিন। আপনাদের ১২টায় এখানে ডেকেছিলাম। আমিও ১২টায় আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে, আমাকে বলা হয়েছে, আপনি আসলে ভালো হবে না। এমনকি এখনও আসলে ভালো হবে না। তারপরও সাহস করে এসেছি। আমরা যে অত্যন্ত দুঃখে পড়ে গেছি, কষ্টে পড়ে গেছি, সেটা আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানাতেই আজকে ডেকেছি। আমরা একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছি। অতি সম্প্রতি আমরা এই ভবনে উঠেছি। আমরা আগে যখন গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে ছিলাম, তখন সেখানেই ছিলাম। যখন আমাদের যাবার পালা হল, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, একটা বিল্ডিং করি, সেখানেই আমরা সবাই শান্তিতে কাজ কর্ম করতে পারব। স্বপ্নের ২০ তলা আমরা সবাই মিলে দাঁড় করিয়েছি।’’
ড. ইউনূস বলেন, ‘‘যখন আমরা এই বিল্ডিংয়ে উঠি তখন খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। এখানে আমরা কাজ করছি, দেশ-বিদেশ থেকে লোক আসছে। হঠাৎ চার দিন আগে দেখলাম বাইরের কতগুলো লোক এসে এটা জবর দখল করে ফেলল। তাদের কাছে আমরাই বাইরের লোক হয়ে গেলাম। তারা তাদের নিয়মে চালানোর চেষ্টা করছেন, আমরা বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে। আমরা পুলিশের কাছে গেলাম। বললাম, আপনারা এসে ঠিক করে দেন। পুলিশ কোনো গুরুত্বই দিল না। তারপর এসে একবার ঘুরে গেল। তারা এখানে কোনো অসুবিধা দেখল না। আমরা বললাম, তারা তালা দিয়ে যাচ্ছে, আবার খুলে দিয়ে যাচ্ছে। আমরা কোন জগতে এসে পড়লাম। এখনও সেই পরিস্থিতি বিরজমান। এখানে বসে কথা বলছি, আমরা জানতাম না যে, এখানে আমাদের বসতে দেবে কী দেবে না? এটা তাদের এখতিয়ারের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’
ড. ইউনূস বলেন, ‘‘আমরা বহু রকমের দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাই, এমন দুর্যোগ আর কোনোদিন দেখিনি। এখন আমাদের গতি কী? দুনিয়ার সামনে আমাদের কাজটা কী হবে? আমরা এখন দুনিয়ার সামনে কী বলব? কী হয়েছে আমাদের এখানের ঘটনাটা? আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে আমরা জিজ্ঞাসা করি, এভাবে একটা দেশ চলে কী করে? এটা ব্যাখা করার কিছু নেই। আজ সকাল থেকে শুনছি, অফিসের সামনে ঝাড়ু নিয়ে মহড়া হচ্ছে। কেন হচ্ছে তাও তো বুঝতেছি না।’’

‘এভাবে একটা দেশ চলে কী করে?’

এই প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে হয়েছে? অর্থ এসেছে কোথা থেকে? অনেকই বলেন প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় হয়েছে? একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘‘ব্যবসার মুনাফার টাকায় এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় হয়নি। যা হয়েছে আইন মেনে হয়েছে।’’ একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন পদ্মা সেতু নির্মাণে আপনার বিরোধিতা কী আইন মেনেই হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘‘আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে?’’

সাংবাদিক সম্মেলনে ড. ইউনূসের সঙ্গে গ্রামীণ কল্যাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম মইনুদ্দিন চৌধুরী, গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল ইসলাম ছাড়াও নারী অধিকার কর্মী ফরিদা আক্তার, শিরিন হক, রেহেনুমা আহমেদ, দৃকের শহীদুল আলমসহ গ্রামীণ ট্রাষ্টের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে বৃহস্পতিবার সকালে কিছু নারী ওই ভবনের সামনে ঝাড়ু মিছিল করেন। তারা ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেন। এছাড়া গত তিন দিন ধরে ওই ভবনটির সামনে অপরিচিত বেশ কিছু মানুষ অবস্থান করছেন। তারা ওই ভবনে আসা যাওয়া মানুষের উপর নজরদারি করছেন।
কী হচ্ছে গ্রামীণ ট্রাষ্টের প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে?

গ্রামীন ট্রাষ্ট্রের অধিনে ১৬টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সবগুলো প্রতিষ্ঠানই এই ভবনে। এর সবগুলোর চেয়ারম্যান ড. ইউনূস। এর মধ্যে নয়টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে সামাজিক ব্যবসা সংক্রান্ত। গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত সোমবার বিকাল ৪টায় গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অন্তত ২০ জন এসে খুঁজছিলেন আমাদের দু'টি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে। আমরা নিচে গেলে বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের বৈঠক চলছে। সেখান থেকে একটি চিঠি আসবে। সেই চিঠি আসার আগ পর্যন্ত সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে। তবে রাত সাড়ে ৭টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে কোনো চিঠি না আসায় আমরা দুই জন প্রতিনিধি রেখে চলে যাই। রাত ৯টায় গ্রামীণ ব্যাংকের চিঠি নিয়ে এসে কয়েকজন কর্মী ভবনের ফটকে তালা লাগিয়ে দেন।’’

‘গ্রামীণ ব্যাংকের চিঠি এনে কয়েকজন কর্মী তালা লাগিয়ে দেন’

জনাব ইসলাম বলেন, ‘‘এর ধারাবাহিকতায় পরদিন অর্থাৎ মঙ্গলবার সকালে গ্রামীণ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা সকালে এসে তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেন। তারা আমার এবং গ্রামীণ কল্যাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কক্ষে অবস্থান নেন। তারা বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড সভায় তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে তারা এখানে দায়িত্ব পালন করবেন। এরসঙ্গে বর্তমান কর্মকর্তারাও বহাল থাকবেন। তারা আরও বলেন, আপনাদের কোম্পানির চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা হয়েছে। নতুন করে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’’
গ্রামীণ ব্যাংক থেকে পাঠানো চিঠিতে দেখা গেছে, গ্রামীণ টেলিকম ও গ্রামীণ কল্যাণের পরিচালক পদে কয়েকজনকে মনোনীত করার পাশাপাশি এ দুই কোম্পানির চেয়ারম্যান পদে ইউনূসের বদলে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুল মজিদকে মনোনীত করা হয়।

কি কারণে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হলো? জানতে চাইলে গ্রামীণ কল্যাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম মইনুদ্দিন চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা আর্টিকেলের যে পরিবর্তন করেছিলাম, উনারা বলছে সেটি ঠিক হয়নি। উনারা নমিনেশন পাঠিয়েছেন, গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান হবে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান। এই বিধানটা আগে ছিল। কোম্পানি বড় হওয়ার সঙ্গে এগুলো পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তনটা তারা গ্রহণ করছে না। তারা বলছে, এটা কোনো লিগ্যাল ওয়ে না। শুরুতে গ্রামীণ টেলিকমের আর্টিকেল অব এসোসিয়েশনের ধারা এমনটা ছিল। ওই ধারাতে ওদের নমিনেটেড তিনজন ডিরেক্টর থাকবে। গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান হবে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান। ২০০৯ সালে এটি পরিবর্তন হয়েছে। এরপর তারা কোনো কথা বলেনি। আমরাও এভাবে প্রতিষ্ঠান চালিয়ে আসছিলাম।’’ 

টেলিকম ভবনে ড. ইউনূসের যে ৯টি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো হলো- গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ মৎস্য, পশু সম্পদ ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ কৃষি ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ সামগ্রী, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ শক্তি ও গ্রামীণ কমিউনিকেশন। বাকিগুলো লিমিটেড কোম্পানি। গ্রামীণ ব্যাংকের সম্পৃক্ততা রয়েছে এমন দুইটি প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

শেয়ার করুন: