মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

ভালোবাসা দিবসের বিশেষ লেখা

প্রেম এক স্বর্গীয় অনুভূতি

জেপুলিয়ান দত্ত জেপু, শিক্ষক ও সাংবাদিক

আপডেট: ১২:৫৮, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

প্রেম এক স্বর্গীয় অনুভূতি

প্রতিকী ছবি

দু’টি বর্ণ সমন্বয়ে একটি শব্দ প্রেম। কবিতার মত উপভোগ্য,নীলিমার মত প্রশান্ত, সুরের মত গহীন, চুম্বকের মত আকর্ষক, মানে না বাঁধা, মানে না বৈষম্য। যে একবার ডুবেছে সেই তো প্রেমের স্বাদ বুঝে। প্রেম শ্বাশ্বত, সুন্দর, চিরন্তন, অনির্বাণ, অবিনশ্বর ও সংজ্ঞাহীন। প্রেম মানুষকে দেয় ঐশ্বর্য্য। মৃত্যুক দেয় মহিমা,বঞ্চিতাকে করে বিদগ্ধ। প্রেম-প্রীতি আছে বলে শত ঝড় ঝঞ্জার মাঝেও মাথা উচুঁ করে দাঁড়াবার প্রবল ক্ষমতা পায় মানুষ। উষ্ণ হৃদয়ে প্রেমের উপস্থিতি মানুষকে আঘাতে জর্জরিত করে আবার ধৈর্য ধরার শক্তিও যোগায়। প্রেমই জীবনের স্বার্থকতা, আবার প্রেমই জীবনের ব্যর্থতা।

 প্রেম জানে না জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সময় ও স্থান। প্রেমের আকর্ষণ বড় তীব্র। শত বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করে জীবনের এই অমসৃণ দুর্ভেদ্য পথ ধরে সব জেনেশুনেই তীব্র এক অজানা পথে সুখের আশায় এগিয়ে যায় মানব-মানবী। এদের কাছে থাকে না অর্থের লালসা, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চিন্তা চেতনা। লোক চক্ষুর আড়ালে প্রেম এগিয়ে যায় তার অভিষ্ট লক্ষ্যে। তিনটি জিনিসকে পৃথিবীতে ঢেকে রাখা যায় না, তা’হলো প্রেম, টাকা আর ধোঁয়া। যে করেই হোক তা প্রকাশ পাবেই।

শরীরের অন্যান্য রাসায়নিক ক্রিয়া কলাপের মত প্রেমও নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিস্ক দ্বারা। সৃষ্টির অনাদিকাল থেকেই প্রেম-ভালবাসা অবিরাম ধারায় বয়ে আসছে। এ ধারা পৃথিবী ধ্বংসের আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। প্রেম এ দু’টি বর্ণ সমষ্টি একটি শব্দ দিয়ে কখনো সংজ্ঞায়িত করা যায় না। মন আর অনুভবের মাঝেই এর অস্তিত্ব বিরাজমান। প্রেম থাকে ঘুমন্ত, এটি জাগ্রত হয়ে উঠে হৃদয়ের আকুল আহ্বানে। প্রেম প্রতিপক্ষকে দেয় তৃপ্তি। প্রেম ভোগের নয়, উপলব্ধির। হীন স্বার্থ চরিতার্থে প্রেমের শেষ হয়। হাসি-কান্না,আনন্দ-বেদনা,সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান, মিশ্রিত প্রেম এক স্বর্গীয় অনুভূতি।

নারী পুরুষ একে অপরকে ভালবাসলে নারীরা হয়ে যায় নদী আর পুরুষরা হয় জলন্ত কাঠ। মানুষ মনের অজান্তে  প্রেমে পড়ে বা ভালবাসায় জড়িয়ে যায়। এখানে মানুষের কোনো নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ নেই। কখন, কিভাবে, কি করে তার অজান্তে একজন নারী অথবা একজন পুরুষ প্রেমে পড়ে যায় সে নিজেও টের পায় না। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, প্রেম হচ্ছে জলন্ত সিগারেট যার সংযোগ অগ্নি শেষ পরিণতি ছাই। প্রেমিক-প্রেমিকা নিজস্বতা হারিয়ে একে অপরকে নিবিড় করে পাওয়ার জন্য শত বাধাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যায় অজানার উদ্দেশ্যে। যা ভাল লাগার অকৃত্রিম আবেশ। যুক্তি দিয়ে বিচার করলে ফলাফল দাঁড়ায়, দু’জন স্বাধীন নারী ও পুরুষের মানবিক সংশ্লেষণের নাম প্রেম। অন্য অর্থে এ হচ্ছে মানবিক ও জৈবিক দিক থেকে পরস্পরের প্রতি সমতার অনুভূতি। কর্মময় জীবন নিয়ে মানুষ শত ব্যস্ততায় হাপিয়ে উঠে। একাকিত্ব নিরসনে সে খুঁজে চলে সঙ্গী বা সঙ্গীনীর সন্ধানে। তার মধ্যে সে আবিস্কার করে নেয় প্রেম।

 প্রেমিক-প্রেমিকা দু’জন দুজনার কাছে চায় তাদের মনের কষ্ট, অভিব্যক্তি বলার নিরাপদ একটি মনের আশ্রয়। ভালবাসলে তারা হয়ে যায় দু’টি নদী। তারপর ক্রমাগত ছুটে চলা। এর মাঝে যদি পাহাড় বা বনভূমি আড়াল হয়, তাহলে ঘটে ছন্দপতন। তবে এদের লক্ষ্য থাকে সাগর। ভালবাসা মানে একে অপরের মাঝে সমর্পণ। দু’টি হৃদয় লৌহ-চুম্বকের মত একটি বন্ধন। টান পড়লেই ব্যাথা লাগে। চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কত কষ্ট, যন্ত্রণা, বিরহ ব্যাথায় ভরা প্রেম-ভালবাসা। তারপরও মানুষ প্রেম চায়। প্রেম রহস্যময়। শরীরের আকর্ষণ হয়তো যৌবনের ধর্ম কিন্তু প্রেম হয়তোবা মানুষের প্রকৃতিতে একাকীত্ব বোধ আর অসম্পূর্ণতাই বন্ধু বা বন্ধবী খুঁজে নিতে বাধ্য করে।  প্রেমে পড়লে যাচাই করে কেউ প্রেমে পড়ে না চোখের ভাল লাগা থেকেই শুরু হয় ভালবাসা। তবে একজন নারীর  চোখে বা একজন পুরুষের মাঝে যে সব গুণাবলী খুঁজে বেড়ায় তা হলোঃ স্মার্ট,সুশ্রী, স্বাস্থবান, বিবেকবান, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, রুচিশীল, সহানুভূতিশীল, বিচক্ষণ, পৌরষদীপ্ত, খোশ  মেজাজী, ধৈর্যশীল, বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞানী, সহমর্মী, মিতব্যয়ী, সাহসী, কর্মঠ, রসিক, ধর্মপরায়ণ, উদারদৃষ্টিভঙ্গী, বিশ্বস্ত, দৃঢ়চেতা, মননশীল, সৃজনশীল, শক্তিশালী, আদর্শবান, ন্যায়পরায়ণ, দয়াবান, মহত্ত্ববোধ ইত্যাদি। এসব গুণাবলী থাকলে একজন পুরুষ হয়ে উঠে নারীর চোখে এক অনন্য প্রেমিক। যদিও সব গুণাবলী এক পুরুষের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে সুন্দর মনের একজন পুরুষ পারে একজন নারীকে ভালবাসার বন্ধনে জড়াতে। ভালবাসার সবচেয়ে না পাওয়ার বিষয় থাকে বেশী। ভালবাসার  যোগসূত্রে পাঁচটি উপাদান থাকে। স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের প্রফেসর ডন ব্রায়ান দীর্ঘদিন গবেষণা করে তা বের করেছেন। এগুলো হলো,(১) দৈহিক আকর্ষণ,(২) মানসিক সাড়া জাগানো,(৩) ঘনিষ্ঠ হওয়ার ইচ্ছে,(৪) গভীর ভাবে আবেগ প্রবণ হওয়া এবং (৫) ভালবাসার প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে ফেলার ভয়। এই পাঁচটি উপাদান  বের করতে ২০ বছর সময় লেগেছে। যা জরিপ করা হয়েছে অ্যামেরিকায়।

ব্রিটেন ও হল্যান্ডের বিভিন্ন শ্রেনির মানুষের মতামত নিয়ে পদার্থ বিজ্ঞানী আলফ্রেডের মতানুসারে,ভালবাসার কোনো  দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও ভেদ নেই। কিন্তু গভীরতা আছে। রসায়ন শাস্ত্রে ভালবাসাকে বলা হয়েছে গ্লুকোজের হাসি। আবার নাইট্রাস অক্সাইড নামে একটি গ্যাস নিঃশ্বাসের সাথে অল্প পরিমাণ গ্রহণ করলে হাসির উদ্রেক করে। যা লাফিং গ্যাস নামে পরিচিত। প্রেমে পড়লে প্রেমিক সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল থাকে। জীব বিজ্ঞানে বলা হয়েছে,এক জন পুরুষের (পরাগরেণু) যখন কোনো নারীর মনে (গর্ভমুন্ডে) বাধা পড়ে তাকে ভালবাসা বলে। যৌন বিজ্ঞানী এলেন কারের ভাষ্যমতে প্রণয়ের ঘনীভূত অবস্থার নাম ভালবাসা। চিকিৎসা শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ভালবাসা এমন এক রোগ, রাতের ঘুম কেড়ে নেয়, দিবা স্বপ্নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং  দেহ মনে প্রফুল্লতার টনিক বা ভিটামিন হিসাবে কাজ করে। তবে শেষ কথা হচ্ছে- পৃথিবীর চেহারাও দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। সেই সাথে পাল্টে যাচ্ছে ভালবাসার ধরণ। নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশায় বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে প্রকৃত প্রেম। নারী নির্যাতন বেড়ে যাচ্ছে, যা ঠেকানো প্রশাসনের পক্ষেও দুরহ হয়ে পড়ছে। মানুষ আজ সত্যি বিপন্ন। মানুষের স্বপ্নের পৃথিবী আজ ধ্বংসের মুখোমুখি। সুন্দর দৃষ্টি শক্তির আজ বড় অভাব। আমাদের মনে রাখতে হবে এই সুন্দর স্বপ্নীল পৃথিবীতে বাঁচতে হলে দিতে হবে ভালবাসা। ভালবাসার মধ্য দিয়ে গড়ে তুলতে হবে সুন্দর সবুজ ধরনী। যেখানে থাকবে স্নেহের বন্ধন। একে অপরের সাথে প্রেম-প্রীতি, ভালবাসার বাহুডোরে আবদ্ধ থাকবে এবং সৃষ্টি হবে সুখের নীড়। ভালবাসার মধ্য দিয়ে প্রকৃত প্রেমের বীজ অঙ্কুরিত হোক সবার হৃদয়ে। এ প্রত্যাশা সবার। তাই সফল হউক বিশ্ব ভালবাসা দিবস।

লেখকঃ শিক্ষক ও সাংবাদিক।

শেয়ার করুন: