শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

আমাকে ক্ষমা করো  হিরোশিমাবাসী!

হাবিব রহমান

প্রকাশিত: ১৪:৪৬, ৩১ অক্টোবর ২০২৫

আমাকে ক্ষমা করো  হিরোশিমাবাসী!

ছবি: সংগৃহীত

জাপানের রাজধানী টোকিও থেকে হিরোশিমা শহরে পৌঁছেছিলাম এক বিকেলবেলা। হোটেলে লাগেজ রেখেই ছুটে গেলাম হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে যেটি পৃথিবীর ইতিহাসে মানবতার সবচেয়ে গভীর অনুশোচনার স্থানগুলোর একটি। হিরোশিমার কেন্দ্রে অবস্থিত এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৫ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবতার কাছে এক শিক্ষা হিসেবে।

লক্ষ্য ছিল আর কখনো যেন এমন না ঘটে। প্রবেশদ্বারেই একটি বিশাল কাচঘেরা হল। যেখানে রাখা আছে একটি ঘড়ি। সময়টা থেমে সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে যখন ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট, মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আকাশ থেকে নেমে এসেছিল পারমাণবিক বোমা। আমি ঘড়িটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সময়ও যেন সেদিন থেমে গিয়েছিল। একটি মায়ের ছবি, যিনি সন্তানের দগ্ধ দেহ বুকের ভেতর লুকাতে চাইছেন। আরেকটি চিত্রে একজন কিশোর চামড়া ঝরে গেছে, তবুও বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। আমি মাথা নিচু করলাম। আমি যে দেশটিতে বসবাস করি সে দেশের পতাকা মনে পড়লো। যে পতাকার জন্য গর্বে বুক ফুলিয়ে বলেছি “ও ধস অসবৎরপধহ.” আজ সেই গর্বটাই যেন আমার বুকে পাথর হয়ে বসে আছে। ভেতরে ঢুকেই চোখে পড়ছিলো পোড়া কাপড়, গলে যাওয়া কাচ, দগ্ধ শিশুদের জুতো, স্কুলব্যাগ, সাইকেলের ফ্রেম। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক প্রদর্শনী। এক শিশুর ছোট জামা, যার শরীর আর বেঁচে নেই, তবুও তার পোশাকে এখনো আটকে আছে সেই সকালটার আতঙ্ক। প্রদর্শনীর এক কোণে রাখা আছে একটি দেয়ালচিত্র যেখানে চিত্রিত করা হয়েছে “কালো বৃষ্টি” (ইষধপশ জধরহ) বোমাবর্ষণের পর যে বিষাক্ত বৃষ্টি পড়েছিল, যা মানুষ, নদী আর আকাশ সবকিছু বিষাক্ত করে দিয়েছিল। মিউজিয়ামের শেষে একটি বিশাল কাচের জানালা দিয়ে দেখা যায় অ্যাটমিক বম্ব ডোম, যেটি বিস্ফোরণের কেন্দ্রবিন্দু থেকে অল্প দূরে থেকেও এখনো দাঁড়িয়ে আছে, মানবতার বিবেক হয়ে। চোখে পড়ছিলো মিউজিয়ামের দেয়ালে একটি লেখা ‘’“বঃ ধষষ ঃযব ংড়ঁষং যবৎব ৎবংঃ রহ ঢ়বধপব, ভড়ৎ বি ংযধষষ হড়ঃ ৎবঢ়বধঃ ঃযব বারষ.” এই বাক্যটি পড়লে মনে হয় এ যেন মানব সভ্যতার প্রতি মানবতারই প্রতিশ্রুতি। মিউজিয়ামে বোমাবর্ষণের নৃসংতার ছবি দেখে মনটা একটা অব্যক্ত ব্যথায় ভরে উঠেছিলো। মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে দেখি, আকাশে হালকা বৃষ্টি। হিরোশিমায় এই বৃষ্টি নাকি “কালো বৃষ্টি” নামে বিখ্যাত, যেদিন বোমা পড়েছিল, সেদিনও এমনই বৃষ্টি হয়েছিল যার প্রতিটি ফোঁটা ছিল বিষে ভরা, যা ছুঁয়ে মরে গিয়েছিল ঘাস, পাখি, মানুষ। আমি সেই বৃষ্টির ফোঁটার নিচে দাঁড়িয়ে বললাম আজ আমি শুধু একজন পর্যটক নই, আমি একজন স্বীকারোক্তির মানুষ। আমার লজ্জা, আমার অনুতাপ, আমার প্রতিশ্রুতি যেন আর কোনো আকাশে এমন আগুন না জ্বলে। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌছালাম মিউজিয়ামের অদূরে এক শান্ত নদীর ধারে। যেখানে বাতাসে মিশে আছে অতীতের পোড়া ধাতুর গন্ধ, ভস্মে মিশে আছে শিশুদের চিৎকার, মায়েদের কান্না, আর একটি জাতির দগ্ধ স্মৃতি। আমি একজন বাংলাদেশি আমেরিকান, দুই যুগ ধরে নিউইয়র্কে বসবাস করছি। এই দেশেই গড়েছি আমার স্বপ্ন, রক্ত-ঘামে গড়ে তোলা জীবনের প্রতিটি ইট। তবুও আজ এই শহরে এসে, এই নিঃস্তব্ধ স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে, আমার গর্বের দেশটার জন্য বুক ফেটে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। আমি ভাবছিলাম আমার দেশ, যে সভ্যতার প্রতীক বলে নিজেকে দাবি করে, সেই দেশই একদিন এই শহরের আকাশে আগুন ছুড়েছিল। হাজার শিশুর হাসি মুছে দিয়েছিল মুহূর্তে। এমন একটি নিস্তব্ধ হত্যার দায় কেউ একা নেয় না, কেউ ভুলেও যায় না। আমি জানি, আমি সেই বোমা ফেলিনি। কিন্তু আমি সেই দেশেই থাকি, যে দেশ এই বোমার ইতিহাস বহন করে। আমি সেই সভ্যতার নাগরিক, যার হাতে প্রযুক্তি, কিন্তু হারিয়ে গেছে হৃদয়ের বিনয়। আমার বুকের ভেতর থেকে একটাই বাক্য উঠে এলো “আমাকে ক্ষমা করো, হিরোশিমাবাসী।” আমি জানি, এই ক্ষমা কোনো দেশ বা রাজনীতির জন্য নয়, এটি মানুষের পক্ষ থেকে মানুষের কাছে। হিরোশিমা শুধু একটি শহর নয়, এটি মানবতার এক আয়না, যেখানে প্রতিটি পাথর, প্রতিটি ছাই, প্রতিটি নদীর ঢেউ আমাদের বিবেককে প্রশ্ন করে।
আমার প্রার্থনা
হিরোশিমার শিশুরা যেন শুধু ইতিহাসে না থাকে, বরং পৃথিবীর ভবিষ্যৎ হোক তাদের হাসিতে পূর্ণ।
আমি আবার বলি
“আমাকে ক্ষমা করো, হিরোশিমাবাসী।
আমি সেই সভ্যতার সন্তান, যে একদিন তোমাদের আকাশে আগুন ছুড়েছিল, কিন্তু আজ আমি সেই মানুষ, যে তোমাদের জন্য কাঁদে। “তোমাদের জন্য কাঁদতে, ক্ষমা চাইতে এসেছি এই হিরোশিমায়।”
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও ভ্রমণপিপাসু ব্যক্তিত্ব।
 

শেয়ার করুন: