বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

প্রথম আলো’তে যুক্ত হওয়া যায়, বের হওয়া যায় না

শামীম শাহেদ, অতিথি লেখক

প্রকাশিত: ০০:২৫, ৭ নভেম্বর ২০২২

প্রথম আলো’তে যুক্ত হওয়া যায়, বের হওয়া যায় না

শামীম শাহেদ, অতিথি লেখক-নবযুগ

‘প্রথম আলো’র সঙ্গে আমার যুক্ত হওয়াটা বেশ নাটকীয় ছিল। ‘প্রথম আলো’র নাম কিন্তু ‘প্রথম আলো’ ছিল না, ছিল-দৈনিক একুশে। প্রথম আলোর সঙ্গে আমার যুক্ত হওয়া মানে কিন্তু প্রথম আলোর সঙ্গেই যুক্ত হওয়া নয়, এর শুরু ভোরের কাগজ থেকে। 

’৯৩ কি ’৯৪ সালের কথা। আমি তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে কাজ করি। সারা বাংলাদেশের বইপড় কর্মসূচির মূল্যায়ন বিভাগটা দেখি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তার ছাঁদের জন্য আগে থেকেই বিখ্যাত। বিকেল হলেই সবাই আসত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাঁদে আড্ডা দিতে। তখন ছোলামুড়ি ছিল বাড়তি পাওয়া। ভোরের কাগজের অনেকেরই আসা-যাওয়া ছিল। ভোরের কাগজের রওশন ভাই তখনো দন্তস্য রওশন হন নাই। একদিন তিনি বলেলন, শামীম শাহেদ একটা লেখা অনুবাদ করে দাও তো দেখি, আমার পাতায় ছাপা হবে। রওশন ভাই মানে সাইদুজ্জামান রওশন ওরফে দন্তশ্য রওশন। লেখার বিষয় ছিল ‘মোজেস দিলেন পাড়ি’। মুসা (আঃ) কীভাবে লোহিত সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন তার একটা সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা প্রাকাশিত হয়েছিল একটি বিদেশী পত্রিকায়। সেটা অনুবাদ করতে হবে। আমি রোমাঞ্চিত হলাম। আমার লেখা ছাপা হবে পত্রিকায়! সারা রাত বসে বসে অনুবাদ করে ফেললাম। পরদিন নিয়ে গেলাম ভোরের কাগজে। মতিউর রহমান তখন ভোরের কাগজের সম্পাদক। আমরা বলতাম মতি ভাই। ভোরের কাগজের চতুর্থ তলায় উঠে দেখলাম আমার সব বন্ধুরা ঘোরাঘুরি করছে। তুষার আব্দুল্লাহ, সাগর সরওয়ার, দিদার চৌধুরী, কাকলি প্রধান।

তখন তারাই শুধু আমার বন্ধু ছিল। পরে একে একে পরিচিতি হলাম সাজ্জাদ শরীফ, আনিসুল হক, সুমনা শারমিন, সঞ্জীব চৌধুরী, একেএম জাকারিয়া, মুনির রানা, গিয়াস আহমেদ, মুনির হাসান, কবির বকুল, মাহমুদ ইকবাল, ইকবাল কবিরসহ আরও অনেকের সঙ্গে। সবাই তখন বসতেন ভোরের কাগজ বিল্ডিংয়ের চার তলায়। তিন তলায় বসতেন মোজাম্মেল হোসেন মন্জু, অমীত হাবিব, সানাউল্লাহ লাভলু, সুকান্ত গুপ্ত অলোক, আমিনুর রশীদ, সওগাত আলী সাগর, জ.ই. মামুন, মুন্নি সাহা, জায়েদুল আহসান পিন্টু, উৎপল শুভ্র, প্রভাষ আমীন, পবিত্র কুন্ডু, শাহেদ মহাম্মদ আলী, সুপন রায়, পারভেজ চৌধুরী আরও অনেকে। (ভাই সবার নাম লিখতে পারলাম না, নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন!) এদের অনেকে পরবর্তী সময়ে দেশবাসির কাছে তারকা হলেও আমাদের কাছে তখন থেকেই তারকা ছিলেন। 

‘মোজেস দিলেন পারি’-এই শিরোনামে আমার লেখাটা পরের সংখ্যাতেই ছাপা হয়ে গেল। তারপর আমার উত্তেজনা দেখে কে। সারাদিন এই পত্রিকা হাতে নিয়ে ঘুরলাম। কেউ একজন জিজ্ঞাসা করলেই পুরো ঘটনা বলে দিতাম। লেখার শেষে লেখকের নামের জায়গাটা দেখিয়ে বলতাম, এটা আমি। তারপর থেকে আমি অনুভব করলাম, নতুন ধরনের এক উত্তেজনা আমাকে ছেয়ে ফেলেছে। পৃথিবীর আর কেউ বুঝুক না বুঝুক আমি উপলব্ধি করলাম পৃথিবীটাকে অনেক সুন্দর মনে হচ্ছে, নিজেকে অনেক ক্ষমতাবান মনে হচ্ছে। এর আগেও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রকাশনীতে আমার লেখা ছাপা হয়েছে। কিন্তু এতটা উত্তেজনা বোধ করি নাই। তারপর থেকে দিনরাত ভোরের কাগজের চার তলাতেই পরে থাকতে লাগলাম। তানজিনা হোসেন, শাওন আযীম, তুষার আব্দুল্লাহ, সাগর সরওয়ার আর দিদার চৌধুরীর চাপে কেউ তখন সঞ্জীব চৌধুরীর ধারেকাছে ঘেষতে পারত না। হঠাৎ একদিন শুনলাম কবির বকুল এর তত্ত্বাবধানে একটা নতুন পাতা বের হবে, নাম- ‘রংধনু’।

চলচ্চিত্রের খবরাখবর থাকবে এই পাতায়। নায়ক সালমান শাহ-র ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ তখন সবেমাত্র হিট হয়েছে। তখনো শাবনাজ-নাঈম-এর বিশাল আধিপত্য। শাবনুর তখনো তার যাত্রা শুরু করে নাই। আমি দেখলাম সবাই ভোরের কাগজের ‘মেলা’ পাতার দিকে তাকিয়ে থাকে। চলচ্চিত্রের পাতার দিকে কারো আগ্রহ নাই। আমি ঠিক করলাম এই দিকেই যাই। আমার আসল নাম তখন ছিল মোহাম্মদ শাহীদ শামীম। চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা করছি এটা যদি বাসায় জানতে পারে তাহলে বাড়ি থেকে বের করে দেবে, তাই নাম পাল্টে নতুন নাম নিলাম-শামীম শাহেদ। সুপন রায়, তুষার আব্দুল্লাহ আমাকে এফডিসির সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা শুরু করলাম। 

‘রংধনু”র প্রতি সংখ্যায় একাধিক লেখা ছাপা হলেও আমার চোখ কিন্তু ‘মেলা’র দিকে। একদিন আনিসুল হক বললেন, শামীম মেলা পাতার জন্য একটা রিপোর্ট করতে পারবেন? এই যে ঢাকা শহরে কুমিল্লার রসমালাই বিক্রি হচ্ছে সেটা কি সত্যিই কুমিল্লা থেকে আসে নাকি ফেইক? তারপর ধরেন টাঙ্গাইলের চমচম, বগুড়ার দই, মুক্তাগাছার মন্ডা এসব কি আসলেই সেখানকার? আনিস ভাইকে আমরা সবাই মিটুন ভাই বলে ডাকতাম। আমি কোনো কিছু চিন্তা না করেই বললাম, পারব মিটুন ভাই। মিটুন ভাই বললেন, এই রিপোর্টটা করতে আপনাকে কিন্তু কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, বগুড়া সব জায়গায় স্বশরীরে যেতে হবে। আমি বললাম, পারব। মেলা পাতায় লেখা ছাপা হবে, তাও আবার লিড স্টোরি এটাই ছিল আমার কাছে বড় বিষয়। 

সেই রাতেই চলে গেলাম টাঙ্গাইল, সবার সাথে কথাবার্তা বলে, ছবি তুলে পরদিন চলে গেলাম কুমিল্লা। সেখান থেকে ঢাকা ফিরে একরাত রেস্ট নিয়েই গেলাম বগুড়া। তারপর দিন সারারাত বসে রিপোর্ট লিখে ফেললাম। তুলে দিলাম মিটুন ভাইয়ের হাতে। এত দ্রুত লেখা রেডি দেখে মিটুন ভাই বললেন, সত্যি সত্যি গেছিলেন তো নাকি চাপাবাজি? আমি আমার সব সোর্সদের নাম, নম্বার দেখালাম। মিটুন ভাই বললেন, ঠিক আছে সঞ্জীব দার কাছে জমা দেন। 

৯৪/৯৫ সালের কথা, সঞ্জীব দা তখন বসেন চারতলার উল্টো পাশের টেবিলে। সঞ্জীব দা লেখার প্রথম কয়েক লাইন পড়েই ছুড়ে ফেলে দিলেন। বললেন, সর এখান থেকে কিছুই লেখা হয় নাই। 

সঞ্জীব দা আমাদের সবাইকে “তুই” করে বলতেন। 

তার এই ছুড়ে ফেলা দেখে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। মনে হলো আমার পৃথিবীতে বেঁচে থাকারই কোনো অধিকার নাই। সেই লেখা হাতে নিয়ে হাটতে হাটতে উত্তর শাহজাহানপুর এলাম। তিন চারদিন ঘর থেকে আর বের হলাম না, মনে মনে শুধু ভাবি, সঞ্জীব দা-র মনের মতো করে একটা লেখাও লিখতে পারলাম না?

হঠাৎ আনিস ভাইয়ের ফোন, শামীম শাহেদ আপনার লেখা কই?
আমি বললাম, মিটুন ভাই লেখা সঞ্জীব দা-র পছন্দ হয় নাই। ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন।

ঠিক আছে লেখা নিয়ে এখনি আসেন। ওই দিন সঞ্জীব দার মেজাজ বোধ হয় একটু বেশি খারাপ ছিল। আপনি আসেন। সঙ্গে সঙ্গে লেখা হাতে নিয়ে চলে গেলাম ভোরের কাগজের চার তলায়। সঞ্জীব দা বললেন, বোস, আমি যেভাবে বলি লিখে যা। পুরো লেখাটা নতুন করে লেখালেন সঞ্জীব দা। পরের সপ্তাহে ছাপা হয়ে গেল। আমার উত্তেজনা দেখে কে। তারপর একে একে ছাপা হলো, আশেপাশে লাশের চা, ভিক্ষাবৃত্তিতে বাচ্চা ভাড়া, মহিষ কীভাবে গরু হয়। এক নতুন স্বপ্নে ডুবে গেলাম। এমনো হয়েছে এক মাসে আমার ষাট-পয়ষট্টিটা লেখা ছাপা হয়েছে। বিভিন্ন নামে। একদিন ভোরের কাগজের সাব-এডিটর হিসেবে যুক্ত হয়ে গেলাম। সেই যাত্রায় সঙ্গে পেলাম তানজিনা হোসেন, শাওন আযীম, মেহেদী মাসুদ, তাজিন আহমেদ, রোজীন মস্তারিন টুশি, সায়ন্থ শাখাওয়াৎ, মুজাহিদুল ইসলাম আকাশ, স্বরূপ সোহান, ওমর শরীফ, সুমন পাটওয়ারি, আসিফুল ইসলাম সাগর, কাজী মাহমুদ, ওমর ফারুক, কামরুজ্জামান বাবু, হিমেল চৌধুরী, রেজাউল হক রেজা, নওরোজ ইমতিয়াজ, নবনীতা চৌধুরী, জয়া আহসান, আবিদা নাসরিন কলি, ফেরদৌস ফয়সাল, লিমা হালদার, লুনা হালদার, ইমরুল ইউসুফসহ আরও অনেক কেই। (নাম আগেপরে হয়ে গেলে, নিজ গুনে ঠিক করে নেবেন! নাম বাদ পরে গেলে পাঠিয়ে দিন, যোগ করে দিচ্ছি।) 

আমাদের দ্বিতীয় তলায় আরো তিনটি বিভাগ ছিল যাদের সাথে আমাদের মাসে এক-দুই বারের বেশি দেখা হতো না, কিন্তু সেই দেখাটাই ছিল সবচেয়ে আনন্দের। অ্যাকাউন্টস এর হাফিজুর রহমানম ডাকলেই আমাদের মন ভালো হয়ে যেত। পাশেই ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল এবিএম জাকারিয়া, সার্কুলেশনের দায়িত্বে। আর যিনি ফোন করলে আতঙ্কিত হয়ে পড়তাম তিনি হলে রশিদুর রহমান সবুর।  তিনি ফোন দেওয়া মানেই পাতার অর্ধেকটা হাওয়া। 

হঠাৎ একদিন মতিভাই বললেন, আমরা একটা নুতন পত্রিকা বের করব, নাম -একুশে। সবার আলাদা আলাদা টেবিল থাকবে, কম্পিউটার থাকবে। নিজের পাতা নিজেকেই ডিজাইন করতে হবে। মতিউর রহমানের নেতৃত্বে আমরা চলে এলাম কারওয়ান বাজারের বিএসইসি ভবনের সাত তলায়। সারাদিন বসে বসে আড্ডা দেই আর উল্টো পাশের কুকার্স সেভেন-এর খিচুরি খাই। চমৎকার ছিল খিচুরিটা। বিভিন্ন পাতার নাম ঠিক হচ্ছে, লোগো ডিজাইন করা হচ্ছে। কাইয়ুম স্যার একদিন বললেন, সবগুলো পাতার লোগো থাকবে পাতার বা-দিকে এবং ডান দিকে বাকা করে লেখা। কাইয়ুম স্যার মানে চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। লোগো পাতার একদিকে বাকা করে লেখা থাকবে এটা কিভাবে হয়? কেমন লাগবে? এর আগে কোনো পত্রিকায় সেই রকম ডিজাইন দেখা যায় নাই। একে একে একুশে পত্রিকার বিভিন্ন পাতার নাম ঠিক হতে লাগল। নারীদের পাতার নাম ঠিক হলো ‘নারীমঞ্চ’, পাঠকের পাতার নাম ঠিক হলো ‘বন্ধুসভা’, তারপর তারকাদের নিয়ে যে পাতা হবে তার নাম ঠিক করা হলো -আনন্দ।

শিশুদের যে পাতা হবে তার নাম ঠিক হলো গোল্লাছুট। সবার মধ্যেই দূর্দান্ত উত্তেজনা। প্রতিদিনই নতুন কিছু না কিছু ঠিক হচ্ছে। কিন্তু একদিন মতিভাই অফিসে এসে সবাইকে একসাথে ডেকে বললেন, আমাদের পত্রিকার নাম ‘একুশে’ হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? তিনি জানালেন, একুশে নামে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুমোদন নেওয়া আছে। ‘একুশে’ নামে টেলিভিশন মানে সেই জনপ্রিয় একুশে টিভি। তাহলে আমাদের পত্রিকার নাম কী হবে? আনিসুজ্জামান স্যার এর পরামর্শ অনুযায়ি সবার সম্মতিতে পত্রিকার নাম ঠিক হলো-প্রথম আলো। মফিদুল হকও ‘প্রথম আলো’ নামটাই প্রস্তাব করেছিলেন বলে শুনেছি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’ উপন্যাস তখন খুব আলোচিত। কিন্তু আমরা তো আর সুনীলের উপন্যাস থেকে এই নাম নেই নাই, আমরা নিয়েছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  ‘প্রথম আলো’ কবিতা থেকে। সাজ্জাদ ভাই, আনিস ভাইরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রথম পাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রথম আলো’ কবিতাটি ছেপে দেওয়া হবে। তাই হলো। ‘প্রথম আলো’ কবিতা সহ প্রথম আলোর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হলো ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর।  

প্রথম আলোর চরণধ্বনি উঠল বেজে যেই
নীড়বিরাগী হৃদয় আমার উধাও হল সেই॥
নীল অতলের কোথা থেকে উদাস তারে করল যে কে
গোপনবাসী সেই উদাসীর ঠিক-ঠিকানা নেই॥
‘সুপ্তিশয়ন আয় ছেড়ে আয়’ জাগে রে তার ভাষা,
সে বলে ‘চল্ আছে যেথায় সাগরপারের বাসা’।
দেশ-বিদেশের সকল ধারা সেইখানে হয় বাঁধনহারা,
কোণের প্রদীপ মিলায় শিখা জ্যোতিসমুদ্রেই॥

আমরা পরিচিত হলাম নতুন আরও দুইজন বড় মাপের মানুষের সঙ্গে- লতিফুর রহমান এবং মাহফুজ আনাম। সে কি উত্তেজনা আমাদের। আমি গোল্লাছুট পাতার বিভাগীয় সম্পাদক। কোন দিন কোন সংখ্যায় কি ছাপা হবে সেই নিয়ে সারাদিন চিন্তাভাবনা, বই ঘাটাঘাটি। তখন তো এমন ইন্টারনেট জামানা ছিল না। সবেমাত্র ইমেইল চালাচালি শুরু হয়েছে। আর আমরা ফ্লপি ডিস্ক ছেড়ে পেনড্রাইভের জামানায় ঢুকছি। 

নতুন পত্রিকার যাত্রায় খুব মন খারাপের বিষয় ছিল, অমীত হাবিবের নেতৃত্বে নিউজ টিমের অনেকেই থেকে গেলেন ভোরের কাগজের সঙ্গে। আমিনুর রশীদ, জ.ই. মামুন, মুন্নি সাহা, জায়েদুল আহসান পিন্টু, প্রভাষ আমীন, পারভেজ চৌধুরীসহ আরও অনেকেই। এদিকে নতুন টেলিভিশন চ্যানেল ‘একুশে টিভি’ গোছানোর দায়িত্ব পড়ল আবেদ খান এবং মিশুক মুনিরের উপর। সায়মন ড্রিং এবং ফরহাদ মাহমুদ এর ইচ্ছানুযায়ি তারা একুশে টেলিভিশন গোছানোর কাজ শুরু করলেন। আবেদ খান তখন ভোরের কাগজে একটা কলাম লিখতেন ‘টক অব দ্যা টাউন’ নামে। তিনি দেখলেন আমিনুর রশীদ, জ.ই. মামুন, মুন্নি সাহা, তুষার আব্দুল্লাহ, ইব্রাহিম আযাদ এর মতো সুন্দর একটা টিম রয়ে গেছে ভোরের কাগজে। তিনি টিমের বেশির ভাগ ছেলেমেয়েকে নিয়ে নিলেন ‘একুশে টিভি’ তে। তারা স্টার হয়ে গেলেন। 

প্রথম আলো-ও তখন বীরদর্পে এগিয়ে চলছে। দুর্দান্ত একটি রিপোর্টিং টিম এবং ফিচার টিম নিয়ে পঞ্চাশ হাজার, এক লাখ, দুই লাখ, আড়াই লাখ, চার লাখ সার্কুলেশন। বাংলাদেশের পত্রিকার ইতিহাসে অবিশ্বাস্য এক যাত্রা। আমিও ‘গোল্লাছুটে’র পাশাপাশি মাদক বিরোধী আন্দোলন, এসিড বিরোধী আন্দোলন যুক্ত হয়ে গেলাম। মাঝেমাঝে মেরিল প্রথম আলো তারকা পুরস্কার, আনন্দ, বন্ধুসভার দায়িত্বও পালন করে চললাম। 

একটা ঘটনা বলি, প্রথম আলো মাদক বিরোধী আন্দোলনের আমি তখন সদস্য সচিব। ঢাকার উইমেন্স কমপ্লেক্স-এ মাদক বিরোধী কনসার্ট করা হবে। বড় বড় সব ব্যান্ড দল অংশ নিবে। আমরা আশা করছি বার থেকে পনের হাজার দর্শক সমাগম হবে। বিশাল আয়োজন। সদস্য সচিব হিসেবে আমার উপর দায়িত্ব পড়ল সব ঠিক করার। কনসার্টের আগের দিন রাতে মতি ভাই ডাকলেন। মতিভাই ডাকা মানেই খবর আছে। ঠিক যে  জায়গাটাতে দূর্বলতা সেটাতেই পয়েন্ট আউট করবেন আগে। তাই আনিস ভাই ছাড়া আমরা কেউই সেখানে যেতাম না। আনিস ভাই আমাদের ঢাল। আমরা জানতাম যতকিছুই ঘটুক আনিস ভাই আমাদের বাঁচাবেন। সব বিষেয় নিয়ে কথা বলতে বলতে মতি ভাই জিজ্ঞাসা করলেন, এই যে বারহাজার মানুষ হবে এরা টয়লেট করবে কোথায়। তোমাদের ওইখানে কয়টা টয়লেট আছে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ঠিকই তো, ধানমন্ডি মহিলা কমপ্লেক্সে মাত্র চারটা-চারটা আটটা টয়লেট। মতিভাই বললেন মহিলা কমপ্লেক্সের ওয়ালের চারপাশ ঘিরে ত্রিশটা টয়লেট বানিয়ে ফেল। 

সরারাত লোকজন নিয়ে ত্রিশটা টয়লেট বানানো হল। আইয়ুব বাচ্চুর এলআরবি, মাইলস থেকে শুরু করে পনেরটার মতো বড় বড় ব্যান্ড দল গান গাইল। পনের হাজারের মতো দর্শক সমাগম হলো। কোনো অঘটন ছাড়াই সবাই ঠিক মতো বাড়ি ফিরে গেল। 

এই ঘটনাটা এই জন্য বললাম, প্রথম আলো টিমের প্রায় সবারই ভাবনার বাইরে গিয়ে ভাববার ক্ষমতা আছে, সবার মধ্যে একটা দুর্দান্ত গতি তৈরি করার ক্ষমতা আছে। মতি ভাই, সাজ্জাদ ভাই, আনিস ভাই, সুমি আপাদের সঙ্গে কাজ করে সবার মধ্যে যে গতি তৈরি হয়, আইডিয়া জেনারেট করার যে অভ্যাস তৈরি হয় সেটা দিয়ে পরের দুই-তিনটা অর্গানাইজেশনে কাজ করা যায় অপ্রতিদ্বন্দী ভাবেই। 

তাই প্রথম আলো ছেড়ে এলেও প্রথম আলোকে ছাড়া যায় না। প্রথম আলোর সঙ্গে যুক্ত হওয়া যায়, প্রথম আলো থেকে বের হওয়া যায় না।  

৪ নভেম্বর, ২০২২ চব্বিশ বছর পূর্ণ করছে প্রথম আলো। দুই যুগ। কতজন প্রথম আলো ছেড়ে গেছে, নতুন কতকত মুখ যুক্ত হয়েছে কিন্তু ‘প্রথম আলো’ আছে তার মতোই আলোর ইসকুল হয়ে। শুভ জন্মদিন প্রথম আলো। 

শামীম শাহেদ
নভেম্বর, ২০২২, কুইন্স, নিউইয়র্ক, (প্রাক্তন) সহ-সম্পাদক, ভোরের কাগজ। সিনিয়র সহ-সম্পাদক, প্রথম আলো। অনুষ্ঠান প্রধান, বাংলাাভিশন। অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপক, একুশে টেলিভিশন। জাজ, মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড। মিডিয়া কনসালটেন্ট, এডিবি (ইউজিপ-টু)।

শেয়ার করুন: