শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

ডাকাত পিকে হালদারকে কি সবাই ভুলে গেছেন?

শামসুদ্দীন আজাদ

আপডেট: ২১:৫৪, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২

ডাকাত পিকে হালদারকে কি সবাই ভুলে গেছেন?

ফাইল ছবি

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে অর্থ কেলেংকারির সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে প্রশান্ত কুমার ওরফে পিকে হালদার। কিভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের এই দেশে একজন হিন্দু ডাকাত সকলের নাকের ডগায় বসে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশ থেকে এতগুলো টাকা লুটপাট করে নিয়ে গেল- আমরা কেউ জানলাম না, বুঝতেও পারলাম না। সে নিশ্চয় কারো না কারো আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এমন অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। সে তো রাতারাতি এই টাকা চুরি করেনি। দিনের পর দিন এদেশে চাকুরি করেছে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক, যেটি রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেয়া সেই ব্যাংকে তাকে এম. ডি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এটি প্রাইভেট ব্যাংকের এমডি হয়ে সে কিভাবে টাকা লুটপাট করে সহজে পার পেয়ে গেল।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং এর নিয়মানুযায়ী একটি ব্যাংকের প্রতিদিনের লেনদেন শেষে যখন দিনের হিসাব ক্লোজ করা হয় তখন দিন শেষে  তা লেজার বুকে উঠানো লাগে। আজ সারাদিন উক্ত শাখায় কত টাকা লেনদেন হলো কাস্টমার একাউন্টে, কত টাকা ক্যাশ জমা হলো কত টাকা পেমেন্ট করা হলো লোন একাউন্টে, কত টাকা জমা হলো, কত টাকা লোন দেয়া হল, ব্যাংকের প্রতিদিনের খরচ কতো হলো অর্থাৎ সব মিলিয়ে এক দিনের চূড়ান্ত হিসেবের সমস্ত ভাউচারগুলি লেজার বা ঈধংয ইধষধহপব ইড়ড়শ-এ দেখানো হয়। নিয়ম অনুযায়ী ঈধংয ইড়ড়শ এ উবনরঃ ধহফ ঈৎবফরঃ দুই দিক মিলে গেলে এবং একই সাথে ঈধংয রহ যধহফ অর্থাৎ আজকে ব্যাংকের ঠড়ঁষঃ এ কত টাকা ক্যাশ আছে। ঋরীবফ উবঢ়ড়ংরঃ কত আছে সব হিসাব করে মিলে গেলেই ঈধংয ইধষধহপব ইড়ড়শ তৈরি করা হয়। সেখানে ব্যাংকের ক্যাশিয়ার, একজন কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শাখার ম্যানেজার সই করে সব কিছু নিশ্চিত করেন। এরপর রিপোর্টটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক তাদের জবমরড়হধষ ঙভভরপব এ পাঠায়, জবমরড়হধষ ঙভভরপব বাংলাদেশ ব্যাংকে সেই হিসেবের টঢ়ফধঃব পাঠায়। আগে তো বিশাল খবফমবৎ ইড়ড়শ গধরহঃধরহ করা হতো, এখন তো সব আধুনিক পদ্ধতি ঈড়সঢ়ঁঃবৎ এ ঝবঃঁঢ় করা প্রতিদিনের রিপোর্ট বাংলাদেশ বাংকে পাঠানো হয়। আমি বাংলাদেশের বেসরকারি প্রাইভেট ব্যাংক ঘধঃরড়হধষ ইধহশ খঃফ. এ চাকুরি করেছি ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত।

উল্লেখ্য যে, কোন কারণে যদি হিসেবের গড়মিল হয় তখন সব কর্মকর্তারা সব কাগজপত্র ঠড়ঁপযবৎ পুনরায় চেক করে হিসাব মিলিয়ে ব্যাংক থেকে বের হন। এমনকি ঈধংয টাকার যদি ঝযড়ৎঃ হয় সেখানেও ক্যাশিয়ারকে জবাবদিহি করতে হয়। নিজের পকেট থেকে দিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করতে হয়। এটাই হল ব্যাংকের প্রচলিত নিয়ম এবং এর কোন ব্যাতিক্রম হয় না। এরপরও কিভাবে পিকে হালদার ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে সহজে নিয়ে যেতে পারলো এটি আমার মাথায় আসে না। শুধু পিকে হালদার নয় এভাবে দিনের পর দিন বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যারা নামে-বেনামে ভূয়া কোম্পানীর নাম দেখিয়ে টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডি, ডিরেক্টর, কর্মকর্তা, ব্যাবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব, এভাবে দেশের সমস্ত ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন স্বাধীনতার পর থেকে বিশেষ করে ৭৫ এর পর থেকে দেশের আর্থিক খাতে এমন লুটপাটের প্রবরণতা তৈরি হয়েছে। এটি শুরু করেছিলেন স্বৈরাচারি মিলিটিারি শাসকরা আর এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন সব গণতান্ত্রিক সরকারগুলো। এখন কথা হলে এই যে ব্যাংকগুলো থেকে এতগুলো টাকা লুটপাট হলো, পাচার হলো দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করে লুটপাটের স্বর্গরাজ্য বানানো হলো। আর এখন জোরে জোরে আওয়াজ তোলা হচ্ছে- দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে, ওদের চিহ্নিত করতে হবে। কারা পাচারকারি, কোথায় তারা এই অর্থ পাচার করেছে, বিশে^র বিভিন্ন দেশে যে যেখানে সুযোগ পেয়েছে সে সেখানে টাকা গচ্ছিত রেখেছে অথবা সুইসব্যাংকে জমা করেছে। ব্যাবসায়ীদের আরও একটু বাড়তি সুবিধা তারা যখন বিদেশে পণ্য রফতানী করে রফতানী পণ্যের যে মূল্য তারা বিদেশীদের কাছ থেকে পায়, সেই টাকাগুলো ঙাবৎ রহাড়রপব-টহফবৎ রহাড়রপব এর মাধ্যমে বিদেশের ব্যাংক একাউন্টে জমা রেখে দেয়। প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের যারা নিয়ন্ত্রক, সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় থেকে সরকারি দায়িত্ব পালন করছেন, সরকারের প্রেষণে নিযুুক্ত প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তারা তারা কি ভূমিকা পালন করেছেন, কিভাবে তাদের চোখের সামনে দিয়ে বছরের পর বছর পিকে হালদারের মত কুখ্যাত ডাকাত দেশের অর্থনীতিকে আঘাত করতে পারলো। এজন্য প্র্রথমত আমি দায়ী করবো বাংলাদেশ ব্যাংককে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক ব্যাংক। সব ব্যাংক তাদের লেনদেন ও কর্মকা-ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ। প্রতিটি ব্যাংকের লেনদেনের চিত্র বাংলাদেশ ব্যাংক দেখছে, এমনকি প্রতিটি ব্যাংকে বছরে দুইবার অডিট টিম পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। সুতরাং অডিট টিমকে ফাঁকি দিয়ে কোন দূর্নীতির সুযোগ থাকে না, তাহলে কিভাবে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে এত টাকা লুটপাট হলো। বিদেশে পাচার হল আর বাংলাদেশ ব্যাংক জানবে না এটা বিশ^াসযোগ্য নয়। এটা নিশ্চিত করে বলা যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের যোগ সাজসে এই কাজগুলো হয়ে আসছে। এরপর দায়িত্ব বর্তায় অর্থমন্ত্রণালয়ের উপর, তার দুর্নীতি দমন কমিশন, সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন সরকারি গোপন তদারকি সংস্থার উপর। এতগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ফাঁকি দিয়ে পিকে হালদারের মত একজন হিন্দু লুটেরা দেশ থেকে ১১ হাজার কোটি টাকা গায়েব করলো আর আপনারা কি বসে বসে আঙ্গুল চুষেছেন? রাষ্ট্রের এত বড় সর্বনাশ করতে আপনারা সকলে সহযোগিতা করেছেন। সকলে মিলে পিকে হালদার থেকে টাকা খেয়েছেন। পাচার কাজে আপনারা সহযোগিতা করেছেন আর যদি বলেন আপনারা জড়িত নন একাজে তাহলে বলতে হবে আপনারা কেন টের পেলেন না এত বড় ডাকাতির বিষয়টি। তাহলে বলতে হবে আপনাদের কোন যোগ্যতা নেই প্রজাতন্ত্রের চাকুরি করার। আপনারা মাস শেষে আপনাদের সরকারি বেতন ভাতা নিয়ে যান, সরকারি গাড়ি বাড়ি সহ সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন অথচ সরকারের বা দেশের এতবড় সর্বনাশ হয়ে গেল আপনারা কিছুই জানেন না। এটি ভীষন লজ্জার এবং চরম দূর্ভাগ্যের বিষয়।

জাতির পিতা দেশটাকে এজন্য স্বাধীন করে দিয়ে যাননি। বাঙ্গালী জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি জীবনের ১২টি বছর জেল খেটেছেন। পাকিস্তানি মিলিটারি শাসকদের নির্যাতন সহ্য করেছেন। আজ আপনারা জাতির পিতাকে যেমন অপমান করেছেন তেমনি অপমান করেছেন তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। আপনারা প্রজাতন্ত্রের এত শিক্ষিত কর্তাব্যাক্তি, বড় বড় ব্যাংকার, বড় বড় বুদ্ধিজীবী টক শোতে বসে পা-িত্য ঝাড়েন সরকারেরও সমালোচনা করেন কিন্তু পিকে হালদারকে নিয়ে কিছু বলেন না।

পিকে হালদার দেশে অসংখ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। যেগুলোর অনুমোদন দিয়েছে অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রনালয়। তার কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে (১) পি এ- এল এগ্রো (২) পি এ- এল বিজনেস এন্টারপ্রাইজ (৩) পি এন এল এগ্রো (৪) পি এন এল বেঞ্চার (৫) পি এন এল ইন্টারন্যাশনাল (৬) হাল ট্রাভেল (৭) হাল ইন্টারন্যাশনাল (৮) হাল ট্রিপ (৯) হাল ক্যাপিটেল (১০) হাল টেকনোলজি (১১) সুখাদা লিমিটেড (১২) আনন ক্যামিকেল (১৩) নর্দান জুট (১৪) এইচ এল ইন্টারন্যাশনাল (১৫) মৃধা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এ- ঋরহধহপরধষ ঝবৎারপব (১৬) কোলাসিন (১৭) চবড়ঢ়ষবং খবধংরহম ধহফ ঋরহধহপরধষ ঝবৎারপব এরকম তার ৪০টি প্রতিষ্ঠান।

পিকে হালদার এ টাকা পাচার করেছেন কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত সহ বিভিন্ন দেশে। তিনি কলকাতায় এসে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। বর্তমানে কলকাতার জেলে বন্দী। তাকে দেশে পাঠানোর নিয়ম থাকলেও ভারত সেটি করছে না। তাকে বাংলাদেশে ফেরানো খুব জরুরি কারণ এত বড় জালিয়াতির পেছনে কারা জড়িত, কাদের সহযোগিতায় তিনি দেশের অর্থ পাচার করেছেন সে বিষয়টি জানার চেয়ে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা অতীব জরুরি।

শেয়ার করুন: