বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

ভেতো বাঙালির ‘মিশরীয় খানা’

হাবিব রহমান

আপডেট: ০৯:৩৯, ২৫ জুলাই ২০২২

ভেতো বাঙালির ‘মিশরীয় খানা’

ভেতো বাঙালির মিশরীয় খানা

আমার মিশরীয় গাইড ইব্রাহিমকে বললাম, ‘দোস্ত তারকা হোটেলের খানা খেয়ে খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গেছে এবার ভিন্ন কিছু খাওয়াও’। সে বললো- ‘আগামীকাল তোমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাবো যা চিরদিন তোমার মনে থাকবে’।

পরদিন দুপুরে ইব্রাহিম আমাকে তুলে নিলো হোটেল থেকে। একটু পর শহরের সীমা শেষ হলো। মরুভূমির বুক চিড়ে গাড়ি চলছে। চারদিকে শুধু বালি আর বালি। থামার কোন লক্ষণ নেই। অবশেষে আমার সব উৎকন্ঠার অবসান ঘটিয়ে গাড়ি এসে থামলো একটা মরুদ্যানে। চারদিকে খেজুর গাছের সারি। গেটে গিয়ে গাড়ি থামলো। নামতে যাবো তখনই ইব্রাহিম ইশারা করলো বসে থাকতে। একটু পরেই গাড়ির দরজার কাছে বাঁশি আর ঢোল বাজাতে বাজাতে আসলো দু’জন লোক। গাড়ির চারদিকে ঘুরে ঘুরে তারা নেচে নেচে বাজনা বাজাতে লাগলো সাথে আরবীয় ভাষায় গান। এবার ইব্রাহিম নামতে বললো। বাদকদল আমাকে ঘিরে শুরু করলো নাচ আর গান। এরপর তাদের অনুসরণ করতে ইশারা করলো। তারা বাদ্য বাজাতে বাজাতে আমাকে নিয়ে গেলো মরুদ্যানের ভিতরে একটা বিশাল রেস্টুরেন্টে। চারদিকে খেজুর গাছ। উপরে খেজুর পাতার ছাউনি। নীচে কয়েকশত চেয়ার পাতা।

ইব্রাহিম এসে খাবার অর্ডার করলো আরবী ভাষায় কিচির মিচির করে। আমি মাথা ঘামাইনি। তার রুচির প্রতি আমার আস্থা আছে। যতবারই আমি মিশর আসি ইব্রাহিম আমার সাথে ছায়াসঙ্গীর মত থাকে। এদেশে সে আমার গাইড, মেন্টর আর বিশ্বস্ত বন্ধু। যার উপর পরম নিশ্চিন্তে নির্ভর করা যায়।

একটু পর আসতে শুরু করলো খাবার। মাথায় খাঞ্চায় করে খাবার আনছে পরিচারক। আসছে, আসছে তো আসছেই। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। মানুষকে আমরা মাত্র দু’জন। এতো খাবার কে খাবে!

ইব্রাহিম যেন আমার মনের ভাবনাগুলো পড়তে পারলো। বললো ভয় পেও না। এগুলি খাবারের একটা প্যাকেজ। অল্প খাও আর বেশি খাও দাম একই। তাছাড়া এখানে মিশরীয়রা দলবেধে খেতে আসে। তোমার মত একা তো কেউ আসে না!

তবে তোমার ভয় পাবারও কোন কারণ নেই। আমেরিকান ডলার আর মিশরের পাউন্ডে দামে এতই পার্থক্য যে যত খাবারই খাও ডলারের দামে তা হবে খুবই অল্প মূল্য। আমি ইব্রাহিমকে বললাম, না টাকার কথা ভাবছি না। খাবারগুলো অপচয় হবে শুধু তাই ভাবছি। ইব্রাহিম এবার তাড়া দিলো আমাকে। বললো শুরু করো দোস্ত। এতো মাত্র এপিটাইজার। মুল খাবার আসবে একটু পরে। ভাবলাম এই যদি এপিটাইজার হয় মুল খাবার কত পদের আসে কে জানে!

অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর। আমি বিসমিল্লাহ বলে শুরু করলাম। ইব্রাহিমকেও বললাম শুরু করতে। সময়  ক্ষেপন করে কি লাভ? বিল যখন দিতে হবে তখন খেতে তো হবেই!

এপিটাইজার পর্বের পরীক্ষা কোন মতে পাস করলাম। এবার আশা শুরু করলো মুল খাবার। একটা করে খাবার আসে। ইব্রাহিম তার গুনাগুন বর্ণনা শুরু করে। প্রথম যে খাবারটি এলো তার নাম-তামেয়া। ইব্রাহিমের ভাষায় এটি মিশরের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সুস্বাদু খাবারের একটি। মটরশুটি পেস্ট, পেয়াজ এবং প্রচুর তাজা শাক-শব্জীর সংমিশ্রণে এটি তৈরি। মিশরের প্রায় সকল স্তরের মানুষের নিকট এটি অত্যন্ত পছন্দের খাবার।

ইব্রাহিম বললো টেস্ট কর। একটু মুখে দিলাম। ও বললো  দারুন না। আমি অতি কষ্টে গিলে বললাম , হ্যাঁ হ্যাঁ -অবশ্যই দারুন !!

এবার দ্বিতীয় খাবারটি কাছে টানলো ইব্রাহিম। আরো উৎসাহ নিয়ে বললো এই খাবারটির নাম মুলুখিয়াহ। এটি বিভিন্ন উদ্ভিদ থেকে তৈরি মিশরের আরো একটি জনপ্রিয় খাবার। মুলুখিয়াহ এর সাথে ভাত মিশিয়ে লেবু মিশিয়ে খাও, দারুন লাগবে।

আমি বললাম, তা হবে ক্ষণ। এখন পরবর্তী খাবারটার গুনাগুন একটু বলো তো দেখি!

পাতলা নুডুলসের মতো খাবারটি দেখিয়ে ইব্রাহিম বললো এর নাম-কানাফেহ। এটা এক ধরনের এরাবিয়ান মিস্টি ডেজার্ট। ময়দা, বাদাম, চিনি ও বিভিন্ন উপাদান দিয়ে তৈরি হয়। প্রাচীন মিশরীয় যুগে খলিফাদের ক্ষুধা নিবারনের জন্য এই খাবারটি তৈরি করা হতো। বর্তমানে মিশরের স্ট্রিট ফুড হিসাবে এটা খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একটু চেখে দেখো দোস্ত- সারাজীবন ভুলতে পারবে না।

আমি তার কথায় কান না দিয়ে আরেকটা স্যুপ জাতীয় খাবারের দিকে ইশারা করলাম। ইব্রাহিম বললো এটা মিশরের জনপ্রিয় স্যুপ, নাম-বিশারা। মটরশুটির সাথে জলপাই তেল, লেবুর রস, ঝাল লাল মরিচ, জিরা এবং লবণ মিশিয়ে তৈরি করা হয়এই বিশারা। মিশর ছাড়াও ফিলিস্তিনে এই খাবারের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। আমার দিকে বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বললো এর সাথে একটা লেবুর টুকরা আর কাঁচা মরিচ মিশিয়ে একটু মুখে দাও মনে হবে অমৃত খেয়েছো।

আমার আর অমৃত খাওয়ার রুচি ছিলো না। ১২ পদের এপিটাইজার খেয়ে দম বন্ধ হবার উপক্রম। ইব্রাহিম কে বললাম দোস্ত বিলটা আনতে বলো। আর খাবারগুলো প্যাকেট করে বাসায় নিয়ে যাও। তোমার বাচ্চারা খেয়ে খুশি হবে। মনে হলো সে খুব কষ্ট পেয়েছে। তারপর মুখে একটা কষ্টের হাসি ফুটিয়ে বললো যাচ্ছি। তবে এই খাবার খেয়ে তুমি যে খুশি হতে পারনি তা বিলকুল বুঝতে পারছি। আগামীকাল তোমাকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাব গরুর গোস্ত দিয়ে ভাত খাওয়াতে।

শেয়ার করুন: