শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

প্রিয়ভাষীণির শিল্পকর্ম সংরক্ষণের দাবিতে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন

ঢাকা অফিস

আপডেট: ২০:৫৪, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

প্রিয়ভাষীণির শিল্পকর্ম সংরক্ষণের দাবিতে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন

শিল্পকর্ম সংরক্ষণের দাবিতে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন

স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর শিল্পকর্মসহ তাঁর স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। পাশাপাশি তাঁর শিল্পকর্মের চৌর্যবৃত্তি রোধেরও দাবি জানানো হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে জাগরণ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন ভাস্কর ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর কন্যা ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী। আরও বক্তব্য দেন অভিনেত্রী শম্পা রেজা, জাগরণ সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের নির্বাহী সভাপতি ও আবৃত্তিশিল্পী শওকত আলী, মানবাধিকারকর্মী শারমিন শামস মুনমুন, লেখক শাশ্বতী দীপ্ত ও তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা শাহাদাত রাসেল।

সভাপতির বক্তব্যে শাহরিয়ার কবির বলেন, ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর শিল্পকর্ম সংরক্ষণ না হওয়ায় তা নানাভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। তাঁর শিল্পকর্ম চৌর্যবৃত্তি হচ্ছে। শিল্পকর্মগুলো সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণ করা দরকার। তবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকর্মগুলো কপিরাইট করা ঠিক নয়। সবার জন্য উন্মুক্ত থাকতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার প্রতিটি উপজেলায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এখনও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা অবিলম্বে সরকারকে প্রতিটি উপজেলায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের দাবি জানাচ্ছি।’

শম্পা রেজা বলেন, ‘শিল্পকর্ম নকল করা, কপি করাও শিল্পসন্ত্রাস। এসব ব্যাপারে সরকারের চোখ বন্ধ কেন? ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন কপি হয়ে যাচ্ছে। এসব ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। তিনি এ সময় চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে শাস্তিরও দাবি করেন।

শওকত আলী বলেন, সরকার উদ্যোগ নিলে জাতীয় জাদুঘর ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর শিল্পকর্ম সংরক্ষণ করা সম্ভব। তিনি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান।

লিখিত বক্তব্যে ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী বলেন, একাত্তরের বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর অনবদ্য সৃষ্টিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাকে পরিচিত করেছিলেন কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। তাঁর শিল্পকর্মগুলো কেবল দৃষ্টিনন্দনই নয়, এই শিল্পকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার এবং যুদ্ধপরবর্তী সময়ে পরিবার ও সমাজে নিগৃহীত একজন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা নারীর আগুনপাখি ফিনিক্স হয়ে ওঠার গল্প। কিন্তু শিল্পকর্মগুলো চৌর্যবৃত্তি হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে সংরক্ষণের অভাবে।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘সম্প্রতি নিউইয়র্কে অধিক পরিচিত ও নিউজার্সিতে বসবাসরত প্রবাসী জনৈক আখতার আহমেদ রাশা নিউইয়র্ক, ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে ভাস্কর ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর বিভিন্ন সময়ের ভাস্কর্যসমূহের নকল করে মৌলিক শিল্পকর্ম হিসেবে প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি আরও কেউ কেউ ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর শিল্পকর্ম সামান্য পরিবর্তন বা বিকৃত করে নিজেদের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন। মৌখিকভাবে বহুবার অনুরোধের পরও আখতার আহমেদ রাশার এ চৌর্যবৃত্তিকে নিবৃত্ত করা সম্ভব হয়নি, তাই আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছি।’ তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর রেখে যাওয়া অমূল্য ভাস্কর্যসমূহ যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ এবং সরকারের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।

ফুলেশ্বরী নন্দিনী বলেন, ‘একজন অগ্রজ শিল্পীর শিল্পকর্ম, মাধ্যম, দর্শন বা জীবনবোধ দ্বারা যে কোনো ব্যক্তি বা শিল্পী অনুপ্রাণিত হতেন পারেন। কিন্তু অনুসরণ আর অনুকরণের মধ্যে যে পার্থক্য তা অনুধাবন করা জরুরি। অনুকরণ, নকল বা কপি করা কাজ কখনো মৌলিক শিল্পকর্ম হিসেবে প্রদর্শিত হতে পারে না। এটি নন্দনতত্ত্বের নৈতিকতার পরিপন্থি। ক্রমাগত নকল করে প্রকৃত শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পরিবর্তে বরং তার সমগ্র জীবনের সাধনাকে অসম্মান করা হয়। আমি নিজে শিল্পচর্চার সঙ্গে যুক্ত থেকে অনুসরণকে উৎসাহ দিলেও অনুকরণকে স্বাগত জানাতে পারি না। তাই সঙ্গত কারণে এই অশিল্পীসুলভ আচরণের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি। যেহেতু মৌখিকভাবে বহুবার অনুরোধের পরও আখতার আহমেদ রাশার এ চৌর্যবৃত্তিকে নিবৃত্ত করা সম্ভব হয়নি, তাই আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, “আমার মা ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান এবং শিল্পকর্মের জন্য ২০১০ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক’ পেয়েছেন। স্বাধীনতার পর পরিবার ও সমাজের সকল নিগ্রহ আর অবজ্ঞা অগ্রাহ্য করে বেঁচে থাকার অমোঘ বাসনায় প্রিয়ভাষিণী পথ চলতে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন মরা ডালপালা, গাছের শেকড়-বাকল। পরিত্যক্ত সামগ্রীর মাঝে সমাজের কাছে অবহেলিত নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। বেঁচে থাকার অবলম্বন, অদম্য সাহস আর আত্মবিশ্বাস থেকে সৃষ্টি করলেন নান্দনিক সব ভাস্কর্য। সেইসব অনবদ্য সৃষ্টিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে, শিল্পী হিসেবে প্রিয়ভাষিণীকে পরিচিত করতে উদ্যোগী হন কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান।”

‘মূলত, কুড়িয়ে পাওয়া ও পরিত্যক্ত গাছের গুঁড়ি, শুকনো ডাল, বাঁশ, পানিতে ভেসে আসা কাঠের খ-, গাছে জন্য নেয়া ছত্রাক ইত্যাদি ছিল প্রিয়ভাষিণীর ভাস্কর্য তৈরির উপকরণ ও মাধ্যম। দেশে-বিদেশে শিল্পানুরাগীদের কাছে সমাদৃত এ ভাস্কর্যগুলো কেবল দৃষ্টিনন্দনই নয়, এই শিল্পকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার এবং যুদ্ধপরবর্তী সময়ে পরিবার ও সমাজে নিগৃহীত একজন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা নারীর আগুনপাখি ফিনিক্স হয়ে ওঠার গল্প।’

‘সরকারি-বেসরকারি সকল জাদুঘর, সংগ্রহশালা- সর্বোপরি রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের ভাস্কর্য সংরক্ষণে এগিয়ে আসা। এগুলো আমাদের জাতীয় সম্পদ সময়ের মহামূল্যবান নিদর্শন। এসব সম্পদকে কেন্দ্র করে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অসাধুতা গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রের একজন সচেতন নাগরিক এবং মহীয়সী মায়ের সন্তান হিসেবে আমি মনে করি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর রেখে যাওয়া অমূল্য ভাস্কর্যসমূহ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন।’

শাশ্বতী বিপ্লব বলেছেন, চাইলেই তো শিল্পী হওয়া যায় না। নিজের ভিতরে সেই মেধার জায়গাটা থাকতে হয় সেই সত্তাটা থাকতে হয়। তো সেটার যখন ঘাটতি পরে তখন কেউ যদি বিখ্যাত নাও হন সম্মানিত না হন তাও তার সৃষ্টি কিন্তু আমি নকল করতে পারি না, সেটা অন্যায়, সেটা গর্হিত অপরাধ।

 

শেয়ার করুন: