তৃণমুলের বন্ধুরা এবার ভাববেন কি?
তৃণমুল দলটির নাম এখন মুখে আনছি না। পশ্চিমবাংলায় এ রকম একটি দল তৈরি হলো এবং তারা দশ বছর ধরে শাসনক্ষমতায় বসে আছে-এই বিস্ময়কর ঘটনা আজ অনেককেই মেনে নিতে হয়েছে, কারণ পরিবর্তনের জোয়ার তুলে তথাকথিত ‘মানুষের ভোটে’ তারা নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের নির্লজ্জ লুটতরাজ ছাড়া আর কোনও নীতি নেই, রাজনীতিতে মুহুর্মুহু ডিগবাজি খেতে চক্ষুলজ্জাও নেই, বাংলায় বেপরোয়া ভোটলুট, কাটমানি, তোলাবাজির সংস্কৃতিকে তারা শিল্প করে তুলেছে।
তার নেত্রী অশিক্ষা আর মুর্খতার দেবী হয়েও একটি জাল ডক্টরেট নিয়ে রাজনীতিতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, কথায় কথায় তার আকাশ সমান অজ্ঞতা, মিথ্যাচার আর প্রভাবশালী মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘটনায় তার প্রথমে নৈঃশব্দ, পরে মন্তব্য বিস্ময়কর। সেই ডাকসাইটে মন্ত্রী এখন জেল হেফাজতে। তার সম্বন্ধে যে নারকীয় খবরাখবর বেরোচ্ছে কাগজে, টেলিভিশনে, হয়তো আরও অনেক কিছু বেরোবে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখা।
দলের সদস্য, অনুগামী, আর অনুরাগী সকলেই নিশ্চয়ই দলের বন্ধু। আমরা তো আর বন্ধু নই, আমরা জানি যে এই দল শুধু বাংলার সুনাম নর্দমাতে ডোবায়নি, গত দশ বছরে বাংলার সর্বনাশও ডেকে এনেছে। পরিবর্তনের নামে জোয়ার এনে বাম দলকে হটিয়ে ক্ষমতায় এসে পশ্চিমবাংলার যে ক্ষতি হয়েছে তা একশো বছরে পূরণ হবার নয়। শিল্প নেই- তেলেভাজার বিজ্ঞাপন ছাড়া, লক্ষ লক্ষ বেকার, তাতে উচ্চশিক্ষিত থেকে নিরক্ষর আছে, যোগ্য ছেলেমেয়েদের বঞ্চিত করে অযোগ্যদের চাকরি দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা এই দল ঘরে তুলেছে। একটি কাতলামাছ ধরা পড়েছে (পার্থ চ্যাটার্জি), কিন্তু অন্যদের অতলের রাঘব বোয়ালদের, কৃতিত্বও শিগগিরই ধরা পড়বে, যদি না প্রাণপণ সেটিংয়ের খেলা শুরু হয়ে যায়। রাজ্যের মানুষকে ভিক্ষুক আর অপরাধপ্রবণ করে তুলে তাদের চিরদাসত্বে বেঁধে রাখার পরিকল্পনা করে এ দল এগিয়েছে, তাই শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস না করে এদের স্বস্তি নেই। পুলিশকে নিজেদের অপরাধ চক্রে জড়িয়ে দলের পদলেহী দাস করে তুলেছে। হত্যা, নারীধর্ষণের স্বর্গরাজ্য নেমে এসেছে পশ্চিমবাংলায়, অপরাধীরা ওই দলের লোক বলেই শাস্তি হয় না, হচ্ছে না। স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়, লাইব্রেরীতে শিক্ষক আর কর্মীর লক্ষ লক্ষ পদ খালি, প্রাথমিক স্কুল উঠে যাচ্ছে, স্কুলগুলো শিক্ষক আর কর্মীর অভাবে ধুঁকছে, আর সীমাহীন দুর্নীতি করে এরা যোগ্যদের বঞ্চিত করে অযোগ্য দলদাসদের চাকরি দিয়েছে। আস্তে আস্তে খবরগুলো প্রকাশ্যে আসছে, গা ঘিনঘিন-করা সব খবর। পাঁচশো দিনের বেশি রোদবৃষ্টি মাথায় করে কলকাতা ময়দানে পথে বসে আছে যোগ্য বেকার ছেলেমেয়ের দল, তাদের সঙ্গে যে কুৎসিত আর নিষ্ঠুর প্রতারণা হয়েছে তার তুলনা মানুষের ইতিহাসে কম আছে। এই দলটার সর্বাঙ্গে যে দুষিত ঘা, তা আর লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। সারা দেশ, এমনকি পৃথিবীর কাছে পশ্চিমবাংলার বা বাঙালির সম্মান কোথায় নেমে গেছে, তা কি ভাবা যায়।
যারা নিরপেক্ষ রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করেন, তারা বলেন, এইরকম একটি কদর্য আর অপরাধী দলকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ পর পর দুটি নির্বাচনে, পৌরসভা আর পঞ্চায়েত ভোট দিয়ে ক্ষমতা ভোগ করতে দিয়েছে, সেটা ভাবলে অবাক হতে হয়। তা শুধু প্রশান্ত কুমারের পরামর্শ মেনে হয়েছে, তা তো নয়। দলের বন্ধু তো ছিলই, নইলে এমন কিম্ভূত কান্ড হয় কী করে? সংগঠন ছিল, কর্মী সবার উপরে ছিল, ছিল ‘বিদ্ধজ্জন’দের এক বিশাল তালিকা, যারা এদের হয়ে দু’বাহু তুলে নৃত্য করেছেন।
কিন্তু এখন বোধ হয় সময় এসেছে একটু ভাববার। তারা যে দেবতার পুঁজো করেছেন, করে চলেছেন, সে কী এই সাধারণ মানুষের বুকের রক্ত চুষে-খাওয়া রাক্ষস, ফেঁসে-যাওয়া মন্ত্রী যার একটা প্রত্যঙ্গ মাত্র। দলের যারা বন্ধু তারা সকলেই, এদের আন্তরিক প্রচেষ্টা আর উদ্যোগ সত্ত্বেও, চক্ষুলজ্জাহীন অপরাধী হয়ে গেছেন, এ কথা আমরা জনগণ বিশ^াস করি না। জানি, অশিক্ষা আর অপরাধের একটা সম্মোহন আছে, তাতে ঘুষ, কাটমানি, তোলাবাজি ইত্যাদির সুযোগ আছে, বিবেকহীনতাকে অলঙ্কার করে লক্ষ কোটি টাকা রোজগার করা যায়। জীবন বেশ সুখেই কাটে, সুখ বলতে যদি বিলাসব্যসন, প্রচুর জমি বাড়ি ফ্ল্যাট আর বান্ধবীসংসর্গ বুঝি। যারা এ সব করে তারা তাদের সন্তানদের বা আত্মজনের কাছে কী জবাবদিহি করে বুঝি না। নাকি তারা স্ত্রী-সন্তানদেরও ওই একই অপরাধে দীক্ষিত করে?
এর উত্তর আমার কাছে, আমাদের কাছে নেই, কিন্তু এখন আমরা জনগণ একটা আবেদন করতেই পারি। যে মানুষেরা এই দলকে জিতিয়ে, এই অপরাধীদের কথায় বা ভিক্ষাশ্রী জাতীয় প্রকল্পগুলোকে ভুলে, বা ভোটলুটকে সহ্য করে বা প্রশ্রয় দিয়ে এদের ক্ষমতায় এনেছে, তারা কি ভাববেন না যে, যথেষ্ট হয়েছে, এবার এদের ইতিহাসের আবর্জনাস্তুপে নিক্ষেপ করা দরকার? যে শ্রমিকেরা-ছাত্ররা-শিক্ষকেরা-আইনজীবীরা- অধ্যাপকেরা অফিস ও অন্যান্য ক্ষেত্রের কর্মীরা এই দলের নানা ফ্রন্ট বা মুখ্যসঙ্ঘে কাজ করেন, এদের প্রতি অন্ধ আনুগত্য পোষণ করেন তারা কি চোখ বুঝে থাকবেন এখনও? সেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় যুদ্ধ আর অহমিকায় অন্ধ আমেরিকানরা যেমন বলত, ‘মাই কান্ট্রি-রাইট অর রং, লাভ ইট অর লিভ ইট’? অর্থাৎ আমার দেশ ভুল করলেও আমি তার সঙ্গে থাকব। তেমনই আমার দল পচা হোক, অপরাধী হোক, আমি তার সঙ্গ ছাড়ব না। নর্দমার কীট নর্দমার বাইরে গেলে মরে যায়, আমরা মরতে চাই না। এখনও কি আপনারা সবাই ভাবছেন। আমার এবং আমাদের তো তা বিশ^াস হয় না।
আর বুদ্ধিজীবী আর বিদগ্ধজন-অপর্ণা সেন, শুভাপ্রসন্ন, জয় গোস্বামী, সুবোধ সরকার, নচিকেতা ইত্যাদি আরও কত কত বৃহৎখ্যাত, ডিগবাজিবিশারদ কেউ কেউ- আপনারাও কি আপনাদের ভক্তিতে অটল থাকবেন? মনে রাখবেন, যা ভারতীয় মতে দ্রৌপদীর শাড়িও বলতে পারেন- এর এখানেই শেষ নয়। এই দলটার বড় নেতা ছোট নেতাদের অস্তিত্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পচন ধরেছে, তার দুর্গন্ধ সবে বেরোতে শুরু করেছে। আপনারা সবাই এই অপরাধচক্রে হাসিমুখে অংশীদার হয়ে থাকবেন, আপনাদের সম্বন্ধে আমরা হতাশ হলেও এতটা আমরা ভাবতে পারি না। আপনারাই ভাবুন আপনারা কী করবেন।
আর শিল্পপতি, প্রকাশক, সাংবাদিক আপনাদের কি একটুুও চক্ষুলজ্জা হবে? ধন্যবাদ।
লেখক: কলামিস্ট, মুক্তিযোদ্ধা ও সভাপতি যুক্তরাষ্ট্র উদীচী।