মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

ছুটির নিমন্ত্রণে লাস ভেগাস

পিনাকী তালুকদার

প্রকাশিত: ১২:২৫, ৩১ জুলাই ২০২২

ছুটির নিমন্ত্রণে লাস ভেগাস

পিনাকী তালুকদার, সাংবাদিক

বঙ্গ সম্মেলনে যোগ দিতে আমরা প্রায় মাস আগেই লাগ ভেগাস যাওয়ার জন্য টিকিট কেটেছিলাম জেড¬ এয়ার লাইনন্স থেকে। ফলে তখন থেকেই শুরু হয় আমাদের অপেক্ষার পালা। ৩০ জুন রাতে অফিস শেষে সহকর্মী বাবুল ভাই আমাকে জেএফকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেন। জুলাই সকাল ৬টায় আমাদের ফ্লাইট। ঠিক সময়ে  ছাড়ে বিমান। আমরা লাস ভেগাস সময় সকাল ৯টায় এলএএস বিমান বন্দরে পৌঁছাই।

বিমান বন্দর থেকে মাত্র ১০ মিনিটের দূরত্বে স্ট্রিপের বিখ্যাত প্লানেট হলিউড রিসোর্ট। সেখানেই হয়েছে এবারের ৪২তম বঙ্গ সম্মেলন। আমরা সবাই সেখানেই ছিলাম। রাত চার দিন। এয়ারপোর্ট থেকে  বের হতেই লাস ভেগাসের গরম টের পাই। আর মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকি। মানিয়ে চলাই জীবন!

স্ট্রিপ এলাকার লাস ভেগাস বুলেভার্ডে প্লানেট হলিউড রিসোর্ট। বিশাল রিসোর্টের পুরো নীচ তলা জুড়েই ক্যাসিনো। তার উপরের তলায় সব অনুষ্ঠানের জায়গা। এর পর থেকে প্রায় ৪০ তলা পর্যন্ত চমৎকার সব থাকার রুম। ব্যবস্থাটা এরকম যে, রুম থেকে বের হয়ে নীচে নামলেই ক্যাসিনো। অর্থাৎ ডলার খরচ করার জন্য আর বাইরে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই! ক্যাসিনোর সাইডেই আছে বিভিন্ন ধরনের খাবারের দোকান। আর মূল বিল্ডিং এর পাশেই বিশাল আকারের শপিং মল। এই স্ট্রিপ এলাকার প্রায় প্রতিটি রিসোর্টেই এই ব্যবস্থা।

সামারের এই গরমের সময়টাতে সারা পৃথিবী থেকে প্রচুর ট্রাস্টি লাস ভেগাসে যায়। দুহাতে ডলার উড়ানোর জন্য! বাইরে ১০০ ডিগ্রির  বেশি তাপমাত্রা। তাই এসব মানুষ দিনের বেলায় ঘুমায় আর রাতে এক রিসোর্ট থেকে আরেক রিসোর্টে যায় প্রাণ ভরে আনন্দ ফুর্তি করার জন্য। জন্যই হয়তো লাস ভেগাসের আরেক নামপাপের নগরী!’

সিটির মূল ক্যাসিনোগুলোও আছে স্ট্রিপ এলাকার লাগ ভেগাস বুলেভার্ডের উপরই। অন্যান্য জায়গাতেও কিছু ক্যাসিনো আছে। এমন কি এলএএস এয়ারপোর্টেও প্রচুর ক্যাসিনো। অর্থাৎ বিমান থেকে নেমেই যেন আপনি জুয়া খেলা শুরু করে দিতে পারেন। তার সব ব্যবস্থা এরা সুন্দরভাবে করে রেখেছে!

হাতে হাত ধরে চলিএই শ্লোগানে হয়েছে এবারের ৪২তম উত্তর আমেরিকা বঙ্গ সম্মেলন। এই হাতে হাত ধরে চলার কথা বলা হয়েছে প্রবাসে দুই বাংলার বাঙালিদের ঐক্যকে বুঝাতে। বিশেষ করে আমেরিকায় আমরা যত বেশি ঐক্যবদ্ধ থাকবো ততই শক্তিশালী হবো। আর গত / দশকে আমেরিকার সর্বত্র বাঙালিদের একটা শক্ত অবস্থান তৈরি হচ্ছে। ক্ষেত্রে আমাদের নতুন প্রজন্ম দারুণভাবে এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষা, বিজ্ঞান, ব্যবসায় রাজনীতিসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে। সম্মেলনের আহবায়ক অর্থাৎ প্রধান আয়োজক মিলন আওন। বেশ কয়েকমাস আগে সম্মেলনে যাওয়ার বিষয়ে উনার সাথে আমার কথা হয়। ঠান্ডা মাথার একজন দক্ষ সাংগঠনিক মানুষ। পরে আমাদের টিবিএন ২৪ টেলিভিশনের সিইও আহমদুল বার ভূঁইয়া পুলক ভাইয়ের সাথে বৈঠক হয়। বিশাল এই সম্মেলনটি টিবিএন ২৪ কাভার করবে বলে মিলন আওন ভীষণ খুশি হন। দুপক্ষের চুক্তির ভিত্তিতে পুলক ভাই আমাকে দিয়ে বঙ্গ সম্মেলন কাভারের সিদ্ধান্ত নেন। আর বঙ্গ সম্মেলনে যাওয়ার বিষয়ে সবার আগে আমি প্রিয়জন হাসানুজ্জামান সাকী ভাইয়ের সাখে কথা বলি।

এবারের সম্মেলনের চেয়ারম্যান ছিলেন কালী প্রদীপ চৌধুরী। সিলেটের এই সন্তান আমেরিকায় বাঙালি বিত্তবান হিসেবে পরিচিত। উনার প্রতিষ্ঠিত কেপিসি গ্রুপ অত্যন্ত পরিচিত প্রতিষ্ঠান। সম্মেলনের সবটা সময়ই উনি সবকিছু তদারকি করেছেন। পুরো সম্মেলনে ছিলেন আরো প্রায় ১০০ জন ভলেন্টিয়ার। সম্মেলনের দিন ধরে বিভিন্ন হলে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে নানা ধরণের অনুষ্ঠান হয়েছে।  কেউ ইচ্ছে হলে চলচ্চিত্র দেখছেন। আবার একটু পরে চাইলেই যোগ দিতে পেরেছেন অর্থনীতি বিষয়ক সেমিনারে! চমক লাগানো সব নাচ গানের অনুষ্ঠানতো ছিলোই। সেই সাথে ছিলো শাড়ি কাপড় গহনাসহ আরো অনেক কিছুর স্টল। নিউইয়র্ক থেকে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের বিশ্বজিৎ সাহা গিয়েছিলেন দারুন সব বই নিয়ে। অনেককে দেখেছি মেলা থেকে ব্যাগ ভরে নতুন বই নিয়ে গেছেন মনের আনন্দে! পুরো সম্মেলনের অনেকটা সময় আমরা কাটিয়েছি মুক্তধারার স্টলে। সম্মেলনে  আগত প্রায় প্রত্যেকে নতুন বইয়ের গন্ধ নিয়েছেন। এটা দেখাও ছিলো অনেক আনন্দের

বাংলাদেশ ভারতের বাইরে, প্রবাসে বাঙালিদের সবচেয়ে বড় আয়োজন বঙ্গ সম্মেলন। এর আগে মূলত পশ্চিম বঙ্গের বাঙালিরাই এই সম্মেলনের আয়োজন করতো। এবারের ৪২তম আসরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশও ওতোপ্রোতভাবে বঙ্গ সম্মেলনে জড়িয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন গনমাধ্যমকর্মী হাসানুজ্জামান সাকী। এবার নিউইয়র্ক থেকে একটি বড় টিম সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। অ্যানি ফেরদৌস আপার নেতৃত্বে নিউইয়র্কের জনপ্রিয় নৃত্য সংগঠন বিপা যোগ দিয়েছিলো তাদের বেশ কয়েকজন শিল্পী কলাকুশলী নিয়ে। আবার আলাদাভাবে  রেজিস্ট্রেশন করে অনেকে আমেরিকার বিভিন্ন স্টেট থেকে যোগ দিয়েছেন। তবে সাকী ভাইয়ের গ্রন্থনা পরিকল্পনায়জয় বাংলাগীতি নাট্য চমৎকারভাবে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তুলে ধরেছে। এছাড়া বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি নতুন চলচ্চিত্র দেখানো হয়েছে। সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল আলম, অমিতাভ রেজা মীর সাব্বির। ছিলো বাংলাদেশের আরো নানা অনুষ্ঠানমালা। 

জুলাই বিকাল টায় সম্মেলনের উদ্ধোধনী পর্বটিতে ছিলো চোখ ধাঁধানো উপস্থাপনা। প্রায় ১২০ জন নৃত্যশিল্পী এক ঘণ্টার পরিবেশনায় ধাপে ধাপে ভারতবর্ষের কয়েক হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরেন চমৎকারভাবে। এই শিল্পীদের বেশিরভাগই নতুন  প্রজন্মের প্রতিনিধি। এরা সবাই আমেরিকার বিভিন্ন সিটিতে বসবাস করছেন। আমার বিশ্বাস নতুন প্রজন্মের এসব গুণী মানুষদের মাধ্যমেই প্রবাসে বাংলা সংস্কৃতির উত্তরোত্তর বিকাশ অব্যাহত থাকবে। আর কারণেই বঙ্গ সম্মেলনের মতো বড় বড় আয়োজনের বিরাট গুরুত্ব রয়েছে। 

জুলাইয়ের , এই তিন দিনের সম্মেলনে নানামুখী আয়োজনে সবাই বলা যায় অতি আনন্দময় সময় কাটিয়েছেন। সম্মেলনের মধ্যেই সুযোগ পেলে অনেকেই ডুব দিয়েছেন ক্যাসিনোতে। লাস  ভেগাসে যাবেন আর ক্যাসিনোতে ডলার দিবেন না এটা মনে হয় চিন্তারও বাইরে। এছাড়া অনেকের সাথে দেখা হওয়া, পরিচিত হওয়া এটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সম্মেলনের আয়োজনটিই করা হয় আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসের ছুটিকে কেন্দ্র করে। এই সময়টাতে মানুষ এমনিতেই থাকে ছুটির আমেজে। তবে ভিসা জটিলতাসহ নানা কারণে অনেক শিল্পী কলাকুশলী বাংলাদেশ ভারত থেকে  যোগ দিতে পারেননি। তাদের মধ্যে সুনিধী চৌহান জেমসের গান সবাই খুব মিস করেছে। দিনের বিশাল একটি সম্মেলনে নানা ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলেও ধরনের সম্মেলনের অনেক গুরুত্ব আছে। দুই বাংলার মেলবন্ধন যত দৃঢ় হবে প্রবাসে আমাদের অবস্থানও তত শক্তিশালী হবে। ধরণের বাঙালি অনুষ্ঠান উৎসবগুলোর মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়াবে আমাদের বাংলা সাংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারা।

এবারে নেভাডার  লাস ভেগাস গিয়ে একটা আক্ষেপ থেকেই গেলো। এতো কাছে গিয়েও অ্যারিজোনার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখতে পারিনি বলে। শিবলি সাদিক ভাই আর হামিদ ভাইকে অনেক বলেও রাজি করাতে পারিনি। তবে আরেক প্রিয়জন নুরুল আমিন বাবু ভাই থাকলে আমরা অবশ্যই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখে আসতে পারতাম!

আগামী বছর ৪৩তম বঙ্গ সম্মেলন হবে নিউজার্সির আটলান্টিক সিটিতে। আমার আবারো যাওয়ার ইচ্ছে আছে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে চমৎকার দিনের একটি আনন্দময় সময় কাটাতে চাইলে আপনিও যোগ দিতে পারেন। লেখক: সাংবাদিক।

শেয়ার করুন: