মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

আমলার কামলাতন্ত্র ও পথহারা গণতন্ত্র   

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ২০:৪১, ৩০ জুলাই ২০২২

আমলার কামলাতন্ত্র ও পথহারা গণতন্ত্র   

ফাইল ছবি

নানা কারনে বিশেষভাবে পরিচিত দেশের সর্বদক্ষিণের উপজেলা টেকনাফ। এর মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্প কিংবা মাদকের হটস্পট যেমন আছে তেমনি রয়েছে একজন ইয়াবা স¤্রাটের ভূমিকাও। এছাড়া আলোচিত কাউন্সিলর একরাম হত্যা, ওসি প্রদীপ কর্তৃক অবসরপ্রাপ্ত মেজর মো. সিনহা হত্যাসহ মিডিয়ার ফোকাস যেন টেকনাফ থেকে সরানোই কঠিন। তারওপর এবার যোগ হলো একজন আমলার সাংবাদিক নিকুচি করা মিশন। 

তিনি টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ কায়সার খসরু। কক্সবাজারের একজন সাংবাদিককে অকথ্য-অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে ফেঁসে গেছেন তিনি। তাকে ওএসডি করা হয়েছে। সরকারি বিধি অনুযায়ি এখন তিনি কোনো নিদিৃষ্ট চেয়ারে নেই। ঘরে বসে বেতন-ভাতা পাবেন। যেটি তার ক্যারিয়ারের জন্য কলঙ্কের তিলক স্বরূপ।

এর আগেও আমাদের দেশে অনেক আমলার গায়ে এ ধরণের কলঙ্ক তিলক লেগেছে। সচিব থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনের এমন অনেককেই ওএসডি করা হয়েছে। চাকুরি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পদমর্যাদা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিংবা শাস্তিমূলক বদলিও করা হয়েছে। কিন্তু এই ঘটনাটি সেসব থেকে অনেকটাই ব্যতিক্রম। কেননা জনাব খসরু সাহেব একজন সাংবাদিককে গালিগালাজ করেছেন। সেই গালিগালাজ নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়েছে। দেশের আমলাতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা নিয়ে অস্বস্তি ও শঙ্কার যায়গাটি তুলে ধরে সমালোচনা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে।

একটি গণতান্ত্রিক দেশে আমলাতন্ত্র দিনে দিনে কিভাবে শেকড় গেড়ে বসছে কিংবা সব ক্ষমতা কিভাবে আমলারা কুক্ষিগত করছেন ইতোপূর্বে তা তুলে ধরে আলোচনা হয়েছে দেশের জাতীয় সংসদেও। মন্ত্রী থেকে শুরু করে সংসদ সদস্যরা বলেছেন এখন আর রাজনীতিকদের দাম দেন না আমলারা। সংসদ সদস্যকেও উপজেলা পর্যায়ের আমলাদের ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ না দিলে কাজ করে দেন না, হাইকোর্ট দেখান। এমন আরো বহু আক্ষেপের কথা বিভিন্ন সময়ই শুনেছি বিভিন্ন জনের মুখে। 

জনাব খসরু যে সাংবাদিককে গালিগালাজ করেছিলেন তার অপরাধ ছিলো মুজিববর্ষে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নিয়ে সংবাদ প্রকাশ। ওই সংবাদে তিনি তুলে ধরেছেন ঘরগুলো নিচু জমিতে হওয়ায় সেখানে জলাবদ্ধতার বিষয়টি। পানির কারনে ঘরগুলো বসবাস অনুপযোগি হওয়ায় ভুক্তভোগিরা যে কষ্ট-দু:খের কথা বলেছেন সেগুলোই তুলে ধরেছেন ওই সাংবাদিক। যেটি একজন প্রতিবেদকের কাজ। তার এই কাজ সংবাদপত্রের ইথিকস মতে কোনো অপরাধ নয় বরং অবশ্য করণীয়। 

এই সংবাদের কোনো অংশ কিংবা পুরো প্রতিবেদন যদি আপত্তিকর কিংবা কারো জন্য মানহানীকর হয় সেখানেও প্রতিবাদের সুযোগ রয়েছে। একজন ইউএনও নিশ্চয়ই সে বিষয়টি জানেন। কিন্তু তিনি সে পথে না গিয়ে সরাসরি ফোন করে যে ভাষায় ওই সাংবাদিককে হুমকি দিয়েছেন সেটি অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইন কিংবা কোনো প্রফেশনের ইথিকসের বাইরে। সে ক্ষেত্রে মাঠ প্রশাসনের একজন কর্তা হিসেবে অন্যায় করেছেন তিনি। আর এ কারনেই এতো এতো সমালোচনা। যার ফলশ্রুতিতে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেওয়া। 

সংবাদকর্মী হিসেবে ২০১১ সাল থেকে সচিবালয়ে যাওয়া-আসা শুরু করি। সে সময় বিভিন্ন প্রোগ্রাম কভার করার পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মকর্তাদের দপ্তরে ব্যক্তিগতভাবে গিয়েছি। অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। অনেক সিনিয়র আমলাদের মুখোমুখি বসে কথা বলেছি। প্রায় প্রত্যেকের মধ্যেই একটা অভিন্ন বৈশিষ্ট্য খেয়াল করতাম। কথা বলার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। সরকারের আমলা হয়েও সকল জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে এই ধরণের রাজনীতি নিরপেক্ষ হয়ে কথা বলা নিশ্চয়ই কঠিন কাজ। তবে বেশিরভাগ আমলাই সেটি বজায় রাখতে পারতেন। সে সময় সচিবালয়ের মধ্যে কোনো মন্ত্রী কিংবা রাজনীতিকের রংচংয়া পোস্টার চোখে পড়তো না। অভিনন্দন আর শুভেচ্ছা ব্যানারের এমন দৌরাত্ম ছিলো না। 

কিন্তু ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর থেকে দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকে। দেশের প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয় অনেকটা আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মকান্ড প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। আমলাদের গলার সুর পাল্টে যায়। তাদের বক্তব্যের শুরু এবং শেষ শুনে মেলানো কঠিন হয়ে পড়ে কে আমলা আর কে রাজনীতিক। এমনকী অনেক আমলার মুখে অতিরিক্ত তেল মর্দনসূচক বাক্যে রীতিমত অনেক রাজনীতিকও হতবাক হতেন। অনেক প্রবীন রাজনীতিক মাঝে-মধ্যে এইসব কর্মকর্তাদের মুখের ওপর ধমকও দিয়েছেন তাদের তৈলাক্ত অতিরাজনীতিক বক্তব্যের কারনে।

এরপর দিনকে দিন কেবল এ অবস্থার অবনতিই হয়েছে। আমলাদের মধ্য থেকে রাজনীতি নিরপেক্ষতা বিদায় নিয়েছে। রাষ্ট্রের চেয়ে দলীয়  ফ্লেভারই এখন বেশি ছড়ায় সচিবালয়। অথচ একটি গণতান্ত্রিক দেশে সব দল সব মানুষের জন্যই সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে এখন যেমন গণতন্ত্র বিষয়টি কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ তেমনি আমলাদের রাজনীতি নিরপেক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ পরিপালনের বিষয়টিও এখন তেমনি কাগজবদ্ধ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিগত অন্তত এক দশক ধরে আমলা বানানোর যে প্রাথমিক প্রক্রিয়া বিসিএস- সেখানে দলীয় করণই মূখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। একটি রাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ সেবা দেওয়ার যায়গাগুলোতে চেখে চেখে দলীয় লোকদের ঢুকানোর ফলে রাষ্ট্র ও সমাজে অস্থিরতা গেড়ে বসেছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ বোধ হয় কোনো কালেই আর সম্ভব নয়। 

এর আগে মাঠ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা জনগণের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন শুধু নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য। নিজেকে স্যার বলে সম্বোধন না করা কিংবা, নারী কর্মকর্তাকে আপা বলায় জনগণের ওপর আমলাদের অ্যাকশন নেওয়ার খবর আমরা দেখেছি। পড়াশুনা করে, অনেক কষ্ট করে এই অবস্থান করে নিতে হয়েছে তাই তাদের সঙ্গে কথা বলতে হলে হিসাব করে বলতে হবে এমন কথাও জনগণকে বলেছেন তারা। অথচ সংবিধান মতে এরাই নাকি আবার প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তা হলে কেমন কর্মচারী বা কামলা! কেমন সেই কামলাতন্ত্রের স্বরূপ? সেই কামলা যদি হয় খসরুর মত লোক তাহলে এমন কামলা লইয়া রাষ্ট্র কি করিবে? 

সেদিন এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর বিষয়ে কথা হচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে তার আপন চাচাতো এক ভাই বললেন, মন্ত্রী কথা দিলেন, তার ভাই বললেন ছেলের চাকরি শতভাগ কনফার্ম। তারপরও হলো না। বিষয়টা বুঝলাম না। কি হলো। তারপর বললেন, আসলে মন্ত্রিদের থেকে মনে হয় সচিবদের গরম বেশি। তা না হলে মন্ত্রির সুপারিশ করা চারজনের এক জনেরও চাকরি হলো না। অথচ অন্যদের হলো। কারণটা কি? আমি তাকে বললাম, এখন আমলাতন্ত্রের স্বর্ণযুগ। জনপ্রতিনিধিদের কোমরে বেশি জোর নাই। কেন নাই বিষয়টা নিশ্চয়ই বোঝেন...

আমাকে অবাক করে তিনি হেসে বললেন, হয়-ব্যাপারটা তাই। পায়ের নিচের মাটি শক্ত না থাকলে মন্ত্রীদেরও গোনে না সচিবরা। জনগণের ভোটে এমপি-মন্ত্রী হলে একটা আলাদা গরম থাকে। যেইটা এনাদের নাই। তারপরও মন্ত্রী যেহেতু কথা দিয়েছে আজ না হয় কাল ছেলের চাকরি হবে-বিশ্বাস তার। 

যে কথা বলতে চাই- বিরোধী রাজনীতিকে দমনের নামে বছরের পর বছর যেভাবে দেশের গণতন্ত্রকে দুর্বল করা হচ্ছে তেমনি দলীয় করণ করতে গিয়ে দেশের আমলাতন্ত্রকেও ধংস করা হচ্ছে। কার কি কর্তব্য কিংবা কার কতটুকু সীমা তার হিসাব থাকছে না। কোন চেয়ারে বসলে কতটুকু বলা যাবে আর কোন চেয়ারে থেকে কতটুকু ক্ষমতা দেখানো যাবে সে বিষয়টি ভুলে যেতে বসেছেন আমাদের আমলারা। কেননা তারা যখন রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে কোনো দলের ক্ষমতায় থাকা না থাকার জন্য ফ্যাক্টর হয়ে যান তখন তাদের মধ্য থেকে এই হিতাহিত জ্ঞানটুকু হারিয়ে যায়। যে কারনে বিসিএস দেওয়া একজন প্রথম শ্রেনির গেজেটেড কর্মকর্তাও খেই হারিয়ে কামলাশ্রেণির মত ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। আমলাদের এই ধরণের কামলা বনে যাওয়া কিংবা বানানো উভয়ই রাষ্ট্র ও সমাজর জন্য বিপদজনক। তাদের দ্বারা সরকার ফায়দা হাসিল করলেও জনগণ প্রকৃতপক্ষে কিছুই পায় না। অথচ জনগণের টাকায় বেতন নেওয়া এইসব আমলাদের জনগণের সেবক হওয়ার কথা ছিলো। 

লেখক: সাংবাদিক ও কথাশিল্পী। 
 

শেয়ার করুন: