শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

ঢাকার চিঠি

জাতির দুর্দশা বাড়ালো সিত্রাং 

মেসবাহ শিমুল

আপডেট: ১৩:৪২, ২৯ অক্টোবর ২০২২

জাতির দুর্দশা বাড়ালো সিত্রাং 

ঢাকার চিঠির লেখক: মেসবাহ শিমুল

সোমবার রাজধানীর এক ভয়াবহ রূপ দেখা গেলো। সারাদিন বৃষ্টি-ঝড়। রাত গড়িয়ে পরদিন সকালেও তাই। টানা বাতাসে অসংখ্য গাছপালা পড়ে আছে রাস্তায়। বিদু্যুৎ এই আসে এই যায়। এরই মধ্যে প্রায় পুরো শহর পানিতে তলিয়ে গেছে। কোথাও কোমর পানি তো কোথাও হাটু ডুবে যাওয়া অবস্থা। অবশ্য এই অবস্থার পেছনে আমাদের কিংবা রাষ্ট্রের কোনো হাত নেই। এটি কেবলই সৃষ্টি কর্তার লীলাখেলা। 

ঘুর্ণিঝড় সিত্রাং উপকূলে আঘাত হেনেছে সোমবার সকাল থেকেই। দুপুর নাগাদ চারিদিকে অন্ধকার। মোবাইল নেটওয়ার্ক নাই। বিদ্যুৎ নাই। ফলে যারা কষ্ট করে দুপুর পর্যন্তও আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন দুপুরের পর তারা আর পারেননি। আমিসহ পরিচিত অনেকেই ফেসবুকে পোস্ট করে বলেছেন তারা বাড়ির সঙ্গে, বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। কী এক ভয়াবহ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ব্যাপার। 

অবশ্য এর চেয়েও বেশি উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ব্যাপার ঘটেছে রবিবার।  প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরির তথ্য মিডিয়ায় আসার পর সেটি দ্রুত বেগে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি জানিয়েছেন রিজার্ভ নেই। ফলে বিদ্যুৎ কেনা সম্ভব নয়। ফলে এখন যে লোডশেডিং চলছে সেটি আগামী মাসেই শিফটিংয়ে চলে যেতে পারে। অর্থাৎ দিনের সম্পূর্ণ অংশটুকু বিদ্যুৎবিহীন থাকতে হতে পারে। রাতের বেলা বিদ্যুৎ থাকবে। তার মানে ধরে নেই একটানা ১২ ঘণ্টার পাওয়ার অফের কথা বলেছেন। এটি নি:সন্দেহে অত্যন্ত উদ্বেগ এবং একইসঙ্গে আতঙ্কের বিষয়। 

ক’দিন আগেও বলা হয়েছিলো আগামী মাস থেকেই লোডশেডিং সর্বনিম্ম পর্যয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। শীত মৌসুমে একদমই স্বাভাবিক হবে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি। সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে পাওয়া এমন আশ্বাসের পর এ কি শোনালেন ড. চৌধুরি। তিনি কি তাহলে প্রকৃত চিত্রই বলেছেন। যদি তার এই আশঙ্কা সত্যি হয় তবে দেশের দুর্গতি বুঝি আর ঠেকানো গেলো না। 

এই যখন অবস্থা তখন দুটি পত্রিকার সংবাদ আমাদেরকে আরো বিচলিত করছে। যার একটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫ ডেপুটি গভর্নরের বিশাল অংকের টাকা পাচারের খবর অন্যটিতে দেশের বিপুল শ্রেণির মানুষের তিন বেলা খেতে না পারার সংবাদ ছাপানো হয়েছে। একদিকে চুরি অন্য দিকে অভুক্ত থাকা। এ এক বিশাল বৈপরীত্য। অবশ্য এমন বৈপরীত্য নিয়েই আমরা চলে আসছি বেশকিছু বছর ধরে। সরকার মুখে বলছে এক কথা কিন্তু বাস্তবতায় তার ভিন্ন চিত্র। মুখে বলছে দেশে বিদ্যুতের কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু বাস্তবে মানুষের ঘরে বিদ্যুত নেই। মোবাইলে চার্জ নেই। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন। আবার তারা মুখে বলছে বিদ্যুৎ কিংবা দেশের অর্থ সাশ্রয় করতে হবে, বাস্তবতা হলো জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ১৬২ জন। ১৯ দিনের সফর শেষে দেশে ফেরেন প্রধানমন্ত্রী। আবার ছাগল পালনের প্রশিক্ষণ নিতে আমলারা কোটি টাকা খরচ করে যান বিদেশে। সরকার মুখে বলে দেশে খাদ্যের ঘাটতি নেই, চাল-মাছ কিংবা শাক-সবজিতে দেশ উপচে পড়ছে কিন্তু বাস্তবতা হলো দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী না খেয়ে কিংবা কোনো মতে খেয়ে দিন পার করছে। বাজারে সব পণ্যের গায়ে আগুন। আর এই আগুনের প্রভাবে সাধারণ মানুষের শরীরে ১০৫ ডিগ্রি জ্বর। এই জ্বর সারানোর কোনো ঔষধ আপাতত পাওয়া যাচ্ছে না। 

সিত্রাং এমন এক সময় দেশে আঘাত হানলো যখন আমন মৌসুম শেষের দিকে। আর ক’দিন পরেই ধান পাকার কথা। অথচ সেইসব ধানের জমি এখন পানির নিচে। বাতাসে গড়িয়ে পড়েছে নরম ধানের শরীর। এই গড়িয়ে পড়া শরীর নিয়ে সুস্থ সবল ধান জন্ম দেওয়া নিশ্চয়ই অসম্ভব। সুতরাং দুর্ভিক্ষ সমাগত!

লেখাটি লিখছি তখন ঢাকার বাতাসে সিত্রাংয়ের আধিপত্য। দরজা-জানালা বন্ধ। তবুও বাইরে তুমুল উত্তেজনা টের পাচ্ছি। বৃষ্টির শব্দ কানে আসছে। ভবনের কোনো কোনো ফ্ল্যাট থেকে মাঝে মাঝে দরজার ধুপধাপ শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। এই যখন ঢাকার অবস্থা তখন না জানি উপকূল বিশেষ করে সাতক্ষীরা, খুলনার বাঁধগুলোর কী অবস্থা। হয়তো ইতোমধ্যে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। হয়তো পানিতে তলিয়ে গেছে গ্রামের পর গ্রাম-জনপদ। বিদ্যুৎহীন গাড়ো অন্ধকারে নিমজ্জিত উপকূলবাসীর এই নিদারুণ কষ্ট লাঘব হওয়া দরকার। প্রয়োজন অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থা থেকে  পুরো জাতিকে মুক্ত করা। 
 

শেয়ার করুন: