শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

‘সোলে’,  সুধীর বাবু  এবং আমাদের ‘বন্ধুত্ব’  

সৈয়দ ঋয়াদ, সাংবাদিক

প্রকাশিত: ০০:৫৭, ২৩ অক্টোবর ২০২২

‘সোলে’,  সুধীর বাবু  এবং আমাদের ‘বন্ধুত্ব’  

ফাইল ছবি

১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সোলে’ সিনেমার কথা মনে আছে? পুরোনো হলেও বিখ্যাত সিনেমাটা কম বেশি সবাই দেখেছে। সিনেমাটা আমাদের বা সমসমায়িক প্রজন্মের জন্মের আগের। আমরা মূলত সিনেমাটা দেখেছি ভারতীয় চ্যানেল দূর দর্শন এর মাধ্যমে। দূর দর্শনের দুটো চ্যানলে ছিলো, দূর দর্শন-১, যেটাকে বলতাম ডিডি-ওয়ান  অন্যটা দূর দর্শন মেট্রো। আমরা মেট্রোকে বলতাম ডিডি ট। দূর দর্শনই আমাদেরকে এসব সিনেমা দেখার সুযোগ করে দিয়েছিলো। তবে যারা সিনেমাটা দেখেননি তারা অন্তত এর একটি গানের সঙ্গে নিশ্চয়ই পরিচয় আছে বা শুনেছেন, সেটা হলো- ‘ইয়ে দোস্তী হাম নেহি তোরেঙ্গে, হাম নেহি তোরেঙ্গে ইয়ে দোস্তী’। ‘সোলে’ পরিচালক ছিলেন রমেশ সিপ্পী। ভারত তো বটেই পুরো পৃথিবীতে গত শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় হিন্দী ছবি ছিলো এটা।

কিংবন্দন্তী কন্ঠশিল্পী কিশোর কুমার আর মান্না দে’র দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়া এই গানটি আমাদের শৈশবকেও আলোড়িত করেছে। মজার ব্যাপার হলো এই সিনেমার বেশিরভাগ চরিত্রই কিংবদন্তী।  যেমন ইয়ে দোস্তী গানের সুল করেছের উপ মহাদেশের সঙ্গীতের  প্রাণ বিখ্যাত রাহুল দেব বর্মন। তিনি সচীন দেব বর্মনের পুত্র। এই গানে বন্ধুই যে পরম সত্য সুন্দর গানের প্রতিটি শব্দ সে কথারই ব্যঞ্জণা দেয়। আমাদের প্রত্যেকের জীবনকে দুটো বিষয় খুব প্রভাবিত করে। একটি পারিবার, অন্যটি বন্ধুত্ব। এই দুই স্বত্বার প্রভাবই আমাদের গোটা জীবন। কিন্তু আমরা বেশিরভাগ সময় বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হই। কিন্তু কেউ কেউ আছেন যারা বন্ধুর জন্য জীবনও দিতে পারেন। কিন্ত বন্ধু শব্দটি সেই সব মহান মানুষদের জন্যই সুউচ্চ সম্মানে অধিষ্ঠিত। তাই আশির দশকে সোলে মন কেড়েছিলো কোটি তরুণ ভক্তের। 

আপনাদের ভুলে যাবার কথা নয়, গত বছর সেপ্টেম্বরে  কুমিল্লার মুরাদনগরে মীর হোসেন সওদাগর নামে একজনের মৃত্যু হয়। তিনি বিখ্যাত কেউ নন। খুব সাধারণ মানুষ। কিন্তু তার সেই মৃত্যু যে ঝড় তুলেছিলো সেটিও কেবল বন্ধুত্বের জন্য। মুসলমান বন্ধু মীর হোসেনের জানাজায় এসে পেছনে বসে কাঁদছিলেন তার সনাতন ধর্মের বন্ধু সুধীর বাবু। সুধীর বাবুর কান্নার ছবি দেখে বহু মানুষই কেঁদেছেন সেসময়। সুধীর বাবুর অসহাত্ব বন্ধুত্বকে যে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে সেটা একালের বহু মারুষের জন্যই একটা পাঠ। তিনি বোঝাতে পেরেছেন মানুষে মানুষে কোনোকিছুতে প্রভেদ নেই। নিজের পরম বন্ধুকে হারিয়ে সুধীর বাবু সম্ভবত বেঁচে থাকাকে অনর্থক মনে করেছিলেন সেসময়। এমন পবিত্র সম্পর্কের আপনি কী নাম দেবেন? নিশ্চয়ই বন্ধু। কেবল দুটি নিঃস্বার্থ ও নির্লোভ আত্মার পক্ষেই এমন বন্ধুুত্ব করা সম্ভব। হয়তো আমাদের চারপাশে এমন অসংখ্য সুধীর বাবু-মীর হোসেন সওদাগর আছেন, যাদের জন্য পৃথিবী অনেক সুন্দর। সুন্দও বন্ধু ও বন্ধুর মতো সব সম্পর্ক।

তো বন্ধুত্বের এই প্রগাঢ় বন্ধন সোলেতে যেভাবে দেখানো হয়েছে সেটি বাস্তব হয়ে এসেছিলো সুধীর বাবুর বেলায়। এক কালে ‘বন্ধু বাস্তবতা’ এমনই ছিলো। পৃথিবীতে এরচেয়ে সুন্দর পবিত্র শব্দ খুব কম আছে। এই সময়ে এসে সেই বন্ধুত্ব কি আছে, যেটা আমরা শৈশবে দেখে-শুনে বড় হয়েছি? আমরা কি বন্ধুকে সত্যিই বন্ধু ভাবতে পারি? আমাদের আশপাশে এমন একজনও কি আছে যাকে বন্ধু ভাবা যায় বা নিঃশর্তে বিশ্বাস করা যায়? হয়তো এমন অসংখ্য ভালো ও বিশ্বস্ত বন্ধু আছে। 

ওই যে, একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের বন্ধুত্বগুলো কেবলই ঐশ্বর্য্য বেষ্টিত হয়েছে। সফলতা যেদিকে বেকে বা  হেলে পড়েছে বন্ধুত্ব সেদিকেই ছুটেছে। বন্ধুর সংখ্যার ওপর প্রভাব ফেলেছে সফলতা বা ব্যর্থতা। ব্যর্থ মানুষের কোনো বন্ধু নাই। তিনি ব্যর্থ বা অসফল এই দোষেই তিনি বন্ধুহীন। জীবনের এই কঠিন বাস্তবতা আমাদের সবারই এসেছে, আসছে। কিন্তু আমরা এমন বন্ধুই কি হতে চাই যারা কেবল স্বার্থের জন্য কাছে আসে, ভালোবাসে? মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমরা সবাই সবার বন্ধু আবার কেউ কারো সত্যিকারের বন্ধু হতে পারছি না।

এখন বন্ধু শব্দের অর্থ বদলেছে, বিষয়টি আরেকটু সহজ করে যদি বলি, দেখবেন কেউ একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েছে, তখন সবাই তার বন্ধু হতে চাইছে। এমন কি লতায় পাতায় আত্মীয় বলতে কসুর নেই। বরং পরিচয় দিতে পারলেই গর্ব করে। বাস্তবতা কি জানেন? ওই অধ্যাপকও বঞ্চিত হতে হতে শিখে গেছেন যারা তাকে ফেসবুক প্রোফাইলে আটকাতে চায় তার স্বার্থান্ধ, তাই তিনি সেলফি পর্যন্তই তাদের ভালোবাসেন। কারণ ভালো না বাসলে গ্রামের লোকজন তাকে নিয়ে চা স্টল গরম করবে না। তাই তাবেদারদের পুুরোপুরি ইগনোর করে না। পক্ষান্তরে তিনি নিজের প্রয়োজনে মন্ত্রী-সচিবদের সঙ্গেই চলতে স¦াচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অধ্যাপক খারাপ সময়ে দেখেছে এরা কেউ পাশে ছিলো না, আজ পদবী তাদের কাছে এনেছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা গ্রামের অনকে বন্ধুই এখন আর সেই অধ্যাপকের প্রকৃত বন্ধু না এরা ‘জাস্ট ফ্র্রেন্ড’। আবার কেউ একজন পুলিশ ক্যাডারে চাকরি পেলো, দেখবেন সবাই তাকে বন্ধু বলে আরাম পায়, আরাম পাচ্ছে। কিন্তু সেই পুলিশ অফিসার আর তার চেয়ে কম যোগ্য কাউকে বন্ধু মনে করেন না। তার বন্ধু তার চেয়ে-বড় কেউ।

আবার এলাকার যে ছাত্রনেতা সে এখন বন্ধু বা বড় ভাই খোঁজে ভিন্ন মাত্রার। হতে পারে সেন্ট্রালে রজনীতির সঙ্গে যুক্ত, জেলা-উপজেলার বড় নেতা। আশপাশের কাউকে সে গোনায় ধরে না। সে জানে না তার সেই নেতারও ‘হাওয়া’ নাই। সেই নেতা তাবেদার ছোটভাইকে কতটা চায় সেটাও সে জানে  না। সে জানে না নিয়মিত ভাইকে নিয়ে ফেবু গরম না করলে, তার ছবি প্রোফাইলে না ঝুলালে, তাকে কবি বলে পোস্ট না করলে তাকে ভালোবাসে কিনা সেটা তারা পরীক্ষা করেনি। যেই বড় ভাইয়ের পূজা আর্চনা করে সেই বড় ভাই সেন্ট্রালের টপ লিস্টেট বড় ভাইদের কীভাবে তাবেদারী করে সেটা দেখেনা বলেই তাদের ঘুম ভাঙ্গে না। আবার গ্রামের একটা শ্রেণি দেখবেন এলাকার মালদার আদমী, ধনবান, লাঠিসোঠা আছে কিংবা ভাই বেরাদার ইউরোপ প্রবাসী তাদেরকে বন্ধু বানাতে তৎপর। কেউতো নিজের বাপ রেখে অন্য কাউকে বাপ ডাকতেও ছাড়ে না। আসলে তাদের তৈলাক্ত ডাক থেকে নেতার রক্ষা নেই। আবার সমাজের কিছু খাটাস আছে, থানার কনস্টেবল থেকে শুরু করে হেড দারোগাসহ  সবাইকে বেশ তোয়াজ করে। বাড়িতে মুরগী পোলাও খাওয়ায়। নতুন কেউ বদলি হলে ফুল দেয়। নিজের বাপ ভাইরে একটা চকলেট না দিলেও থানার বড় বাবুকে ফুল দিতে হবে। আসলে এসব হলো কাছে টানার মন্ত্র। ক্ষমতা দেখানোর মন্ত্র। আচ্ছা সরকারি কর্মকর্তাকে এরা ফুল দিয়ে বরণ করে কেন? আসলে এর সব কিছুর পেছনে রয়েছে গভীর মতলব। দুঃখ হলো এসব মানুষ কোনোদিন তার কাঠমিস্ত্রী যে অসফল বন্ধু বা রিকশাচালক বন্ধু কিংবা চৌকিদার তাকে জড়িয়ে ধরেনি। তার-তাদের খোঁজ রাখেনি। তাদের সঙ্গে আমরা আর বন্ধুত্ব করি না। খোঁজ রাখে কেবল বড় বাবুর।  দেখবেন এলাকায় কিছু লোক আছে তেলা মাথায় খুব তেল দেয়। যখন দেখবেন আপানার তেলের বোতল খালি তখন আপনাকেও শালা বলে ফেলবে। আমাদের চরিত্রের এই যে চিত্রায়ন আমার কাছে মনে হয় এটা সেলুলয়েডে তুলে ধরতে পারলে অস্কার মিস হবে না। জবর ব্যাপার নিজেদের সেই কুৎসিৎ চেহারাটা আমরা কখনো দেখি না। দেখার প্রয়োজনও মনে করি না। তা না হলে আমাদের নোংরা মুখটার জন্য আমাদের লজ্জা পেতে হতো, সেটা ঢেকে রাখতে হতো।

সমস্যা হলো আমরা আর সাধারণ নেই। কোনো সাধারণ মানুষকে বন্ধু ভাবি না। তার দিনটাকে স্পেশাল করার আয়োজন করি না। তাকে উইশ করিনা। যখন তাকে বন্ধু বানাই বা উইশ করি তখনই পেছনে থাকে দুরভিসন্ধি, মতলব। তার মাধ্যমে ভোট চাই, তাকে ব্যবহার করি। আমরা এতো সাধারণ  হয়েও আমাদের কোনো সাধারণ বন্ধু নাই। জানেন তো, আপনার আমরা জীবনে এক বা দুুইজন ভালো বন্ধু থাকা জরুরি। যাকে আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন। ভরসা করতে পারবেন।  সবাই কিন্তু বন্ধু না। বন্ধু ভেরি ‘সিলেক্টিভ ওয়ার্ড’। স্কুলে এক সঙ্গে বা প্রাইভেটে এক সঙ্গে পড়লে বা এক রুমে থাকলে সেটাকে বন্ধু বলে না, ক্লাসমেট বা রুমমেট বলে। বন্ধু অন্য জিনিস, অন্য মাত্রা। বন্ধু হয় সুুধীর বাবুর মতো। অবশ্য আমাদের আর বন্ধু লাগে না, আমরা আছি মালদার পেশি শক্তিওয়ালা লোকের পেছনে তেল মারতে। একবার চোখ বন্ধ করে বলুন আপনার কয়জন বন্ধু আছে? ঠিক ঠাক চোখ বন্ধ করুন। বুকে হাত দিয়ে বলুন, দেখবেন যদি সত্যি জাজ করতে পারেন তাহলে আপনি বলতে পারবেন বন্ধু আছে কি নেই। 

সব লাভ ক্ষতির হিসেব পেছনে রেখে এক বা দুজন ভালো বন্ধু সবারই থাকা প্রয়োজন। ব্যক্তি জীবনের সফলতা ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে বন্ধুত্ব এগিয়ে যাবে অনেক দূর। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ একে অন্যের ভালো বন্ধু হয়ে উঠবে। নিজেদের শৈশব-কৈশরকে নিয়ে যাবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। বিপদে কাঁধে হাত রেখে বলবো, ‘ভয় নেই আমি তোর পাশে আছি, তোর কিচ্ছু হবে না।’ মমতা আর ভালোবাসায় যদি একটি সম্পর্ক তৈরি করা যায়, সেটাই সত্যিকারের অর্জন। বন্ধুত্ব এক নিঃস্বার্থ পথে দুর্গম যাত্রার নাম। সেপথে আমরা নিশ্চয়ই নির্ভয়ে একে অন্যের নির্ভরতা হয়ে উঠবো। কাউকে ব্যবহার করে বা স্বার্থ উদ্ধারে জন্য নয়, যে সম্পর্ক কারো চোখ মুছে দিতে পারে, মুখ দেখে বলে দিতে পারে আজ কিছু খাসনি আজ? আয়, খেয়ে নে। এর নামই বন্ধু-বন্ধুত্ব।

লেখক: সাংবাদিক। 
 

শেয়ার করুন: