বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

এত ভঙ্গ ফোবানা তবু রঙ্গ ভরা!   

হাবিব রহমান

প্রকাশিত: ১৭:১০, ১১ জুলাই ২০২২

এত ভঙ্গ ফোবানা তবু রঙ্গ ভরা!   

এত ভঙ্গ ফোবানা তবু রঙ্গ ভরা!   

জ্যামাইকা থেকে প্রিয়ভাজন সৈয়দ আল আমিন রাসেল এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন ‘ফোবানা এখন তিনখন্ড। ২২ এর ফোবানা হবে শিকাগো, কানাডা এবং ক্যালিফোর্নিয়ায়। একই সাথে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন- কোনটায় যাচ্ছেন দেখতে?
আমি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় জবাবটা এভাবেই দিতে পারতাম ‘যতে পারি কিন্তু কেনো যাবো?’

অথবা আমার নিজের ভাষায় যদি বলি, ফোবানায় যাওয়াটা কি খুব জরুরি?

যতদূর জানি, ১৯৮৭ সালের ৩১ অক্টোবর ফোবানার প্রথম আসরটি বসেছিলো ওয়াশিংটন ডিসিতে। সেখানকার কিছু প্রতিভাবান বাঙালি মিলে উত্তর আমেরিকার অ্যাসোসিয়েশনগুলোকে একত্রিত করে একটি সম্মেলন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নর্থ আমেরিকা বাংলাদেশ কনফারেন্স নাম দিয়ে প্রথম দুদিনব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। যার আয়োজক সংগঠন ছিল বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা ইনক ওয়াশিংটন ডিসি (বিএএআই)। সম্মেলন কমিটিতে ছিলেন ভয়েস অব আমেরিকার ইকবাল বাহার চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার ওয়াহেদ এ হোসাইনী, ড. সুলতান আহাম্মদ, ড. ওবায়দুল হক, ড. আমিনুল ইসলাম, সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ, ড. এনায়েতুর রহিম, ড. মোহাম্মদ ইউসুফসহ অনেক প্রতিথযশা বাঙালি।

সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রদূত কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান। প্রবাসে অবস্থানরত জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা সেমিনারে অংশ নেন। পরে নাম পাল্টিয়ে নামকরণ করা হয় ফেডারেশন অব বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ইন নর্থ আমেরিকা। আমেরিকা ও কানাডায় বসবাসরত প্রবাসীদের সম্মিলিত ফোবানা সম্মেলন থেকে সিদ্ধান্ত হয়, বাংলাদেশর সব অ্যাসোসিয়েশন মিলে প্রতি বছর ফোবানা অনুষ্ঠিত হবে। সে থেকেই ফোবানার পথ চলা।
এবার আসুন দেখি কি উদ্দেশ্য ছিলো ফোবানার?

ফোবানার আসল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরা। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সেমিনারের মাধ্যমে দেশে কোন কাজটা সঠিক হলে সরকার উপকৃত হবে তা সরকারের কাছে সুপারিশ করা। সাধারণত কবে, কোন দিন ফোবানা অনুষ্ঠিত হবে তাও নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত লেবার ডে উইকেন্ডে দু’দিনব্যাপী ফোবানা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

তারপর কিছুদিন ভালোই চলছিল। একসময় শুরু হয় অর্ন্তদ্বন্দ্ব। ১৯৯৪ সালে কানাডায় ফোবানা সম্মেলন না হয়ে বিভক্ত হয়ে যায়। একই দিন ৯ মে ড. শাহজাহান মাহমুদের মাধ্যমে বোস্টনে, অন্য অংশ নিউজার্সিতে ড. নুরুন নবীর মাধ্যমে ফোবানা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ভাঙাগড়ার খেলা চলতে থাকে। চলে বহিস্কার পাল্টা বহিষ্কারের  খেলা। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ক্রমেই টুকরো টুকরো হতে থাকে স্বপ্নের ফোবানা।

আমরা যদি গত ফোবানাগুলির পোস্টমর্টেম করি আমাদের চোখের সামনে একটা হতাশার চিত্রই ফুটে উঠে। প্রথম কয়েক বছর ফোবানা তার অভিষ্ট লক্ষ্যের দিকে পরিচালনার চেষ্টা হলেও ১৯৯৪ সালে ৭ম ফোবানা থেকেই শুরু হয় অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে যাত্রা। সে বছর দুটি ফোবানা সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যে বিভেদের যাত্রা শুরু হয়েছিলো সে গাছটি এখন ডালপালা বিস্তার করে মহীরুহ হয়ে উঠেছে। দুই ফোবানা এখন নিয়মিত তিন ফোবানায় রূপ নিয়েছে। এবার অনুষ্ঠিতব্য তিন ফোবানা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

ফোবানা হবার কথা ছিলো উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের একক সম্মেলন। কথা ছিলো এই সম্মেলন প্রতিবছর লেবার ডে উইকেন্ডে বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে এ দেশের জন মানসে প্রোথিত করার লক্ষে বৈচিত্রময় এবং বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলবে। উত্তর আমেরিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসীদের ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করবে। এই ফোবানা থেকে শিক্ষা নিয়ে সম্মেলনে অংশগ্রহনকারী বিভিন্ন সংগঠনগুলো সেই শিক্ষা পরবর্তী এক বছর বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে ছড়িয়ে দেবার মহড়া চালাবে।

কিন্তু এই ফোবানা আমাদের কি দিচ্ছে?

এই ফোবানা এখন ঐক্য বিনাশের একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। একটি দুটি নয়। প্রতি বছর তিনটি ফোবানা জুটছে আমাদের কপালে। আমরা জানিনা দ্বিধা, ত্রিধা বিভক্ত ফোবানা আয়োজন করে কি লাভ হয়? তবে লাভ হয় না তাই বা বলি কিভাবে। প্রতিবছর আমাদের কপালে একটি করে কলঙ্কের তিলক রেখা অঙ্কিত হয়। নিজেদের মধ্যে দলাদলি হিংসা বিভেদ বিভক্তি বৃদ্ধি পায়। ফোবানা যে শহরে ঢুকে সে শহরে সব কিছু তছনছ করে দেয়। কমিউনিটিতে ফাটলের সৃষ্টি করে। ফোবানা অনুষ্ঠানের আগে যারা একজন ছিলো একে অপরের প্রাণপ্রিয় বন্ধু ফোবানা তাদের সে বন্ধুত্ব কেড়ে নিয়ে একে অপরের চরম শত্রুতে পরিণত করে। কমিউনিটিতে সৃষ্টি করে হিংসা, বিদ্বেষ আর অনৈক্যের। আপাত দৃষ্টিতে আমার মতে ফোবানার কাছ থেকে এটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি।

 

আসুন ফোবানা সম্মেলন নিয়ে পত্রিকার কিছু হেড লাইন দেখিঃ
৥  ৩৬তম সম্মেলন হবে শিকাগোতে, যুক্তরাষ্ট্রে ফোবানা থেকে ৪ বিশৃঙ্খলাকারীকে ৫ বছর বহিষ্কার (দৈনিক করতোয়া)

৥  দুর্নীতির অভিযোগে নিজেদের দুই কর্মকর্তাকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে প্রবাসী সংগঠন ‘ফেডারেশন অব বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশন্স ইন নর্থ আমেরিকা’ (ফোবানা)। সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা-১০ এপ্রিল, ২০২২। 
৥    ওয়াশিংটন ফোবানা সম্মেলনে মারামারি- ডেইলি-বাংলাদেশ ডটকম,৭ সেপ্টেম্বর ২০২১।
৥   ফোবানার সাবেক চেয়ারম্যান ও  সেক্রেটারিকে বহিষ্কার (ভোরের আকাশ, জুন,২০২২)।

সংবাদ পত্রের পাতা খুঁলে প্রতিবছর এমনি অনেক চমৎকার (!) হেডিং খুঁজে পাওয়া যাবে। আর এসব আমাদের কি বার্তা দেয়! আবারো লেবার ডে উইকেন্ড আসছে। শিকাগো, ক্যালিফোর্নিয়া এবং কালাডায় আবারো আসর বসবে ত্রিধা বিভক্ত ফোবানার। যখন পত্রিকার পাতা অথবা ফেসবুকে এই বিভক্ত ফোবানার খবর দেখি একটা অজানা দুঃখবোধ নিজের অজান্তে মনের গহীনে ধাক্কা দেয়। যে ফোবানা হবার কথা ছিলো প্রবাসীদেও ঐক্যের প্রতীক সে ফোবানা যখন ত্রিধা বিভক্ত হয়ে অনৈক্যের সানাই বাজায়। 

ফোবানার নামে কমিউনিটির দ্বিধা বিভক্তির অবসান কামনা করি। আমরা সকলকে ঐক্যের ডাক দেই। সাধারণ প্রবাসীদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে জোর উচ্চারণ করি-আমরা আর খ-িত ফোবানা চাই না। 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, নিউইয়র্ক।
 

শেয়ার করুন: