মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

তাঁরা স্বমহিমায় উজ্জ্বল শিল্পী

আগুন জ্বলে ওঠা তিনটি নাম রথীন রফিক শহীদ

আদিত্য শাহীন, সিনিয়র সাংবাদিক

প্রকাশিত: ১২:৫১, ১৪ অক্টোবর ২০২২

আগুন জ্বলে ওঠা তিনটি নাম রথীন রফিক শহীদ

রথীন রফিক শহীদ একটি অনুষ্ঠানে

রথীন রফিক শহীদ। তিনটি শব্দে একটি নামও হতে পারে। হতে পারে তিনটি নাম। নাম তিনটির সঙ্গে একটি করে শব্দ বসানো হলে আগুন জ্বলে ওঠে। চারদিকের সব ধোঁয়া সরিয়ে জ্বলে ওঠে বাংলা আগুন। রথীন্দ্রনাথ রায়, শহীদ হাসান আর রফিকুল আলম। তিনজনই স্বমহিমায় উজ্জ্বল শিল্পী। শহীদ হাসানের জনপ্রিয়তার খামতি থাকলেও গ্রহণযোগ্যতায় তারও উচ্চতা একই রকম। রুচিশীল, স্পষ্টভাষী, শুদ্ধ উচ্চারণের এক বাঙালি। তিনজনই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী যোদ্ধা। তিনজনই বায়ান্ন বছর বয়ে চলেছেন যুদ্ধদিনের অগণিত স্মৃতি। তিনজনের কণ্ঠেই অপরিসীম যাদু।

কাছে না গেলে বোঝা যায় না এই মানুষগুলো কেমন। শিল্পী মো. রফিকুল আলমের কন্ঠের কোনো না কোনো গান শতভাগ বাঙালি শুনেছেন। বহু মানুষ জানেন বাংলাদেশের দুর্দান্ত সফল শিল্পী জুটি মো. রফিকুল আলম আর তার সহধর্মিনী আবিদা সুলতানা। অগণিত বাংলা আধুনিক গান গেয়েছেন তিনি। তার হাসিমাখা উচ্ছ্বলতা আর সুরমগ্ন মুখাবয়ব অগণিত বাঙালির প্রিয়। আর রথীন্দ্রনাথ রায় তো তার নিজস্ব প্রতিভা, গায়কি আর মাটির প্রতি ভালোবাসা দায়বদ্ধতায় অনন্য। তিনি যখন ভাওয়াইয়া বা দেশ গানে কন্ঠ চড়ান, সেই কণ্ঠ যেন ছুঁয়ে যায় দীগন্ত রেখা।

রথীন্দ্রনাথ রায় শহীদ হাসান নিউইয়র্ক থাকেন। এখানকার বাঙালিদের যে কোনো মার্জিত আয়োজনে তারা হয়ে ওঠেন মধ্যমণি। রথীন্দ্রনাথ রায় নিয়মিত দেশে যান। দেশের নানা আয়োজনে অংশ নেন। তিনি কোথায় দীর্ঘদিন বসবাস করেন আর কোথায় কমদিন থাকেন, সে হিসাবটি দর্শক বা তার ভক্তরা বুঝে উঠতে পারে না। তিনি যেন যথার্থ জায়গায় সবসময় উপস্থিত।

বীর মুক্তিযাদ্ধা এই তিন শিল্পী এর আগেও নিউইয়র্কে এক হয়েছেন। এবার রফিকুল আলম এই শহরে কয়েকদিনের জন্য এসেছেন। রথীন্দ্রনাথ গভীরভাবে চেয়েছেন বন্ধুর জন্য একটি আড্ডা আয়োজন হোক কোথাও। আনন্দ হোক। গান হোক স্মৃতিচারণ হোক। কোভিড আমাদের জীবনে মৃত্যুর আকস্মিকতার পেরুলাম ঝুলিয়ে গেছে। সব বয়সীদের মাঝেই সেই পেলুলাম সজোরেই বাজছে। এতে দুটি জিনিস হয়েছে। এক. মৃত্যুক তুচ্ছ করা সহজ হয়েছে। দুই. জীবনের প্রতি মায়াও বেড়ে গেছে। যার সঙ্গে একবার দেখা হয়, তার সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা হওয়ার অনিশ্চয়তা জড়ো হয়েছে। যাদের বয়স ভাটির দিকে, তাদের মনের গভীরে সবসময় এসবের গুঞ্জরণ।

বীর মুক্তিযোদ্ধারা সবসময় মৃত্যুকে তুচ্ছ করতে পারেন। তারা সব সময়, সব প্রেক্ষাপটে জীবনের ডালি সাজাতে পারেন। সেই উদ্দেশ্যেই রথীন্দ্রনাথ চাইলেন প্রাণ সঞ্চারি কিছু হোক। আহ্বান জানালেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, চ্যানেল আই এর যুক্তরাষ্ট্র অফিস প্রধান রাশেদ আহমেদকে। ষাটোর্ধ রাশেদ আহাম্মেদের সঙ্গে তার দুই তুকারি সম্পর্ক। অনেকটা যুদ্ধদিনের সিনিয়র জুনিয়রের মতো। যথাআজ্ঞায় রাশেদ আহাম্মেদ চ্যানেল আই যুক্তরাষ্ট্রের অফিস ভবনেই করে ফেললেন ঘরোয়া আয়োজন। সেখানে থাকলেন তার প্রাণের সংগঠন যুক্তরাষ্ট্র সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের নেতৃবন্দ, কয়েকজন সাংবাদিক আর এখানকার কয়েকজন তরুণ শিল্পী শাহ মাহবুব, রোখসানা মীর্জা, দীপ্তি এরা। যোগ দিয়েদিলেন নন্দিত শিল্পী দিনাত জাহান মুন্নী। শুরুতে সুধীবৃন্দের দুয়েকজন বক্তব্য রাখলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম নিউইয়র্কের সভাপতি, বাংলাদেশ প্রতিদিনের উত্তর আমেরিকা সংস্করণের কর্মধ্যক্ষ লাভলু আনসার।

আয়োজন বিবেচনায় কক্ষটি ছোট্ট। তিনজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিল্পী, কণ্ঠযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক। সেই বিবেচনায় ছোট কোনো পরিসরে তাদের ধারণ করা যায় না। কিন্তু তারা মিশলেন ঘরোয়া আন্তরিকতায়। বললেন, এই আয়োজনের শক্তি বিশাল পরিসরের আয়োজনের চেয়ে কম কিছু নয়। এই আয়োজনে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধিত হলেন।

শহীদ হাসান প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গণসঙ্গীতআমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই ঢাললেন নিজস্ব দরদ। ততক্ষণে অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকে পড়েছে দেশগানে প্রাণিত হওয়ার যাদু। রথীন্দ্রনাথ রায় গাইলেন কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের জীবন সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে মেশানো এক গান। ছয় দফার মুল শক্তিটি গানের কথায় মেশানো। স্বাধীন বাংলা বেতারের গান।পরাণের বন্ধু রে, বলবো কি তোরে, আরে আমার ক্ষেতের সোনার ধান, খাইলো কিসে রেতার কণ্ঠস্বর চড়ে উঠলো মধ্য গগণে। হ্যা, সেই রথীন্দ্রনাথ রায়। কোনো শব্দযন্ত্রে নয়, খালি গলা ছাড়ছেন নিজস্ব উচ্চতার সীমানা বুঝে। সেখানে চাইলেই যাওয়া যায় না।

শেষে শিল্পী রফিকুল ইসলাম। তিনিও শিল্পী জীবনের সবচেয়ে আলোকিত স্মৃতির কাছে চলে গেলেন। মনের ভেতর সোনার অক্ষরে টুকে রাখা স্মৃতির চাঁই থেকে কিছু অংশ খসালেন। সহযোদ্ধাদের স্মৃতিতেও ভাস্বর সেসব। শিল্পসুধায় মগ্নতা এসে গেলে আবেগের সবটুকু সেখানে চলে যায়। যুদ্ধদিনের স্মৃতিমালা শেষে কণ্ঠে এসে যায় সুরের মনোযোগ। গাইলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তার গাওয়া একক গানটি।দেবোনা আমার মাঠের সবুজ আর/ খামার সাজানো স্বপ্নের সম্ভার।

অকালপ্রয়াত সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব লাকী আকন্দের স্মৃতি মনে এনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন শিল্পী রফিকুল আলম। তারপর শোনান সেই গানটি। যার মাধ্যমে রফিকুল আলম হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।তোমাকে যেন ভুলে না যাই, সেই আশিষ দাও মোরে, দূর থেকে যেন ওগো, মরমে তোমায় খুঁজে পাই শিল্পী শাহ মাহবুবের অনুরোধে তিনি শোনান আবু হায়াত মো. কামালের লেখা স্মৃতি তুমি বেদনা ছায়াছবির গানবৈশাখী মেঘের পাশে, জল ছেড়ে তুমি কাঁদবে, আমি চাই না তবলা বাজছিল তপন মোদকের হাতের যাদুতে। শিল্পীও বললেন, বাজনা বেশ মিষ্টি রে!

বহুদিন পর কয়েকটি গান নিউইয়র্কে বসবাসকারী কিছু মানুষের প্রাণে মিশে সজিব হয়ে উঠলো। সত্যিই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানগুলোর মাঝে বাঙালির অমোঘ শক্তি নিহিত।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।

শেয়ার করুন: