শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

যত দোষ নন্দ ঘোষের দেশে

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ১৮:২৩, ৯ জুলাই ২০২২

যত দোষ নন্দ ঘোষের দেশে

ছবি সংগৃহীত

ঈদুল আযহায় সারাদেশের মোটরবাইকারদের জন্য দু:সংবাদ দিয়ে দিলো সরকার। আগে-পরে মিলিয়ে মোট সাতদিন আন্ত:জেলা মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এই সাতদিন কার্যত এক ধরণের দমন-পীড়ণের। অবশ্য এর আগে পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মধ্য দিয়ে এই নিপীড়ণ শুরু হয়। একটি দেশের পক্ষ থেকে এই প্রান্তিক শ্রেণির উপর এই ধরণের নিয়ন্ত্রণকান্ডকে আমি ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করছি। 

ঘটনার জের গত ঈদুল ফিতর। এ সময় সারাদেশে রেকর্ড সংখ্যক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। সে সময় পদ্মা সেতু ছিলো না। তাই দেশের প্রথম দীর্ঘতম যমুনা সেতুতে মোটরসাইকেলের দীর্ঘ সারি লক্ষ্য করেছি। টোল কালেকশনও হয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমানে। এই সময়ে দেশের পরিবহনগুলোয় কিছুটা ব্যবসায়িক মন্দা হয়েছে। কারন হিসেবে বলা হয়েছে ব্যক্তিগত যান হিসেবে মানুষ দুরপাল্লায় মোটরসাইকেলের ব্যবহার বাড়িয়েছে। আর তাতেই টান লেগেছে পরিবহন মালিকদের কলিজায়। 

গত ২৫ জুন মহা ধুমধামে উদ্বোধন করা হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় মেগা প্রকল্প পদ্মা বহুমূখী সেতু। এই সেতু জন সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় পরদিন ২৬ জুন। সেদিন কর্তৃপক্ষের ঢিলেমি এবং উৎসক মানুষের অতিরিক্ত উৎসাহের কারনে বেশকিছু অযাচিত ঘটনা ঘটে। সেতুর ওপরে দুর্ঘটনায় মারা যায় দুই বাইকার। এছাড়া দুরদুরান্ত থেকে সেতু দেখতে আসা অতিরিক্ত বাইকারদের কারনে টোল প্লাজায় বেশ জ্যাম লাগতে দেখা গেছে। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাহিদার তুলনায় টোলবুথ কম, দক্ষ জনবলের অভাব এবং এনালগ পদ্ধতির টোল কালেকশনই মূলত এই জ্যামের প্রধান কারন। তারপরও খড়গ নেমে আসে মোটরসাইকেল আরোহীদের ওপর। রাতারাতি বন্ধ করে দেওয়া হয় মোটরসাইকেল নিয়ে সেতু পারাপার। এরপর রবিবার সেতুর দুইপাশে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়তেও বন্ধ করা হয় মোটরসাইকেল চলাচল। সবমিলে এখন দেশে মোটরবাইকারদের বেশ সঙ্কটকাল। 

হঠাৎ সেতুতে বাইক নিষিদ্ধের পর বিপদে পড়ে যায় হাজার হাজার বাইকার। যারা ওপার থেকে এপারে কিংবা এপার থেকে ওপারে গিয়ে আটকে পড়েছে তারা হতবাক হন এমন হঠাৎ সিদ্ধান্তে। সিদ্ধান্তটি এমনিতেই চলাচলের অধিকার হরণ এরওপর হঠাৎ করে চাপানো তাই ক্ষুব্ধ বাইকারদের আন্দোলন করতেও দেখা যায়। এসময় অনেকেই টোলের কয়েকগুন ভাড়া দিয়ে ট্রাক-পিকআপে করে মোটর সাইকেল এপার-ওপার করেছেন। অনেকেই চোরের মতো নিজ বাইকের সঙ্গে ত্রিপলের নিচে গুটিশুটি মেরে ট্রাকে পাড়ি দিয়েছেন স্বপ্নের পদ্মা সেতু। আহ স্বপ্ন! এই স্বপ্ন কি বাইকারদের কল্পনাতেও ছিলো? এছাড়া অসংখ্য মোটরবাইক নিয়ে ফেরি চলাচল করতেও দেখা গেছে। এতোদিন যে ফেরিগুলোতে বাস-ট্রাকের ভীড় থাকতো সেদিন দেখলাম সেখানে কেবলই মোটরসাইকেল। 

এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধের পর অবশ্যই সেই চিত্র এখন আর দেখতে হচ্ছে না। তবে সারাদেশের আন্ত:জেলা যোগাযোগ বন্ধ করে সরকার কোন চিত্র দেখতে চায় সেটি জানা নেই। 

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩১ লাখের বেশি, যা মোট যানবাহনের ৬৮ শতাংশ। শুধু ঢাকাতেই নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ৮ লাখের মতো। এর বাইরে একটি বড় অংশের মোটরসাইকেল অনিবন্ধিত। বিপণনকারী  কোম্পানিগুলোর হিসাবে, দেশে বছরে প্রায় ৫ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি হয়।

আমাদের দেশে একটি বুর্জোয়া শাসক গোষ্ঠী রয়েছে যাদের কাজই হলো অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা। সেই হিসেবে দেশের মোটরসাইকেল গোষ্ঠী একেবারেই প্রান্তিক। প্রান্তিক এই অর্থে যে যারা বাইকার তারা সবাই একক। মানে তাদের কোনো সংগঠন নেই। ব্যক্তিগত প্রয়োজন থেকে প্রায় সবাই মোটরসাইকেল ব্যবহার করে থাকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে করোনা মহামারি ও ঢাকার গণপরিবহনে সিমাহীন নৈরাজ্যের কারনে রাইড শেয়ারিং অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়ায় মোটরসাইকেলের ব্যবহারে বাণিজ্যিকিকরণ ঘটেছে। এই বাণিজ্য বহু বেকার যুবককে খেয়ে-পরে বাঁচার সংস্থান যোগাচ্ছে। রাজধানীতে বসবাসকারী হিসেবে মাঝে মাঝে আমাকেও এই রাইড শেয়ারিংয়ের সুবিধা নিতে হয়। তখন অনেকের সংগে কথা হয়। কথা ফাঁকে বেরিয়ে আসে সেইসব যুবকদের একান্ত কথাগুলো। কেউ চাকরির ফাঁকে ফাঁকে দিনে দুয়েকটা ট্রিপ দেন। কেউ চাকরি হারিয়ে কিংবা না পেয়ে ফুল টাইম রাইড শেয়ারিং করেন। সবমিলে এটি এখন উপার্জনের বড় একটা ক্ষেত্র বাংলাদেশে। 

রাজধানীতে ভয়াবহ যানজট এবং গণপরিবহনে নৈরাজ্য বহু পূরণো। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও আমরা একটি কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। এটি আমাদের ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে না রাষ্ট্র পরিচালনাকারী কোনো সরকারই। তবে গত প্রায় এক দশক ধরে টানা দেশের শাসক গোষ্ঠী আওয়ামী লীগের দায় অনেকটাই বেশি। কেননা পরিবহন সিন্ডিকেটের বিশাল অংশটি তাদেরই দল ঘেঁষা এবং এখানে তাদের নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে বেশি। এখানে প্রতিদিন শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য। এই বাণিজ্যের ভাগ সরকার ও আওয়ামী লীগের অনেকের পকেটে সরাসরি ঢুকে যাচ্ছে। তাই তারা সরকারি পরিবহন ব্যবস্থা গড়ার দিকে না গিয়ে বেসরকারি পরিবহন বাণিজ্যের দিকে বেশি মনযোগি। 

সরকার ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময় মহাসড়কে নসিমন,করিমন, ভটভটিসহ টু-স্টোক থ্রি হুইলার বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেটি কার্যকর করা যায়নি। আবার বিভিন্ন সময় রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধের ঘোষণা দিয়েও সেটি মানাতে পারেনি। কেননা আমরা দেখেছি এই ধরণের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীতে কী ভয়ানক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়েছে। কথিক আছে সরকার সংশ্লিষ্ট কোনো কোনো প্রভাবশালীর ইন্ধনে তারা রাজধানী অচল করে দিয়েছে, পুলিশের ওপর-হামলা ভাংচুর হয়েছে।   আবার পুলিশও এই সরকারি পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা ও রাজধানী থেকে রিকশা তুলে দেওয়ার বিপক্ষে। কেননা এইখাত তাদের উপরি আয়ের একটা বড় অংশ।

ঈদকে সামনে রেখে মোটর সাইকেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকরও হবে খুব সহজে। কেননা মোটর বাইকররা অসংগঠিত। তাদের কোনো সমিতি কিংবা ইউনিয়ন নেই। হয়তো মোটরবাইক জনিত দুর্ঘটনাও রোধ হবে। কিন্তু ইতোপূর্বে সরকারের যেসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি সেটি নিয়ে কোনো কথা হবে না। কিংবা নতুন করে গণপরিবহন সহজীকরণ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা করা হবে না। রাজধানীর গতি কমিয়ে দেওয়া রিকশা নিয়ে কোনো নতুন সিদ্ধান্ত আসবে না। বিপরীতে মোটর সাইকেল নিয়ে আরো কঠোর অবস্থানে যাবে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ প্রশাসন। হয়তো রাজধানীর মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ আরো তৎপর হবে রাইড শেয়ারিংসহ ব্যক্তিগত মোটর সাইকেল আরোহীদের ব্যাপারে। কিন্তু কেউ কি এইসব বেকার, করোনা ক্ষতিগ্রস্থ কিংবা অল্প আয়ের চাকুরেদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন? যে সিদ্ধান্ত তাদের আয়-রোজগারে পথ দেখাবে? কেউ কি তাদের জন্য কোনো প্রণোদনা ঘোষণা করবেন যাতে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে দু’বেলা খেয়ে পরে বাঁচার নিশ্চয়তা পায়? অতীত ইতিহাস বলে এদের পাশে কেউ থাকবে না। এদের জন্য কারো কোনো মস্তিস্কে একটু খানি যায়গা হবে না চিন্তা করার।

দুর্ঘটনা আমাদের দেশের একটি নিত্য সমস্যা। প্রতি বছর যে সংখ্যক লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় সেটি করোনা মহামারিতেও আমাদের দেশে মারা যায়নি। ইতোপূর্বে বহু ব্যক্তি বহুভাবে এইসব দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করেছেন। সেই কারণগুলো ক্ষতিয়ে না দেখে, সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা না করে দুর্ঘটনার জন্য কেবল মোটর সাইকেলকে দোষ দেয়া হচ্ছে। এ যেন যত দোষ নন্দ ঘোষের মত। এই নন্দ ঘোষদের দেশ থেকে সবাইকে পবিত্র ঈদুল আযহার শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক। 

লেখক: সাংবাদিক ও কথাশিল্পী।  
 

শেয়ার করুন: