মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

দেখে এলাম স্বপ্নের পদ্মা সেতু

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ১৪:১০, ২ জুলাই ২০২২

দেখে এলাম স্বপ্নের পদ্মা সেতু

পদ্মা সেতু

২৬ জুন সন্ধ্যা বেলা। রাজধানীর সেগুন বাগিচা থেকে রওয়ানা হয়ে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে খুব দ্রুতই পৌঁছে যাই পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার কাছাকাছি। তারপর কেটে গেছে দেড়ঘণ্টা। এই দেড় ঘণ্টা ছিলো অন্য রকম অনুভূতি। সামনে হয়তো সামান্য পথ। অথচ গাড়ি চলছে না। যেমনটি প্রতি ঈদে বাড়ি ফেরার সময় এই সড়কে ঘটতো। ফেরি পারাপারের সে দিনের অবসান ঘটেছে। সেতু হওয়ার কারনে এখন আর চাইলেই উত্তাল পদ্মা পাড়ি দেওয়া হবে না। শীতের কুয়াশা, বর্ষার ভয়ঙ্কর সুন্দর বৃষ্টি কিংবা চৈত্র-বৈশাখে হঠাৎ আকাশ কালো করে পদ্মার আকাশে দৈত্যের দেখা মিলবে না। প্রাণ হবে না ওষ্ঠাগত। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাকে দেখতে গ্রামে যাচ্ছি। তাই একটু পরপর ফোন আর জায়নামাজে বসে দুশ্চিন্তায় সময় কাটাতে হবে না তাকে। একটি সেতু অনেকগুলো চিন্তার অবসান ঘটালো। একটি সেতু অনেকগুলো সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিলো। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের পরদিন রবিবার সেগুনবাগিচার রিপোর্টার্স ইউনিটির সামনে থেকে সেতু দেখতে বেরিয়ে পড়ি।

সাংবাদিকদের এই দলে ছিলেন বার্তা সংস্থা ইউএনবির জাহাঙ্গীর আলম, আব্দুর রহমান জাহাঙ্গীর, জাপানের সংবাদ মাধ্যম এনএইচকে’র সৈয়দ মোস্তাক আহমেদ খোকন, নয়াদিন্তের মঈন উদ্দীন খান, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির যুগ্ম সম্পাদক আরাফাত দাড়িয়া, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা সম্পাদক কামাল মোশারেফ ও সাংবাদিক রনি। তবে বরাবরের ন্যয় এই আয়োজনের পেছনে ভূমিকা রেখেছেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও দক্ষ সংগঠক মঈন উদ্দীন খান। 

এদিন ভোর থেকে গণমাধ্যমে খবর আসছিলো সেতুতে মোটরসাইকেলের বেপরোয়া যাতায়াত। সেইসঙ্গে টোলপ্লাজার দীর্ঘ লাইন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতোমধ্যে টিকটকারদের নানা কর্মকান্ড ভাইরাল হয়ে গেছে। একের পর এক ‘প্রথম’ হওয়ার খবর আসছে মূল ধারার মিডিয়ায়। মোটামুটি একটা মিনি অলিম্পিকের মতো অবস্থা। এইসব ‘প্রথম’ হওয়াদের কেবল পদক প্রদানই বাকি ছিলো। বাকি সব শেষ হয়েছে। তারই জেরে সোমবার সকাল থেকে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করে জারি প্রজ্ঞাপণ জারি করে সরকার।  

টোল প্লাজার সামনে অসংখ্য বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল দাঁড়িয়ে আছে। এলোমেলো করে রাখা। কেউ কেউ বাসের জানালা দিয়ে মুখ বের করে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কেউ নেমে হাঁটছে সামনের দিকে। যাদের প্রায় সবাই মোবাইলে ভিডিও ধারণ কিংবা ফেসবুকে লাইভে ছিলেন। কেউ একজন পাশের ট্রাকে থাকা গরুর সঙ্গে কথা বলছেন। মোবাইলে দৃশ্য ধারণ করছেন। গাড়ির জানালা নামিয়ে তার কাছে জানতে চাইলাম কি বললো গরু? লোকটির উত্তর ‘গরু বলছে দেশে গরুর সংখ্যা বাইড়া গেছে, মানুষ মাইনষের... না’। বুঝলাম লোকটি মজার ছলে তার ক্ষোভ ঝাড়লো। আসলেই দেশে গরুর সংখ্যা বেড়ে গেছে। বেশ কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে এমন একটি খবর অবশ্য বেরিয়েছিলো যে দেশে ‘গরু-ছাগলের সংখ্যা বেড়েছে’। মৎস ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে করা ওই প্রতিবেদনটি ছিলো দেশের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে সরকারের সাফল্যের চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস। আর এই ভদ্রলোকের মন্তব্যটি মনে হলো দেশের মানুষের বিবেক বিবর্জিত হওয়ার নমুনা একটি সামান্য উদাহরণ।

আসলেই দেশে গরুর সংখ্যা বেড়েছে। মানুষ রূপী গরুর। যেটি পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে। স্বাধীনতার পর দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন এই পদ্মা সেতু। দেশের মানুষের শ্রমে-ঘামের টাকা দিয়ে গড়া এই স্থাপণা রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ,দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মোট ২১টি জেলাকে একত্রিত করেছে। খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করার পাশাপাশি তা ওই জেলাগুলোর মানুষের জীবনমানে বড় রকমের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে দেশীয় অর্থনীতিকে দিবে আরো শক্ত ভিত্তি। এমন একটি স্থাপণাকে ঘিরে প্রথম দিনে যে কান্ড-কীর্তী দেখলাম, যেসব ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটলো সেটি আসলেই মানুষের দ্বারা ঘটানো সম্ভব নয়। কেবল দু’পেয়ে গরুই সেগুলো করতে পারে।

পৃৃথিবীতে এ ধরণের সেতুসহ অনেক বড় বড় স্থাপণা হয়েছে। রয়েছে মানুষের হাতে গড়া সপ্তাশ্চর্যও। কিন্তু পদ্মা সেতুর মতো এমন কান্ডকীর্তী সেখানে ঘটেছে কি না জানা নেই। আমার ধারণা ঘটেনি। কেননা আমাদের বাঙালি জাতির মতো এমন অবিবেচক, এতোটা কমনসেন্সহিন জাতি পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। এই জাতি কোন জায়গায় কি করতে হয়, কোনটা কোন কাজের জন্য বানানো সেটিও জানে না। জানলেও সেটি মানার প্রবণতা দেখা যায় না। সবকিছু নিয়ে বালখিল্য করা আমাদের জাতিগত চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

সেতুতে মুত্রত্যাগ কিংবা এর নাট-বোল্ট খুলে দেখানো ছাড়াও বেশকিছু ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। এর মধ্যে নারীদের টিকটক কিংবা হুজুরদের নামাজ-কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে অনেকেই ভিন্ন ভিন্ন মত দিচ্ছেন। টিকটকারদের জন্য ভৎসনা থাকলেও নামাজিদের জন্য অনেকের দরদ উথলে পড়তে দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সেতুর ওপরে নামাজ পড়ে বিশাল পূণ্যের কাজ করেছেন। কেউ কেউ রীতিমত বিশ্বজয়ী কারীদের দিয়ে মধুর সুরে কোরআন তেলাওয়াত করাচ্ছেন। সে এক এলাহীকান্ড। মনে হচ্ছে মানুষ এইসব এই আজগুবি কান্ড-কারখানা করবে এ জন্যই জাতির ঘাড়ে বিশাল অর্থনৈতিক বোঝা চাপিয়ে দিয়ে এই সেতু করা হয়েছে। 

রাতে সেতুর জাজিরা প্রান্তে যেতে যেতে মোটরবাইকারদের যে হরেক তামাশা দেখলাম সেটি রীতিমত বিরক্তি ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। পুলিশ-সেনাবাহিনীর টহল টিমও এইসব কমনসেন্সহিনদের বশে আনতে পারছে না। দলে দলে লোক এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাইকে বসে নানাভাবে ভিডিও করছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেমন খুশি তেমন সাঁজো অবস্থা।

আজ থেকে দুই দশক আগে গ্রামের মায়া ছেড়ে পড়াশুনার জন্য ঢাকা এসেছিলাম। ভোরে রওয়ানা দিয়ে গুলিস্তানে যখন পৌঁছালাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। মাঝখানে ফেরিতে পদ্মা নদী পাড়ি দিলাম। জীবনে প্রথমবার পদ্মা নদী দেখার সে যে কি উন্মাদনা তা বলে বোঝানো যাবে না। তারপর জীবনের অনেক দু:খ-সুখ আর ভীতীকর স্মৃতি মিশে রয়েছে এই প্রমত্তা পদ্মার সঙ্গে। সেই নদীর বুকে এখন সেতু। ভাবতেই অন্যরকম অ অনুভূতি কাজ করে। অথচ এইসব মানুষগুলো যে ধরণের অসংলগ্ন-অহেতুক কাজ করলো সেটি আমার সেই অনুভূতিকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। মানুষ কেন এমন হয়? কেন একটি অর্জনকে সম্মান জানাতে পারি না আমরা? 

পদ্মা সেতু নিয়ে রাজনীতি হয়েছে। দেশীয়-আন্তর্জাতিক অঙ্গণে এ সেতুর পরিচিতি শুরু হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ দিয়ে। সরকার এই সেতুকে জনগণের জন্য উপহার হিসেবে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চাইছে। আগামী নির্বাচনে (যদি সত্যিকারের ভোট হয়) এটিকে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করতেই সেতু উদ্বোধনে ব্যাপক শোডাউন করেছে সারাদেশব্যাপী। এটি তাদের প্রাপ্য। তারা সেটি করতেই পারে। আবার সরকার বিরোধীপক্ষও সেতুর ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে জনগণকে তাদের পক্ষে ভেড়ানোর কৌশল নিবে এটাও স্বাভাবিক। তারা বলছে, সরকার উন্নয়নের নামে দেশের যে সম্পদ চুরি করেছে সেটি জনগণের পকেটের টাকা। জনগণের টাকায় পদ্মা সেতু করে উপরি আয় হিসেবে চুরি করেছে সুতরাং এটি নিয়ে সরকারের এতো ক্রেডিট নেওয়ার কিছু নেই।

রাজনীতির মাঠে এমন কৌশল কিংবা অপকৌশল দুটোই থাকুক। তবে একজন সরাসরি সুবিধাভোগি হিসেবে আমি কেবল পদ্মা সেতুকেই দেখবো। যেই সেতু আমার টাকায় গড়া, যেই সেতু আমার সময় ও ভোগান্তি কমিয়ে জীবনকে সহজ করবে আমি তারই পক্ষে। সুতরাং এই সেতুর অমর্যাদা হলে আমার কলিজায় লাগবে। এই সেতুর কোনো ক্ষতি হলে আমি প্রতিবাদ করবো। সেই প্রতিবাদ করতে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থক হওয়া আবশ্যক নয়। একজন দেশপ্রেমিক হওয়াই যথেষ্ট। আমি সেই দেশপ্রেমিকের দলে। 

লেখক: সাংবাদিক ও কথাশিল্পী। 
 

শেয়ার করুন: