শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

বাংলাদেশ ভাসে ভারত উল্লাসে 

মেসবাহ শিমুল

আপডেট: ০০:০৪, ২৫ জুন ২০২২

বাংলাদেশ ভাসে ভারত উল্লাসে 

মূল সড়ক উপচে বন্যার পানি ঢুকছে

আগামীকাল শনিবার দেশের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর সৃষ্টি উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। সেই উন্মোচন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গোটা জাতি যখন উৎসবমুখর হওয়ার কথা ঠিক তখনই দেশের একটি বিশাল অংশ পানিতে ভাসছে। উৎসব দূরে থাক জীবন বাঁচাতে হিমশিম খাচ্ছে তারা। একমুঠো খাবারের আশায় তারা চেয়ে আছে কোনো আগন্তুকের পানে। ত্রাণের জন্য হাহাকার এই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এই মুহূর্তে কয়েক কোটি। অথচ বন্যায় কবলিত হওয়ার আগের দিনও তারা ছিলো সচ্ছ্বল-বিত্তবানদের অন্তর্ভূক্ত। আজ তারা অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষি। 

এই লেখাটি যখন লিখছি তখন সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে সুনামগঞ্জের পাশাপাশি নতুন করে হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া,কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ প্লাবিত হয়েছে। আর উত্তরে বন্যা হানা দিয়েছে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, রংপুর আর যমুনার তীরবর্তী জামালপুরে। পানি বাড়ছে ঢাকার পাশ্ববর্তী বিভিন্ন জেলার নদ-নদীতেও। চট্টগ্রামেও শুরু হয়েছে বন্যা। সমুদ্র তীরবর্তী এ শহর একটু বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায়। তবে এবার সেখানে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি পাহাড়ি জেলা রাঙামাটিতেও বন্যার হানা শুরু হয়েছে। সবমিলে বাংলাদেশ এই মুহূর্তে পানির ওপরে ভাসছে। 

ভারতের সেভেন সিস্টারস বিশেষ করে আসামের চেরাপুঞ্জিতে স্মরণকালের বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেখানকার কয়েকটি রাজ্যে বন্যায় প্রাণহানির ঘটনাও আছে বেশ। সেই পানি তারা ছেড়ে দিয়েছে বাংলাদেশে। যা এখন আমাদের ডুবিয়ে মারছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে টিপাইমুখ বাঁধের সবগুলো গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। দুর্বার-ভয়ানক গতিতে বাঁধের গেট দিয়ে বেরিয়ে আসছে পানি। বাঁধের পাশে ঘুরতে আসা ভারতীয় নাগরিকরা সেই দৃশ্যে উল্লাসে মেতে উঠেছে। ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য সেই দৃশ্য নি:সন্দেহে মনোহর। এমন দৃশ্যে উল্লসিত হওয়ারই কথা। 

প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ভারতীয়দের এমন উল্লাস আমাদের দেখতে হয়। ভাটির দেশ হওয়ায় এটি যেন বাংলাদেশের অমোঘ নিয়তি। উত্তরে ফারাক্কা আর পূর্বে টিপাইমুখ। এই দুই বাঁধ দিয়ে ছোট্ট ভূখন্ড বাংলাদেশকে মরুকরণের যে মহাপরিকল্পনা ভারত নিয়েছে তাতে ইতোমধ্যেই সফলতা এসেছে। উত্তরের ‘লাইফলাইন’ খ্যাত তিস্তা এখন ধুঁধুঁ বালু চর। শুষ্ক মৌসুমে নদীর অস্তিত্ব বলতে সামান্যই চোখে পড়ে। গভীরতা নেই। শুকিয়ে গেছে তিস্তার শাখা নদীগুলো। ধরলার অবস্থাও তাই। তাই এই অঞ্চলের কৃষি এখন সম্পূর্ণ ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এতে করে ধীরে ধীরে পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় ইতোমধ্যে উত্তরাঞ্চলে মরুভূমির আলামত খুঁজে পাওয়া গেছে। অর্থাৎ মরু অঞ্চলে যেসব উদ্ভিদ জন্মে সেগুলোর কিছু কিছু দিনাজপুর, রংপুরে দৃশ্যমান হয়েছে। কিছু বছর পর সেটি বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়বস্তু না থেকে হয়তো সাধারণের চোখেও বাস্তবতা হিসেবে দেখা দিবে। 

এদিকে টিপাইমুখ বাঁধের ফলে সিলেটের সুরমা-কুশিয়ারা নদী প্রায় মৃত। সরু এ নদী দুটির কোথাও কোথাও চর পড়ে পানি প্রবাহ বন্ধ হওয়ার উপক্রম। শুস্ক মৌসুমে সুরমার হাড্ডিসার কঙ্কাল দেখে হয়তো আপনি নিজেও আঁতকে উঠবেন। মরে যাচ্ছে সারি, পিয়াইন নদীও। ইতোমধ্যে জাফলংয়ে ঘটছে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়। সেখানে এক দশক আগেও যে পানি প্রবাহ ছিলো এখন সেটি নেই। পাথর বাড়ছে না। পর্যটকরা হতাশ হয়ে ফিরছেন। সবমিলে টিপাইয়ের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ইতোমধ্যে পড়ে গেছে। 

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ৫৪ টি নদী রয়েছে। এই নদীগুলো আন্তর্জাতিক নীতিমালার মধ্যে। তাই পানি প্রবাহ বন্ধ করলে কিংবা পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত হলে আন্তর্জাতিক আইনে এর প্রতিকার চাওয়ার ও পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই বিষয়টিতে বাংলাদেশের দুর্বলতা রয়েছে। কূটনৈতিক দেনদরবারে আমাদের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ একের পর এক হটকারি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আর মার খাচ্ছি আমরা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) নামের যে একটি কমিশন রয়েছে তার অস্তিত্ব টিকে থাকার প্রয়োজন রয়েছে কি না সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অথচ রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগী এই কমিশনের কাজই হলো দেশের স্বার্থে, নদীর স্বার্থে সর্বোচ্চ লড়াই চালিয়ে যাওয়া। যে লড়াইয়ে  তারা বরাবরই ব্যর্থ হয়ে দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিচ্ছে। 

বলা হচ্ছে সিলেট-সুনামগঞ্জের এবারের বন্যা ১২২ বছরের ইতিহাসে রেকর্ড। অপেক্ষাকৃত ধনী এলাকা হিসেবে খ্যাত সিলেটিদের এই বন্যা একটা চরম শিক্ষাও দিয়ে গেলো। টাকা-পয়সা থাকলেও সব সময় মানুষ সুরক্ষিত থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নাই। তাই মাত্র দিন পনেরো আগে যে সিলেটিরা ত্রাণ সহায়তাকে অবমাননাকর হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলো সেই সিলেটিরাই এখন ত্রাণের জন্য মরিয়া। প্রতিদিন সেখানে লাখ লাখ মানুষকে শুকনো খাবার, রান্না করা খাবার দিচ্ছে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী দল। একটি শুকনো পাউরুটির জন্য কত মুখ তাকিয়ে আছে গলা সমান পানিতে দাঁড়িয়ে। 

বন্যা চলে যাবে। একদিন স্বাভাবিক সেখানকার সবকিছু। কিন্তু আগামী অন্তত এক সিজনের জন্য হাহাকার থাকবে সুনামগঞ্জের কৃষি নির্ভর প্রতিটি ঘরে। বিশেষ করে যেসব পরিবারে কৃষিই একমাত্র কিংবা প্রধান আয়ের উৎসব সেসব পরিবার অবর্ননীয় দু:খ-কষ্টের ভেতর দিয়ে যাবে। কেননা এই বন্যায় কোনো পরিবারই গোলার ধান, কলসের চাল সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে পারেনি। এক কাপড়ে প্রাণ নিয়ে কোনো মতে আশ্রয় নিয়েছে। অনেক পরিবার কোনো আশ্রয় কেন্দ্রেও ঠাঁই পায়নি। তারা রাস্তার কোথাও উঁচু যায়গা পেয়ে সেখানেই আশ্রয় নিয়েছে। এমনই এক ছন্নছেঁড়া জীবনে ভবিষ্যতের কোনো পরিকল্পনা থাকে না। সেখানে সবাইকে বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই আগামী দিনগুলো তাদের সামনে যে ক্ষুধা আর দারিদ্র নিয়ে আসবে তাতে সন্দেহ নেই। 

দেশের উত্তরাঞ্চল এমনিতেই দারিদ্রপীড়িত। এক সময়ের মঙ্গাঞ্চল হিসেবে খ্যাত কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধার মানুষ এখনও ভাতের কাঙাল। জীবন-জীবীকার অনেক কিছুর চেয়ে এখানকার অনেক পরিবারের কাছে তিন বেলা পেট ভরে ভাত খেয়ে বেঁচে থাকাটাই স্বার্থকতা। সেখানে এই বন্যা যে করুন অবস্থার সৃষ্টি করবে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। এ অবস্থায় ফারাক্কা বাঁধের পানি তাদের ওপর প্রায় প্রতি বছরই এমন খড়গ নিয়ে আসে। তবে এবারের অবস্থাটা আগেকার চেয়ে ভিন্ন। কেননা প্রতিবার বন্যা হলে সরকারের নজর কেবল তাদের দিকেই থাকে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কিংবা এ ধরণের ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের চোখও থাকে তাদের দিকে। এবার সেটি ভাগ হয়ে গেলো। তাই সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি যতটা আলোচনায় এসেছে সে তুলনায় রংপুর কিংবা চট্টগ্রামের বন্যার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে না। ত্রাণের বিষয়টিও ঠিক সেরকম। 

এ বারের বন্যা অনেকটাই হুট করে হয়েছে। ফেসবুকে আমার ক্যাম্পাস শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভিডিও দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। যেই ক্যাম্পাসে জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ সময় কাটালাম। ৩২০ একরের এই আঙ্গিনায় কখনো পানি জমতে দেখিনি সেখানে কোমর সমান পানি? ভবনগুলোর সিঁড়ি ডিঙিয়ে পানি ভেতরে ঢুকতে উদ্যত। হলগুলোতে শিক্ষার্থীরা বন্দী হয়ে আছে। সে এক দুর্বিসহ-অবাক করা চিত্র। সিলেট শহরের সবটুকু তলিয়ে গেছে। কোনো কোনো এলাকার ভবনের নিচ তলা সম্পূর্ণটা তলিয়ে গেছে। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। এই বন্যার কেনো আগাম সতর্কতা ছিলো না। ফারাক্কা কিংবা টিপাইয়ের বাঁধ খুলে দিতে হবে সেই তথ্যটিও কেন জানানোর প্রয়োজন মনে করে না আমাদের পরমাত্মীয়রা? নাকি খেয়াল-খুশিমত সীমান্তে যে কোনো কিছু করা যায়? সবকিছুই যদি কোনো দেশ তাদের স্বার্থে খেয়াল-খুশিমত করে তাহলে আন্তর্জাতিক রীতি-নীতির কি হবে? নাকি আন্তর্জাতিক আইন, কূটনৈতিক শিষ্টাচার এর সবগুলোই কেবল বড় দেশগুলোকে তেল মর্দনের জন্য ছোটো দেশগুলোর কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত? 

লেখক: সাংবাদিক ও কথাশিল্পী। 
 

শেয়ার করুন: