মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি ও সরকারের দায়বদ্ধতা 

আহবাব চৌধুরী খোকন

প্রকাশিত: ২৩:২৫, ১৩ আগস্ট ২০২২

জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি ও সরকারের দায়বদ্ধতা 

ফাইল ছবি

বাংলাদেশের মানুষ এই মুহূর্তে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে বিক্ষুব্ধ।  দেশে হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের মূল্য এক লাফে ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। নিউজটি পড়ে আমার পুরনো কথা মনে পড়ে গেলো। আমি যখন দেশে ১৯৮৯ সালে মোটর সাইকেল চালানো শুরু করেছিলাম তখন  পেট্রোলের লিটার ছিল ১৫ টাকা। আমার এখনো মনে আছে আমি ৪৫ টাকা দিয়ে আমার মোটর সাইকেলের জন্য ৩ লিটার পেট্রোল কিনতে পারতাম। আর এখন সেই পেট্রোলের মূল্য বৃদ্ধি পেতে পেতে বিক্রি হচ্ছে লিটার প্রতি ১৩৫ টাকা।

অর্থাৎ সেই সময়ের তুলনায় পেট্রোলের মূল্য প্রায় ৯ গুন বেড়েছে। কেউ কি ভেবে দেখেছেন যেভাবে দেশে জিনিষ পত্রের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে সেভাবে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা  বেড়েছে কি না? ঘুম থেকে উঠে দেখলাম অনেকেই দাম না জেনে যানবাহনের জন্য জ্বালানি তেল ক্রয় করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করার খুব বেশী প্রয়োজন হলে সরকার মূল্য বৃদ্ধি করবে তাতে অসুবিধা নেই। তবে একটু সময় দিয়ে মূল্য বৃদ্ধি করা কি উচিত ছিল না? সরকার ও জ্বালানি মন্ত্রনালয় নূন্যতম এক সপ্তাহ সময় দিয়েও মূল্য বৃদ্ধি করতে পারতো। আর এখন হঠাৎ করে জ্বালানি  তেলের মূল্য বৃদ্ধির সিন্ধান্ত শুনতে হচ্ছে কেন ? গত সপ্তাহে স্বয়ং আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কন্ঠে শুনেছিলাম দেশে পেট্রোল ও অকটেনের প্রচুর মজুদ রয়েছে। পেট্রোল ও অকটেন নাকি আমাদের দেশে বাহির  থেকে পয়সা দিয়ে কিনতে হয় না। গ্যাস উত্তোলনের সময় কোন খরচ ছাড়াই খনি থেকে এগুলো উঠানো যায়। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন এই মুহূর্তে পেট্রোল ও অকটেনের মূল্য বৃদ্ধির কোন পরিকল্পনা কিংবা প্রয়োজন আছে বলে সরকার মনে করছে না।

অথচ জেনে আশ্চর্য হলাম পধানমন্ত্রী কর্তৃক জ্বালানি তেলের মূল্য না বাড়ানোর এমন বক্তব্য দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই সরকার দেশে অস্বাভাবিক হারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করলো। এর পূর্বে বিভিন্ন সময়ে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা হলেও এভাবে এক সাথে কখনো এতোটা মূল্য বৃদ্ধি করতে দেখা যায়নি। ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য লিটারে ৩৪ টাকা বৃদ্ধি করে ১১৪ টাকা, পেট্রোলের মূল্য ৪৪ টাকা বৃদ্ধি ১৩০ টাকা ও অকটেনের মূল্য ৪৬ টাকা বৃদ্ধি করে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। গত ৫ই আগষ্ট জ্বালানি মন্ত্রনালয় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই মূল্য বৃদ্ধির সিন্ধান্ত জানিয়ে রাত ১২টা থেকে তা কার্যকর করে। সরকার একই ভাবে গত নভেম্বর মাসে কেরোসিন ও ডিজেলের মূল্য লিটার প্রতি ১৫ টাকা বৃদ্ধি করেছিলো। এখন হঠাৎ করে যে হারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে তাতে এর প্রভাব যে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। চড়া হারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে নতুন করে বাস, লঞ্চ, ট্রাক ও ট্রেন ভাড়া বৃদ্ধি পাবে। কৃষি খাতে ও ব্যয় বাড়বে। 

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে আমাদের দেশের তুলনায় পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে জ্বালানি তেলের মূল্য বেশী হওয়ায় চোরাচালান  ঠেকাতে মূল্য বৃদ্ধির সিন্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে দেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদগন সরকারের এই খোড়া যুক্তি মানতে রাজি নন। তারা মনে  করেন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তেলের দামের পার্থক্য সব সময়ই ছিল। এখন পাচারের ধুঁয়া তোলে এতোটা মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত যৌক্তিক নয়। বিশ্ব বাজারে ডিজেলের দাম এখন ব্যারেলে ১৭০ ডলার থেকে ১৩০ ডলারে নেমে এসেছে। দেশের বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা মনে করেন বিশ্ব বাজারে প্রতিদিন যেখানে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হচ্ছে  সেখানে হুট করে আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত দেশের জাতীয় অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলবে। দেশে এমনিতেই ডলারের দাম ৮৬ থেকে ১০৮ টাকায় উঠে যাওয়ায় বাজারে চাল, ডাল,  তেল, চিনি, সাবানসহ আমদানী নির্ভর প্রতিটি পণ্যের দাম বহুগুন বেড়েছে। এখন জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব সাধারণ মানুষের জন্য উপর মরার উপর খাড়ার ঘা হিসাবে দেখা দিয়েছে  ।

চোখে পড়লো দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে সামাজিক  যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু বিশিষ্টজনের ক্ষুদ্ধ প্রতক্রিয়া। আওয়ামী লীগ সমর্থক এক আইনজীবী বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের চরম উর্ধগতি ও মুদ্রস্ফীতির ইতিমধ্যেই স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। সেখানে এই মূল্যবৃদ্ধি মানুষের দুর্ভোগ কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবে তা ভাবলেই শিহরিত হতে হয়। প্রশ্ন হলো  জাতীয় নির্বাচন সামনে থাকা সত্ত্বেও সরকার কেন এমন ঝুঁকি নিতে গেল? সরকার এবং জনগণকে এখন বুঝে শুনে চলতে হবে। অন্যথায় মহাবিপর্যয় দেখতে হবে’।  প্রবীন এক  সাংবাদিক লিখেছেন, ‘ব্যবসায়ীদের সরকার হলে এমনটা হয়। বাজার নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতার মূলে হচ্ছে জনগণের পকেট কাটা।  তেলের দাম ৫০% বৃদ্ধি করে জনগণের খরচ ৮০/৯০ ভাগ বাড়ানো হল।’ আবার এক কলেজ শিক্ষক তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়া নিয়ে মানুষের মাথা ব্যথা হতো না, যদি না এর সঙ্গে পরিবহন ভাড়াসহ যাবতীয় জিনিসের দাম না বাড়তো। সরকার তেলের দাম বাড়িয়ে সব কিছুর দাম পক্ষান্তরে নিজেই বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। দ্রব্য্যমূল্য নিয়ে সৃষ্টি হয় অরাজকতা, যেটি পৃথিবীর কোনো  দেশেই এই মাত্রায় দেখা যায় না’।

আরেকজন বলেছেন, ‘বেশিদিন আগের কথা নয়। করোনাকালে দুনিয়জুড়ে লকডাউন চলছে। জ্বালানি  তেলের দাম প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এল। তেল মজুত করার ডিপো সংকট দেখা গেল। পানির দরে তেল বিক্রির সেই সময় বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম একপয়সাও কমানো হয়নি। তখন ভাবতাম -জনকল্যাণমুখী সরকারতো জনগণের সাথে ব্যবসা করতে পারে না! অর্থমন্ত্রী মহোদয় বলেছিলেন যে সস্তায় তেল কিনে পূর্বের দামে (বেশি দামে) বিক্রি করে জ্বালানি খাতের ক্ষতি কমিয়ে আনা হচ্ছে! এখন বিশ্বে যখন তেলের দাম পড়তির দিকে তখন সরকার তেলের দাম বাড়িয়ে দিলো! এর বিরূপ প্রভাব পড়বে দেশবাসীর ঘাড়ে। আয়-বৈষ্যম বাড়িয়ে ফাঁকি বাজির গড় অংক কষে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মলম কাজে আসবে না’। 

কিন্তু মানুষের এই ক্ষোভ বা বিক্ষোভে সরকারের টনক নড়বে বলে মনে হয় না। ইতোমধ্যে দেখেছি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত বিক্ষুদ্ধ মানুষের মিছিলে পুলিশ গুলি ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেছে। পিটিয়ে অনেককে আহত করা হয়েছে। যেখানে গনতন্ত্র কিংবা সাধারণ মানুষের ভোটাধিকারের কোন মূল্য নেই সেখানে সাধারণ মানুষের প্রতি সরকারের কোন দায়বদ্ধতা থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। সরকার ও সরকার দলীয় তথাকতিত জনপ্রতিনিধিরা মনে করছেন ভোটের জন্য তাদেরকে জনগনের নিকট যেতে হবে না। ছল চাতুরির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যখন আবারো কুক্ষিগত করে রাখা যাবে তখন জনগনের জন্য চিন্তা করে কি লাভ? বস্তুত দেশে সুশাসন ও জবাবদিহিতার সরকার যত দিন প্রতিষ্ঠিত না হবে ততোদিন দেশের মানুষকে এভাবে মূল্য দিতে হবে।

তাই জনগনের সরকার প্রতিষ্ঠায় জনগনকেই সর্বাগ্রে সচেতন হতে হবে। দেশে সচেতন ও জবাবদিহিতার সরকার প্রতিষ্ঠা করা গেলে দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করেও ঘাটতি সমন্বয় করা যেত। কিন্তু বর্তমান সরকার সেই পথে হাঁটার প্রয়োজন বোধ করেনি। কারণ স্বৈরাচারী ও অবৈধ সরকারের নিকট জনগনের আবেগ অনুভূতি কিংবা ভালো মন্দেও কোন মূল্য নেই। এখন সাধারণ মানুষেরই ভাবা উচিত জনস্বার্থ নিশ্চিত করতে কোন পথে তাদের হাঁটা উচিত। অন্যথায় জনগনকে এভাবেই নিস্পেষিত হতে হবে।

লেখক: কমিউনিটি নেতা ও কলাম লেখক, নিউইয়র্ক-যুক্তরাষ্ট্র। 
 

শেয়ার করুন: