বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

তেল আর তেল হাত বাড়ালেই শিশি ভরে এইখানে

  মেসবাহ শিমুল,সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ২৩:২৩, ১৩ আগস্ট ২০২২

তেল আর তেল হাত বাড়ালেই শিশি ভরে এইখানে

ফাইল ছবি

পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের নিমন্ত্রণ কবিতার একটি লাইন এমন- ‘শিম আর শিম হাত বাড়ালেই মুঠি ভরে সেইখানে’। আলোচ্য কবিতায় কবি তার শহুরে বন্ধুকে গ্রামের বাড়ি দাওয়াত দিয়েছেন। গ্রামীণ প্রাণ-প্রকৃতির অপূর্ব বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বন্ধুকে আকৃষ্ট করতে আলোচ্য বিষয়টির অবতারণা করেন। ছোটো বেলায় এই কবিতা পড়তে গিয়ে কতবার যে কবির গ্রামে গিয়েছি তার হিসাব নেই। রেললাইনের দুই পাশে ডোবায় ডানকানা মাছের সাতরে বেড়ানো আর হুইসেল বাজিয়ে ট্রেনের ছুটে আসা এমন কত কি...

সেদিন গোপালগঞ্জের গোবরা স্টেশন হয়ে টুঙ্গীপাড়া এক্সপ্রেসে করে যাচ্ছিলাম। ট্রেন ফরিদপুরের মধুখালীতে পৌঁছানো মাত্র পল্লী কবির এই কবিতাটি আবার মনে পড়লো। তারপর কল্পনায় কতকিছুই না চলে আসলো। পাবনার ইশ্বরদী পর্যন্ত যেতে যেতে কবির সেই নিমন্ত্রণ কবিতায় বর্ণিত গ্রামীণ জীবনকে যেন উপভোগ করছিলাম।

তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে-এটি পুরনো খবর। ইতোমধ্যে জনজীবনে যে প্রভাব পড়ার কথা সেটিও পড়েছে। বাকিটা আগামী সেচ মৌসুমে কৃষকের গায়ে পড়বে। তখন পুরোপুরি পড়বে আপনার আমার গায়েও। কেননা আমাদের জীবন-জীবীকার রসদ সবটুকুই কৃষির সঙ্গে মিশে আছে।  

খুবই স্বাভাবিক বিষয় যে, আমাদের মত সমাজ বিপ্লবীরা তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের মাঠে ঝাপিয়ে পড়েছে (সামাজিক মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক)। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ায় হঠাৎ কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে সরকার। স্ট্যাটাসে স্ট্যাটাসে সরকারের বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে এমন যখন পরিস্থিতি তখন কিছু সরকার সমর্থককে দেখলাম সংঘবদ্ধ হয়ে মাঠে নেমেছেন। যারা তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে স্ট্যাটাসে ঝড় তুলছেন ঠিক তাদেরকে টার্গেট করেই যেন একটি কমন পোস্টার শেয়ার করছেন তারা। সেখানে প্রতিবেশি অন্যান্য দেশে বর্তমানে তেলের দাম কেমন তার একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। 

এইসব লোকদের দুয়েকজনকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। এদের কেউ চেতনার দোকানদার, কেউ দোকানদারের সাগরেদ আবার কেউ রাজনৈতিক ভবঘুরে। কেউ একজন তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, আমরা সরকারের ভর্তুকি খেতে খেতে নির্লজ্জ হয়ে গেছি। তাই তেলের দাম বাড়ানোর মতো সময়োপযোগি ও সঠিক সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারছি না। আবার কেউ বলছে, সরকার পাশের দেশে যাতে তেল পাচার হতে না পারে সে কারনে তেলের দাম সমন্বয় করেছে। বিষয়টি এমন যে, সরকার এই সমন্বয় না করলে আগামী দু’চারদিনের মধ্যে দেশের সব তেল পাচার হয়ে যেত। এমন আরো অনেক উদ্ভট সব যুক্তি উপস্থাপণ দেখলাম তাদের।

এর আগেও যখন গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি কিংবা পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি হলো তখনো এইসব অন্ধ দলদাসদের কার্যক্রম দেখেছি। এরা এমন যে, সরকারের কোনো সিদ্ধান্তকে কেউ অপছন্দ করুক সেটি তারা মেনে নিতে পারে না। অথচ এই সরকারের ১৩ বছরের শাসনামলে যতগুলো জনবিরোধী পদক্ষেপ নিয়েছে তার সবগুলোতেই সবার প্রতিবাদ জানানোর পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। যদিও আমাদের এই স্বাধীনতা ভোগের বিষয়টি এখন অনেকটাই কেবল সামাজিক প্ল্যাটফর্ম নির্ভর। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দেখেছি অতিরিক্ত সেশন ফির প্রতিবাদে আন্দোলন হচ্ছে- সেখানে বাধা দিচ্ছে সরকার সমর্র্থিত ছাত্রসংগঠন। হলের ডাইনিংয়ে খাবারের মান খারাপ, শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন-সেখানে তাদের হামলা। বিশেষ করে সারাদেশে কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে যেভাবে পুলিশের সহায়তায় সরকার সমর্থিতরা হামলা করেছে তাতে মনে হয়েছে এরা নিশ্চয়ই এই দেশের নাগরিক নয়। এরা এদেশের পরিবহনে চড়ে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে না। 

ঠিক এবারও যেভাবে এইসব দালালরা মাঠে নেমেছে তাতে মাঝে মাঝে মনে হয় এরা খায় কি? পায় কোথায়? কোন বাজার থেকে বাজার করে? কিংবা এদের আয়ের উৎস কি? অবশ্য এইসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বেশি কঠিন নয়। তারাও আমাদের সমাজেরই লোক। আমাদের চারপাশেই এদের বসবাস। জীবন-জীবীকার রসদের যোগানও কমন কিছু যায়গা থেকে আসে। পার্থক্য কেবল অর্থের উৎস আর দাসত্বের মাত্রায়।  

তেলের দাম বাড়ানোর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচিত হচ্ছে। সেখানে তিনি বলেছেন জ্বালানি তেল বাংলাদেশকে কিনতে হয় না। এটি বাইপ্রোডাক্ট। প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ জ্বালানি তেল বাইরে রপ্তানিও করতে পারে। এই ভিডিও শেয়ার করে নেটিজেনরা জানতে চেয়েছেন- তাহলে দেশে উৎপাদিত জ্বালানি তেলের দাম বাড়লো কেন? এই প্রশ্ন করাটা খুব স্বাভাবিক। অবশ্য এই ভিডিওটি সামনে আসার পর সরকারের সাফাই গাওয়া সেইসব তেলবাজদের খুব একটা চোখে পড়ছে না।  

গেল রবিবার দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন তাদের প্রধান শিরোনাম করেছে ‘রেন্টালে রিজার্ভের সর্বনাশ’। সেখানে তারা বলেছে ১৮ টি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারনে দেশের রিজার্ভে টান পড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও এইসব কেন্দ্র কিভাবে ৭০ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে গত এক যুগে সে বিষয়ে খুটিনাটি প্রকাশ করেছে পত্রিকাটি। দেশে বিদ্যুতের ঘাটতিতে যখন সারাদেশে লোডশেডিং চলছে ঠিক সেই মুহূর্তে তেলের দাম এক লাফে প্রায় অর্ধেক বেড়ে যাওয়ায় জনগণের মধ্যে নতুন করে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। জীবন যাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এই ক্ষোভের জন্ম নিরার্থক নয়।

ভোজ্য তেলের পর জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে মানুষের খাবারের থালায় হাত পড়েছে। কাটছাট শুরু হয়েছে বাজারের তালিকায়। দেশের কোটি কোটি মানুষ তিন বেলা সুষম খাদ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যে পরিবার সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও গোস্ত খেতে পারতো তাদের হয়তো মাসে একবার খেতে হবে। এরই মধ্যে অতিরিক্ত খরচে লাগাম টেনে অনেকে সামাজিক বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে যাওয়াও বাদ দিয়েছেন। 

এই যে টানাটানির জামানা শুরু হয়েছে না জানি এর শেষ কোথায়। আদৌ হবে কি না সেটিও অনিশ্চিত। কেননা বিশ্ববাজারে তেলের দাম যখন রেকর্ডভাবে কমেছে তখন আমাদের দেশে সেটি রেকর্ড ভেঙে বেড়েছে। তাই ধরেই নেওয়া যায় এই ধারা আর নি¤œগামি হবার নয়। হলেও ওই রুটি ওয়ালা আর রাজার কাহিনীর মতো হবে। 

এক দেশে এক রুটি ওয়ালা ছিলো। সে প্রতি পিস রুটি ৫ টাকা দরে বিক্রি করছিলো। এভাবে দীর্ঘদিন বিক্রির পর দেখলো এই দামে রুটি বিক্রি করে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। তবে জনগণের প্রতিক্রিয়ার ভয়ে সে রুটির দাম বাড়াতে পারছিলো না। তো একদিন সে রাজার কাছে গিয়ে বললো রাজা মহাশয় আমি চাই প্রতি পিস রুটি ১০ টাকা হোক। কিন্তু জনগণের জন্য সেটি বোঝা হবে ভেবে আমি দাম বাড়াতে পারি না। রাজা মহাশয় তাকে অভয় দিয়ে বললেন, কোনো ভয় নেই। তুমি প্রতি পিস রুটি ৩০ টাকা করে বিক্রি শুরু কর। রুটি ওয়ালা রাজার কথা শুনে অবাক হলেন। বলেন কি মহাশয়! এক লাফে ত্রিশ টাকা!

রাজা তাকে অভয় দিয়ে বললেন, কোনো ভয় নেই। যা বলেছি সেটি কর। বাকিটা আমি দেখছি। অভয় নিয়ে এবার রুটি ওয়ালা দোকানে ফিরে গেলেন। প্রতি পিস রুটির দাম ত্রিশ টাকা দরে বিক্রি শুরু করলেন। জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। রাজার কাছে এসে করলো নালিশ। রাজা সবকিছু শুনে তার সেনাপতিকে হুকুম দিলেন রুটিওয়ালাকে ধরে আনতে। এবার জনগণের সামনে রাজা ইচ্ছেমত ধমকালেন রুটিওয়ালাকে। বেত্তমিজ, বে-ইনসাফি। প্রতি পিস রুটি ত্রিশ টাকা করেছিস! নিয়ে নেব তোর গর্দান। আমার রাজ্যে বসে আমার জনগণের সঙ্গে এত্তোবড় তামাশা! যা এখন থেকে প্রতি পিস রুটি অর্ধেক দামে বিক্রি করবি। রুটি ওয়ালা এবার দ্বিগুন আশ্চর্য হয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে গেলো। সেই থেকে রাজার বদান্যতায় প্রজারা প্রতি পিস রুটি ১৫ টাকা করে কিনে খেয়ে তারাও মহা আনন্দে বসবাস করতে লাগলো আর রাজার গুনকীর্তনে মত্ত থাকলো। 

লেখাটি শুরু করেছিলাম পল্লী কবির একটি লাইন দিয়ে। শেষ করতে চাই বিখ্যাত ইংলিশ কবি এসটি ক্লোরিজের কবিতা ‘দ্য রাইম অব দ্য এনসিয়েন্ট মেরিনার’র সেই বিখ্যাত লাইনটি দিয়ে- ডধঃবৎ, ধিঃবৎ বাবৎুযিবৎব. ঘড়ৎ ধহু ফৎড়ঢ় ঃড় ফৎরহশ. অর্থাৎ সমুদ্রে অথৈ পানির মধ্যে থেকে যেমন পিপাসা মেটানোর জন্য একফোটা পানি পায়নি বৃদ্ধ নাবিক। তেমনি চারিদিকে এতো তেলবাজ থাকার পরও তেলের সঙ্কট হওয়াটা ওই বৃদ্ধ নাবিকের মতোই দুর্ভাগ্যের বিষয়। 
 

লেখক: সাংবাদিক ও কথাশিল্পী। 
 

শেয়ার করুন: