শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

আমাদের একজন সাকিব আল হাসান ছিলো!

হাবিব রহমান

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ১৩ আগস্ট ২০২২

আমাদের একজন সাকিব  আল হাসান ছিলো!

ফাইল ছবি

আজ থেকে ১০০ বছর পর যদি আমি জন্মাতাম তা হলে আমার লিখার শিরোনামটা সম্ভবত এভাবেই হতো। নতুন প্রজন্মের কাছে গর্ব ভরে তাকে পরিচয় করিয়ে দিতাম এভাবে যেবাংলাদেশি সাকিবুল হাসান যিনি ছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা অল-রাউন্ডার একাধারে দলের সেরা ব্যাটসম্যান এবং সেরা বোলার। .মুহাম্মদ ইউনুসের পর তিনিই বিশ্বের ক্রীড়াঙ্গনে আমার দুঃখিনি বাংলাকে একটা উজ্জ্বল আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য আমি সাকিব আল হাসানের সমসাময়িক সময়েই জীবিত আছি। আমাকে দেখতে হয় সেই সংবাদগুলো যখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেসাকিবের বেয়াদবিশিরোনামে ফলাও করে ছাপা হয়। মেজাজ হারিয়ে ঢাকা লীগে লাথি দিয়ে স্টাম্প ভেঙে দিয়েই যিনি শুধু ক্ষান্ত থাকেন না স্টাম্প উপড়ে ফেলার মত বিতর্কিত ঘটনাও ঘটান। আর সেই ঘটনাটি যখন গুরুত্ব সহকারে বিশ্ব মিডিয়া প্রকাশ করে, ক্রিকেটের জনপ্রিয় ওয়েবসাইটগুলো যখন এই ঘটনা লিড করে, ঘটনার ভিডিও যখন ফেসবুকে ভাইরাল হয় আমার হৃদয়টা তখন ভাঙ্গা কাচের মত চুর চুর হয়ে যায়।

সাকিবুল হাসান আমার প্রিয় ক্রিকেটার। রাত জেগে থেকে নির্ঘুম চোখে তার খেলা দেখি। সাকিব যখন মাঠে থাকেন তখন একটা স্বস্তি নিয়ে টেলিভিশন সেটের সামনে বসি। ভাবি খেলা আমরা জিতবোই কারণ মাঠে সাকিব তো আছেন। সে আশা কখনো পূরণ হয়, কখনোবা হয়না। তবে সেজন্য মনে কোন দুঃখবোধ কাজ করেনা কারণ খেলাতে হারজিত তো থাকেই। আর এভাবেই মনকে শান্তনা দেই।

গত সপ্তাহে টিভিতে বাংলাদেশ জিম্বাবুয়ের খেলা দেখছিলাম। সেদিন মাঠে সাকিব আল হাসান ছিলেন না। তারপরও আমাদের ছেলেরা ব্যাটিং করে তিন শতের ঘর পেরিয়ে গেলো। মনটা একটা তৃপ্তিতে ভরে উঠেছিলো এই ভেবে যে আমাদের ছেলেরা ক্রমেই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে। সিনিযরদের ছাড়াই এখন কাঙ্খিত লক্ষ্যের দিকে এগোতেই পারছে। কিন্তু আমার ভালো লাগার সে বেলুনটি অল্পতেই চুপসে যায় যখন একটু পরেই দেখি নিশ্চিত বিজয়টা হাতছাড়া হয়ে গেলো। আর তখনই সাকিবের অভাবটা বড় হয়ে ঝংকার তুলেছিলো মনের ভিতর। ভাবছিলাম যদি সাকিব আল হাসান আজ মাঠে থাকতেন তা হলে ব্যাপারটা হয়তো অন্যরকম হতেও পারতো।

ক্রিকেটে হারার ব্যাপারটা হয়তো ভুলেই যেতাম যদি না নিউইয়র্কের সংবাদপত্রগুলোতে সাকিব আল হাসানকে নিয়ে কিচু নিউজ চোখে না পরতো। তবে নিউজগুলো ক্রিকেটের নয় তিনি একটি হল ঘরে এক এক করে ভক্তদের সাথে ছবি তুলেছেন। তবে তা ভালোবাসায় নয়। তিনি প্রমোটারদের হয়ে অর্থের বিনিময়ে লোকদের সাথে ছবির পোজ দিচ্ছিলেন।

নিউজটা দেখে মনটা একরাশ বিরক্তিতে ভরে গেলো। সাকিব খেলার মাঠে থেকে হেরে গেলেও তেমন খারাপ লাগতোনা। কিন্তু খেলা বাদ দিয়ে যখন নিজকে ভাড়ায় খাটিয়ে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হল ঘরে বসে ছবির পোজ দিয়ে অর্থ অর্জনে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন তখন বড়ই খারাপ লাগে। মানুষের আবেগের মূল্য না দিয়ে যেনতেনভাবে অর্থ উপার্জনইটাই কি তার কাছে বড় হয়ে গেলো! অথচ সাকিব সেদিন মাঠে থাকলে বাংলাদেশ একটা বড় লজ্জার হার থেকে বাঁচলেও বাঁচতে পারতো।

সাকিব আল হাসান! আপনি তো খুব ব্যস্ত মানুষ। খেলা, ব্যবসা, প্রমোটারদের হয়ে ভাড়া খাটা কতো কাজ আপনার! তারপরও কি কখনো কখনো সোস্যাল মিডিয়ায় যাওয়ার সময় হয়? ফেসবুক কি দেখেন? আপনি কি জানেন আপনাকে নিয়ে আপনার ভক্তরা কি মন্তব্য করে?

আপনি যখন মিরপুরের মাঠে স্টাম্প ভেঙেছিলেন তখন মাহবুবুর রহমান নামে একজন লিখেছিলেন, ‘এমন আইডল দরকার নেই বাংলাদেশের। যার কারণে বিশ্ব দরবারে অপমানিত হতে হয় বাংলাদেশকে। এমন বিশ্বসেরা অল রাউন্ডারের দরকার নেই।টিটু সরকার নামে একজন লিখেন, ‘সাকিব একজন আইকন। তাকে ফলো করে এমন তরুণ কিশোরের অভাব নেই। একজন অভিজ্ঞ ক্রিকেটার হয়ে সাকিব যদি মাঠে এমন আচরণ করে তবে ফলোয়াররা কি শিখবে!’

আপনাকে নিয়ে এমনি অনেক অনেক কমেন্ট ছিলো সোস্যাল মিডিয়ায় যা আপনাকে সম্মানিত করেনা।

আপনার এই ঘটনার কিন্তু অনেক পোস্ট মর্টেম হয়েছিলো। সেদিন অনেকে এও বলেছিলেন, ডিপিএলের মাঝপথে আমেরিকা যাবার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করা আপনার জন্য জরুরি ছিলো। একজন পরিচ্ছন্নকর্মী সেদিন হেসে হেসে বলেছিলো: ইচ্ছে করে আম্পায়ারের সাথে বেয়াদবি করে নিষিদ্ধ হবার ধান্ধা। নিষিদ্ধ হলেই আমেরিকা যেতে কিংবা আইপিএলের বাকী ম্যাচ খেলতে সুবিধা হবে। সাকিব, আপনার সম্পর্কে সাধারণ মানুষ এমনি করেই ভাবে। কিন্তু এমনটি কি হবার কথা ছিলো?

আমার এই লেখা পড়ে কেউ আবার ভেবে বসবেন না যে আমি সাকিব বিদ্বেষী। তা কিন্তু মোটেও নয়। আমি সাকিবের অনুরাগী। আমি সাকিবকে ভালোবাসি। ক্রিকেটকে ভালোবাসি। বাংলাদেশকে ভালোবাসি। আমি বিশ্বের দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই। সাকিবের নামে আমিও পরিচিত হই। বছর আগে আমি নিউজিল্যান্ড গিয়েছিলাম। শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে অকল্যান্ডের একটি হোটেলে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। রিসেপসান থেকে একজন দৌডে এসে আমার রুমে ঢুকে টেলিভিশনটা অন করে বলে দেখো তোমাদের বাংলাদেশের টিম নিউজিল্যান্ডে খেলছে। অল রাউন্ডার সাকিব আল হাসানও এসেছে তুমি তার খেলা দেখবেনা? সাকিবের এই সম্মানে আমার বুকের ছাতিটা সেদিন এক বিঘত বড় হয়ে গিয়েছিলো।

সাকিব আল হাসান, আমার বড় কস্ট হয় যখন লোকে বলে-সাকিব সেরা অল রাউন্ডার নয়, সেরা ধনকুবের হতে চান। সাকিব ইচ্ছে করেই বিতর্কে জড়ান। সমর্থকদের পেটানো, বোর্ডের কোন নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করা, দেশের হয়ে না খেলার হুমকি দেয়া, কারণে অকারণে ছুটি নেয়া, জুয়াড়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ, সিনিয়র ক্রিকেটারদের নিয়ে অশালীন মন্তব্য করা এসবই আমাদের প্রিয় সাকিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ। সাকিব আপনার বিতর্কের তালিকা কেন এত লম্বা হয়? গত সপ্তাহেও আপনি জুয়া সংক্রান্ত একটা বিতর্কে জড়িয়ছেন। কেন বিসিবি,আইসিবি আপনাকে শাস্তি দেয় ? কেন, সাকিব কেন?

সাকিব আপনার দুর্দান্ত পারফরমেন্স নিসন্দেহে আপনাকে বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার বানিয়েছে। আপনার যোগ্যতা নিয়ে আমাদের কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু দুধের গাভীর মত আপনি যখনই সুযোগ পান বিসিবিকে যখন লাথি দেন আমাদের তখন খুব কস্ট হয়। কস্ট হয় যখন মাঝে মাঝে দেশকে নিলামে তুলে দেন তখন। কস্ট হয় যখন তখন বলে বসেন ওমুক দেশে টেস্ট খেলতে যাবোনা। টেস্ট খেলার চেয়ে যখন আইপিএলকে বেশি গুরুত্ব দেন, যখন মনে হয় ব্ল্যাকমেইল করছেন বোর্ডকে। আচ্ছা সাকিব আল হাসান বোর্ডের একজন বেতনভুক্ত খেলোয়াড় হিসাবে চাইলেই কি যখন তখন ছুটি চাইতে পারেন? কোন নিয়ম নীতি নেই? না আপনার উপর তা প্রযোজ্য নয়!

বাংলাদেশ ক্রিকেটের একজন কর্মকর্তা জালারের একটা কথা প্রসঙ্গে কোট করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, মিরাজ যদি এমন আবদার করতো তাহলে বিসিবি প্রধান তাকে দুটি থাপ্পর দিতেন। তবে সাকিবকে থাপ্পর দেয়ার সাধ্য কারো নেই, উল্টো ঝুঁকি আছে থাপ্পর খাওয়ার।

সাকিব, আপনাকে ক্রিকেট বোর্ডের ভালোবাসা পাওয়ার কথা। কিন্তু না, উল্টো তারা আপনাকে ভয় পায়। কিন্তু কেন?

গত সপ্তাহে কাজ বাদ দিয়ে জিম্বাবুয়ের সাথে বাংলাদেশের খেলা দেখলাম। অত্যন্ত ভালো খেলেছে আমাদের ছেলেরা। মাত্র ২উইকেট হারিয়ে তারা ৫০ ওভার খেলে ৩০৩ খেললো। ওয়ানডেতে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে এটা ভালো স্কোর। কিন্তু তারপরও তারা হেরে গেলো। আপনি দলে থাকলে এমনটা হতোনা বলেই অনেকে মনে করেন। আপনি নিজের বাড়ি বা শশুর বাড়ি যাই বলিনা কেন আসতেই পারেন যখন তখন কিন্তু ক্রিকেটকে অবহেলা করে কেন? আপনি যখন প্রমোটারের থেকে টাকা নিয়ে যে কারো সাথে বসে ছবি তুলেন। তারা আপনাকে খুশি করতে অযথা স্তুতি আওড়ায় দেখে মনে হয় আপনারও ভালো লাগেনা। তারপরও টাকা নিয়ে যেহেতু প্রমোটারের কাছে বিক্রি হয়েছেন আপনাকে সবই মেনে নিতে হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের চোখে তা খুবই দৃষ্টিকটু ঠেকে। আপনার কাছে কি মনে হয় না? না সবুজ ডলারের কাছে কি সব কিছু ম্লান হয়ে যায়?

সেদিন একজন বললো, উত্তরবঙ্গের একটি সংগঠন আপনাকে দাওয়াত দিয়েছিলো পিকনিকের যাওয়ার জন্য আপনি হাজার ডলার দাবী করেছিলেন? আমি কিন্তু বিশ্বাস করতে চাইনি। সাকিব আল হাসানের কাছে টাকাটাই বুঝি সব! মানুষের ভালোবাসার কোনই গুরুত্ব নেই?

সাকিব আল হাসান আপনি ভালো খেলেই আজ অল রাউন্ডার হয়েছেন এতে কারো কোন দ্বিধা নেই। কিন্তু আপনার প্ল্যাটফর্মটা ছিলো বাংলাদেশ। সারা বিশ্বে আপনি বাংলাদেশটাকেই রিপ্রেজেন্ট করেন। কিন্তু সেই দেশটাকে যখন অবহেলা করেন তখন সারা দেশবাসীর সাথে আমারও বড় কস্ট হয়।

মানুষের যখন দেয়ালে পিঠ লেগে যায় তখন সে রুখে দাঁড়ায়। অভিযোগ আছে আপনার জন্য বোর্ড ক্রিকেটারদের জন্য কোন শৃঙ্খলাবিধি কার্যকর করতে পারছেনা। লোকে বলে বোর্ডের পিঠ এখন দেয়ালে গিয়ে ঠেকেছে। তারা যে কোন সময় রুখে দাঁড়াতে পারে। ইদানীং বোর্ডের কথাবার্তায়ও এমনই মনে হয়। আপনার কাছে আমার একটা বিনীত অনুরোধ, সোস্যাল মিডিয়ার লেখাগুলো মাঝে মধ্যে পড়বেন। তাহলে বুঝতে পারবেন সাধারণ মানুষ আপনাকে নিয়ে কি ভাবে। একটু হলেও বুঝতে পারবেন আপনার পায়ের নীচের মাটি আস্তে আস্তে সরতে শুরু করেছে। মানুষ ক্রমেই আপনার কর্মকা-ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে। কারণ খেলোয়াড় কখনো দেশের চেয়ে বড় হতে পারেনা।

আপনি নিউইয়র্কে এলে জ্যাকসন হাইটসে মাঝে মধ্যে আড্ডা দেন। প্রমোটারটারদের চাহিদা মিটাতে গুলশান টেরেস, ওয়ার্ল্ড ফেয়ার মেরিনার অনুষ্ঠান করতে যান। সেখানে কিন্তু একদিন যে কেউ একটা ব্যানার নিয়ে আপনার সামনে এসে দাঁড়াত পারে কারণ এটা বাক স্বাধীনতার দেশ। সেখানে হয়তো লেখা থাকতে পারে-সাকিব গো ব্যাক বাংলাদেশ। ক্রিকেটার সাকিব তুমি মাঠে ফিরে যাও। কোরবানীর গরুর মত প্রমোটারদের কাছে নিজেকে অযথা নিলামে তুলোনা। বৃহস্পতিবার, ১২ আগস্ট ২০২২, নায়েগ্রা ফলস নিউইয়র্ক।

শেয়ার করুন: