মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

পদ্মা সেতু: একটি স্বাধীন দেশের স্বনির্ভরতার চ্যালেঞ্জ

ড. আলা উদ্দিন

প্রকাশিত: ২৩:২৫, ২৪ জুন ২০২২

পদ্মা সেতু: একটি স্বাধীন দেশের স্বনির্ভরতার চ্যালেঞ্জ

রাতের পদ্মা সেতু মনোমুগ্ধকর

পদ্মা সে একটি স্বপ্ন, একটি স্বাধীন দেশের স্বনির্ভরতার চ্যালেঞ্জ। এ সেতু নির্মাণের সময়, অর্থ, ব্যয় ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা আছে। তার অধিকাংশ যদি সত্যও হয়, এর বাস্তবায়ন তথা সেতু স্থাপন করার মধ্য দিয়ে সব জল্পনা-কল্পনা, গুজব মøান। বাংলাদেশে প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও অবকাঠামো নির্মাণের ধারায় বারবার সময় বৃদ্ধি ও অর্থের পরিমাণ বাড়ানো কিংবা অপচয় অনুচিত হলেও তা দীর্ঘদিনের প্রচলন। এটির অবসান সময়ের প্রয়োজন। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ যে সাফল্যের সঙ্গে এই প্রথম এত বড় কর্ম সম্পাদন করল, তাতে অন্য কোনো কথা আর গুরুত্ব পায় না। সেতু ভিন্ন বাকি সব যেন চাপা পড়ে যায়! পদ্মা সেতুই যেন মুখ্য আলোচ্য ও বিবেচ্য বিষয়।

বিশালত্বের দিক থেকে অর্থায়ন ও কর্মসম্পাদন যে এককভাবে সম্পন্ন করা যায়, তা এতদিন ছিল ভাবনার অতীত। আজ তা বর্তমান ও বাস্তবিক। এ সেতু আমাদের সেতু। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ এ সেতুর মালিক। কারণ এর অর্থায়ন করেছে এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ। সুতরাং এ সেতু বাস্তবায়নে সক্ষমতা এবং স্বপ্ন ও চ্যালেঞ্জের মধ্যকার যে মজবুত তেুুবন্ধ রচিত হয়েছে তার গৌরব ও মালিকানা নিতান্তই এ দেশের মানুষের। এই অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য বিশ্বব্যাংকের মতো প্রকা- প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করে, তাদের সব দাবি অগ্রাহ্য ও পরাজিত করে বাংলাদেশের মান সমুন্নত ও উচ্চাসীন করার অনন্য কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার। ২০১২ সালে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণ চুক্তি বাতিল করে তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়চিত্তে ২০১৩ সালের মে মাসে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সংকল্প ব্যক্ত করেছিলেন। দেশবাসীও তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে এসেছে। অবশেষে সবার সম্মিলিত প্রয়াসে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। অচিরেই বাংলাদেশের মানুষ এর সুফল পেতে শুরু করবে।  

দেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী পদ্মার ওপর নির্মিত ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক ও রেল সেতু দেশের প্রধানতম এবং পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম সেতু। এ সেতু দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক বিস্ময়। আশা করা যাচ্ছে পূর্ণোদ্যমে কার্যক্রম শুরু হলে সেতুটির ওপর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৭৫ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। সেতুটির মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর জেলাসহ দক্ষিণাঞ্চল প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত হবে এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ স্থাপিত হবে। অর্থাৎ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের সোনালি ভবিষ্যেক দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করে সার্বিক উন্নয়নে প্রভূত ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে।

এ প্রসঙ্গে পদ্মা সেতু সম্পর্কিত কিছু মৌলিক তথ্য উপস্থাপন করা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি। বিশ্বের ১১তম দীর্ঘ এ সেতুর পুরো নাম ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’। সেতুটি নির্মাণের জন্য ৯১৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। এই প্রকা- সেতুর নির্মাণ প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এবং ইংরেজি ঝ আকৃতির সেতুর নকশা প্রণয়ন করেছে আমেরিকার মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম অঊঈঙগ। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার (২০,২০০০ ফুট) এবং প্রস্থ ১৮ দশমিক ১০ মিটার (৫৯.৪ ফুট)। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর। সেতুটি রক্ষণাবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এবং তদারকির দায়িত্ব পালন করছে কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। উল্লেখ্য, এ সেতুর নিকটতম সেনানিবাস হলো পদ্মা সেনানিবাস।

নির্মাণশৈলী ছাড়াও এটি অত্যন্ত শক্তিশালী সেতু। কারণ এর প্রধান নির্মাণ উপকরণ হচ্ছে কংক্রিট ও স্টিল। এর ভূমিকম্প সহনশীল মাত্রা ৯। সেতুিিটর ভায়াডাক্ট ৩ দশমিক ১৮ কিলোমিটার এবং পিলার ৮১টি। মোট স্প্যান সংখ্যা ৪১। প্রতিটি স্পেনের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার এবং প্রতিটি স্পেনের ওজন ৩ হাজার ২০০ টন। এ সেতুর স্থানাঙ্ক ২৩.৪৪৬০ ডিগ্রি (উত্তর) এবং ৯০.২৬২৩ ডিগ্রি (পূর্ব)। উল্লেখ্য, পানির স্তর থেকে এই অত্যাধুনিক সেতুর উচ্চতা ৬০ ফুট এবং এর পাইলিং গভীরতা ৩৮৩ ফুট। সেতুটির নির্মাণকাজে প্রায় চার হাজার জনবল নিয়োজিত। সেতুটিতে গ্যাস, বিদ্যুৎ, অপটিক্যাল লাইনসহ সব ধরনের পরিবহন সুবিধা থাকছে। দ্বিতলবিশিষ্ট সেতুর উপরের তলায় চার লেনের সড়ক এবং নিচতলায় রেললাইন।

পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক হচ্ছে জাজিরা ও মাওয়া এবং সংযোগ সড়কের দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। দুই পাড়ে নদী শাসন ১২ কিলোমিটার। এ সেতুর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজংয়ের সঙ্গে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হবে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৯টি জেলার সঙ্গে সংযোগ ত্বরান্বিত হবে। অর্থাৎ, সারা বাংলাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সংযোগ আরো বেশি সহজ ও সুগম হবে।  সেতু নির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। টোল আদায় করে এ ব্যয় ওঠাতে সময় লাগবে ৩৫ বছর। নির্মাণের ব্যয় ও সময় বারবার বাড়ানো না হলে দুই দশকের মধ্যেই নির্মাণ ব্যয় তোলা সম্ভব ছিল। উল্লেখ্য, শুরুতে এর ব্যয় ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা ধরা হলেও সর্বশেষ তা তিন গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায়। প্রধান খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি। তবে সেতুতে কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সেতুটির আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে ১০০ বছর।

পদ্মা সেতুর মতো এত বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য সত্যিই একটি চ্যালেঞ্জ। তার পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সারা দেশের মানুষের অংশগ্রণের মাধ্যমে এটি বাংলাদেশের অন্যতম সাফল্যে পরিণত হয়েছে। এ সফলতা সহজে বাস্তবায়ন হয়নি। আর্থিক সংকট, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বিশ্বাস, মনোবল ইত্যাদি ছাড়াও নানা ধরনের বিষয় সামাল দিতে হয়েছে।  

পদ্মা সেতু নির্মাণের সফলতা কেবল এ সেতুর সচলতার মধ্যে নির্দিষ্ট নয়। পদ্মা সেতু যেমন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্ধনের মাধ্যমে গোটা দেশের সঙ্গে সংযোগ ও যোগাযোগ স্থাপন করবে, তেমনি যোগাযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাপর খাতের সংযোগ ও সুষম সমন্বয় অপরিহার্য। সব খাতের মাঝে সুষম সংযোগ ও সমন্বয় সাধনপূর্বক বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত রাষ্ট্রনীতির আলোকে দেশ পরিচালিত হলে বাংলাদেশের উন্নয়নের গাড়ি ক্রমে অগ্রসর থাকবে। আর তাই বলা যায়, সোনার বাংলামুখী অভিযাত্রার মাঝেই মূলত পদ্মা সেতু  নির্মাণসহ সব চ্যালেঞ্জ ও উদ্যোগের সার্থকতা নিহিত।

বাংলাদেশ যখন পরাধীন তখন বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার। সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে তার অকুতোভয় নেতৃত্বে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে স্বপ্ন দেখেছিলেন শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার, সোনার বাংলা গড়ার। কিন্তু তাকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে খুনিরা তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে দেয়নি। আজও তা অপূর্ণ রয়ে গেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার স্বপ্ন পূরণ সহজসাধ্য না হলেও  মোটেও তা অসাধ্য নয়। পদ্মা সেতুর সফল নির্মাণে দেশের মানুষও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। কেবল পদ্মা সেতু নয়, সর্বস্তরের মানুষের জীবনের গতির ইতিবাচক পরিবর্তনের (শোষণহীন, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক) মাধ্যমেই সম্ভব বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করা। সে লক্ষ্যে দেশ এগিয়ে যাক, এটাই জাতির প্রত্যাশা।  

 লেখক: অধ্যাপক ও সাবেক সভাপতি, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
 

শেয়ার করুন: