শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

আমেরিকার আধিপত্য বিস্তারের ধারাবাহিক পরিকল্পনার ছক ইউক্রেন যুদ্ধ

সুব্রত বিশ্বাস, সভাপতি যুক্তরাষ্ট্র-উদীচী 

প্রকাশিত: ২০:৩৫, ৫ আগস্ট ২০২২

আমেরিকার আধিপত্য বিস্তারের ধারাবাহিক পরিকল্পনার ছক ইউক্রেন যুদ্ধ

আমেরিকার আধিপত্য বিস্তারের ধারাবাহিক পরিকল্পনার ছক ইউক্রেন যুদ্ধ

ইউক্রেন যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির একটি বিপর্যয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন অনেক আমেরিকান বিশ্লেষক। কলম্বিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফরি জি সেক্স মনে করেন ইউরোপ যদি দুরদর্র্শী হতো তবে তারা ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে নিজেদের দূরে রাখতো। ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ধ্বংসাত্মক পররাষ্ট্র নীতির সাথে শরিক হতো না। জেফরি জে মতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউকন বা নব্য রক্ষণশীলদের সর্বশেষ বিপর্যয় হলো ইউক্রেন যুদ্ধ। নব্য রক্ষণশীলরা গত ৩০ বছর ধরে তীব্র যুদ্ধ উন্মাদনায় আক্রান্ত। বাইডেন প্রশাসনে বর্তমানে গিচগিচ করছে নব্য রক্ষণশীল বা নিউকন কনজারভেটিভ আন্দোলনের সাথে জড়িত লোকজন।

এরাই এর আগে ১৯৯৯ সালে সার্বিয়া থেকে শুরু করে ২০০১ সালে আফগানিস্তান, ২০০৩ সালে ইরাক, ২০১১ সালে সিরিয়া লিবিয়া যুদ্ধে টেনে এনেছে যুক্তরাষ্ট্রকে। সীমাহীন ব্যর্থতার বিপর্যয়ই তাদের একমাত্র রেকর্ড। তাদের সর্বশেষ বিপর্যয়ের উদাহরণ হলো ইউক্রেন যুদ্ধ। জেফরি জে পরামর্শ দিয়েছেন এখনও সময় আছে ইউরোপের এই বিপর্যয়ে যুক্তরাষ্ট্রর সাথে আরো না জড়িয়ে বেরিয়ে আসার। ১৯৭০ সালে শিকাগো বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নিওট্রাস ইওল বিশ^বিদ্যালয়ের ডোনাল্ড কাগানের নেতৃত্বে কয়েকজন বুদ্ধিজীবী শুরু করেন নিউকন আন্দোলন। বর্তমানে যেসব নিউকন নেতা রয়েছেন তারা হলেন ভিক্টোরিয়া নোলেন, পল উইল উইস, নরমেন পথরেস, ইরভিং ক্রিস্টান, ডোনাল্ড কাগানের ছেলে রবার্ট কাগান, ফ্রেডরিক কাগান, ইলিয়ট কোহেন, ইলিয়ট আব্রাবাস এবং কিমবারলি এলিন কাগান।

বর্তমান বাইডেন প্রশাসনের স্টেট ফর পলিটিক্যাল এফেয়ার্সে আন্ডার সেক্রেটারী ভিক্টরিয়া নোলান্ড হলেন নিউকন আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ডোনাল্ড কাগানের পুত্রবধু। তার স্বামী রবার্ট কাগানও নিউকন আন্দোলনের বর্তমান নেতা। নিউকন আন্দোলনের মূল কথা হলো বিশে^ সর্বত্র যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। উদীয়মান শক্তি হিসেবে অবশ্যই যুদ্ধের মাধ্যমে দমন করা হবে-যাতে তারা কখনো যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানাতে না পারে। এজন্য সারা বিশে^ থাকতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের শত শত সামরিক ঘাঁটি। আর সবসময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবেজাতিসঙ্ঘকে কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থেই ব্যবহার করতে হবে।

২০০২ সালে পল উইলফিউস যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের জন্য একটি ডিফেন্স পলিসি গাইডেন্সের খসড়া প্রণয়ন করেন। এখানে তিনি নিউকনদের এসব লক্ষ্য বর্ণনা করেছেন। নিউকনদের এই পরিকল্পনার আলোকে গত দুই দশক ধরে বিশে^ বিভিন্ন প্রান্তে ্যাজিম চেঞ্জ অপারেশন পরিচালনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের পরিকল্পনাতে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোকে ইউক্রেন পর্যন্ত সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর পরিণতি এখন ইউক্রেন যুদ্ধ। ইউক্রেন পর্যন্ত ন্যাটোর সম্প্রসারণকে নব্য রক্ষণশীলরা যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক বৈশি^ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায় হিসেবে মনে করেন।

জেফরি জে সেক্সের মতে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার পরিণতি সম্পর্কে জানতেন অনেক নিউকন নেতা। তারা নিশ্চিত ভাবে জানতো যে রাশিয়া যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা জেনেশুনেই ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করার পথে পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া উভয় ইউক্রেনকে একটি বাফার স্টেট হিসেবে নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে রাখার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু নব্য রক্ষণশীলরা সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্রকে ওখানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। ইউক্রেনকে বাফার স্টেট হিসেবে রাখার আর প্রয়োজন নেই বরং ন্যটোর সদস্য বাড়াতে হবে। আর সেটাকে রাশিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত নিতে হবে। ইউক্রেনে এভাবে নব্য রক্ষণশীলরা যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে টেনে আনে। নব্য রক্ষণশীলদের ধারণা ছিল ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হবে। এতে করে বিশ^ব্যাপী অব্যাহত থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তার।

পৃথিবীর ১৭০টি দেশে আমেরিকার তাবেদার সৈন্য এবং ঘাঁটি রয়েছে। আধিপত্য বিস্তার অক্ষুন্ন রাখতে এসব সৈন্যদের পুলিশি প্রহরায় রাখা হয়েছে। এজন্য সবসময় যুদ্ধন্মোদনা জিইয়ে রাখা আছে। যুদ্ধের আশঙ্কা এবং নিরাপত্তার ভয় তৈরি করে তাবেদার দেশগুলোকে অস্ত্রে সজ্জিত করে তোলা হয়। ইউক্রেন যুদ্ধকে সামনে রেখে বলা হচ্ছে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিরে পেতে রাশিয়ার এই যুদ্ধ। এই ভয় আশঙ্কা থেকে ইউক্রেনের পাশ^বর্তী ইউরোপকে অস্ত্র সজ্জিত করে যুদ্ধ জোটে বাধা হয়েছে এবং হচ্ছে। আর এর থেকে আমেরিকার অস্ত্র কোম্পানিগুলো সেখানে চড়া দামে অস্ত্র বিক্রি করে মুনাফা লুটে নিচ্ছে। এমনি ইরাক যুদ্ধে জনৈক সাংবাদিক লিখেছিলেন, যুদ্ধে অনেকের ক্ষতি হলেও ডিক চেনির ব্যবসার উন্নতি হয়েছে। 

ভৌগলিকভাবে আল্টান্টিকের ওপারে থাকায় যুদ্ধের ক্ষেত্রে আমেরিকা একটি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। সেকারণে নিজেরা সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে যুদ্ধ করে কাজ হাসিলের তালে থাকে। ইউক্রেন যুদ্ধে প্রায় ষাট লক্ষ ইউক্রেনীয় শরণার্থী হয়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। দেশের অর্থনীতি, উন্নতি, অগ্রগতি প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে। আমেরিকার তাতে ভ্রক্ষেপ নেই, কারণ তারা তাদের অস্ত্র বিক্রির বাজার, প্রয়োজন তাগিদ বাড়াতে পেরেছে। যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রতিবেশী দেশগুলো তেল গ্যাস সংকটে হিমশিম খাচ্ছে। তাদের স্বাভাবিক এবং নিশ্চিত অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থাকে খাদের কিনারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যখন কোভিড পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আত্মনিয়োগ করবে তখন ইউক্রেন যুদ্ধ বাধিয়ে পৃথিবীর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ব্যহত করতে এবার তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে নতুন যুদ্ধন্মোদনা সৃষ্টি করা হচ্ছে।

 অন্যদিকে আমেরিকার প্রশাসন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার নিয়ে প্রায়ই প্রশ্œ তোলা হয়। অথচ গণতন্ত্র মানবাধিকারের কথা বলে নিজেরাই গণতন্ত্র মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। নিজেদের স্বার্থ প্রয়োজনে এসব লঙ্ঘনে কিংবা নীতি পরিবর্তনে লজ্জা শরমের বালাই নেই। ইউক্রেন যুদ্ধে তেলের দাম স্থিতিশীল রাখতে অবাঞ্চিত ঘোষিত ভেনেজুয়েলা, সৌদি আরব ইরানের হাতে পায়ে ধরতেও লজ্জাবোধ হয়নি। ট্রাম্প শতাব্দীর চুক্তির নামে ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখলের আয়োজন করেছিলেন। ঠিক একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আর সুরক্ষার নামে বাইডেন বন্দোবস্ত করেছেন দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষাকে কণ্ঠরোধ স্তিমিত এবং সৌদি ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে। কয়েক বছর আগে যখন ট্রাম্প মার্কিন সমাজকে খ্রিস্টীয় শে^তাঙ্গ জাতীয়তাবাদের উন্মাদনায় প্রায় আড়ষ্ট করে ফেলেছিলেন তখন বাইডেন নির্বাচনী প্রচারণায়ইনশা আল্লাহবলে ওয়াদা করেছিলেন আবার মার্কিন মুলুককে নিজস্ব গতিপথে ফিরিয়ে আনার। একইসঙ্গে জনসমক্ষে অঙ্গীকার করেছিলেন সৌদি আরবকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবাঞ্ছিত করার এবং বিন সালমানকে অবশ্যই খুনের জন্য পরিণাম ভোগে বাধ্য করার কথা। কিন্তু তিনি কথা রাখেননি। বাইডেন শুধু অঙ্গীকার ভঙ্গ করেই ক্ষান্ত হননি বরং প্রেসনোট জারি এবং বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠক করে রেহাই দিয়েছেন খাসোগি হত্যা মামলা থেকে।

খাসোগি শিরিন হত্যাকান্ড কোনও অচেনা ঘটনা নয়। ২০১৮ সালের গ্রীষ্মে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের মধ্যে মোহাম্মদ বিন সালমানেরনিজস্ব বাহিনীরকর্তৃক খুন হয়েছিলেন খাসোগি। তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের নথিতে উঠে এসেছে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ। কনস্যুলেটের মধ্যে মানুষ খুনের নজির সম্ভবত আধুনিক জামানায় এই প্রথম। ঘটনায় হতবিহ্বল মানুষের বিক্ষোভকে বিন সালমান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিয়েছেন ট্রাম্প কুশনারের মিত্রতায় ভর করে। দ্বিতীয় হত্যাকান্ডটি ঘটেছে চলমান এই গ্রীষ্মে। আরব বিশে^ প্রখ্যাত নারী সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ নিহত হন ইসরায়েলী সৈন্যদের গুলিতে পশ্চিম তীরের জেনিন শরণার্থী শিবিরে।

শিরিনের স্মরণে আল-জাজিরার প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং শিরিনের সহকর্মী মারওয়ান বিশারা লিখেছেন, মাতৃভূমি দখল করে নেওয়া ইসরায়েলীদের সঙ্গে নিয়মিত মোকাবিলা করেছেন শিরিন। নিঃস্ব ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠের আওয়াজ ছিলেন তিনি। প্রতিনিয়ত নির্ভরতা জুগিয়েছেন আধিপত্যবাদ বিরোধীদের বিক্ষোভে। রাবাত থেকে রিয়াদের লাখ লাখ ঘরে শিরিন ছিলেন প্রেরণা প্রতিরোধের নাম। আর সেই খাসোগি-শিরিন হত্যাকান্ডে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মুক্তি দিতে প্রায় সরদারের ভূমিকা রেখেছে ট্রাম্প-বাইডেন প্রশাসন। সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, আমেরিকা পৃথিবীব্যাপী লুটপাট করে আজ মোড়ল সেজেছে। আসলে সেটাই বাস্তবতা, বিশ^ব্যাপী আধিপত্য বিস্তার করে লুটেপুটে মোড়লত্ব প্রতিষ্ঠাই আমেরিকার প্রধান এবং অন্যতম লক্ষ্য। আর তার অনুসঙ্গ হলো যুদ্ধ।

শেয়ার করুন: