বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

সাপ্তাহিক নবযুগ :: Weekly Nobojug

বিলাসিতায় বিবেক মরে, রক্তচোষার সুযোগ বাড়ে

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ২০:৩২, ৫ আগস্ট ২০২২

বিলাসিতায় বিবেক মরে, রক্তচোষার সুযোগ বাড়ে

প্রতিকী ছবি

প্রয়োজনের অতিরিক্ত যতটুকু ততোটুকুই বিলাসিতা। অর্থনীতির ভাষায়ও এভাবে বলা আছে। মানুষ সহজে থেকে মুক্তি পায় না। দিনকে দিন তার বিলাসরোগ বাড়তেই থাকে। মনের ভেতরে খায়েশ নামের যে পাগলা ঘোড়া রয়েছে একবার ছুটলে তাকে আর লাগাম দেওয়া যায় না।

সম্প্রতি একটি খবর নিয়ে বেশ হইচই চলছে। তবে সেটি মোটেই মূলধারার গণমাধ্যমে নয়। সামাজিক মাধ্যম হয়ে দেশের বিভিন্ন মহলে বেশ সমালোচিত হচ্ছে সেটি। মূল ধারায় সংবাদটি নেই কেননা খবরটি ঘটিয়েছন মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমের নামকরা বেশ কিছু সাংবাদিক। তাই যারা খবর করেন তাদের খবর করে দেবেন এই সাধ বা সাধ্য আছেই বা জনের।

খবর হলো- বাংলাদেশের জ্বালানি খাত নিয়ে কাজ করেন এমন সংগঠনটির অন্তত ৩০ জন সংবাদকর্মী ইউএস বাংলার বিমানে চড়ে মালদ্বীপ গিয়েছেন প্রমোদ ভ্রমনে। সেখানে নীল জলের মধ্যে তাদের লাফালাফি-দাপাদাপির ছবি ইতোমধ্যে ফেসবুক হয়ে আমাদের নজরে আসছে। বিলাসিতার এই মুহূর্তগুলো আসলেই খুব উপভোগ্য।

প্রশ্ন আসতে পারে আবার নতুন কি? এমন তো হরহামেশাই দেখা যায় আমাদের দেশের সাংবাদিক কমিউনিটিতে। দেশ এবং দেশের বাইরে ফি বছর এমন অসংখ্য ট্যু হয়ে থাকে। তাতে দোষের কি?

বিষয়টি নিয়ে ব্যারিষ্টার সুমন একটি লাইভ দিয়েছেন। তিনি সেখানে একটি বিষয় পরিস্কার করার চেষ্টা করেছেন সেটি হলো- সারাবিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও এখন জ্বালানি তেলের ঘাটতি রয়েছে। তেলের অভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। সরকার ঘোষণা দিয়ে সারাদেশে লোডশেডিং কার্যকর করেছে। সারাদেশের মানুষ এই গরমের দিনরাত লোডশেডিংয়ে পড়ে অস্থিও সময় কাটাচ্ছেন। সেখানে ধরণের একটি দায়িত্বশীল সংগঠন যারা কিনা এই জ্বালানিখাতেরই ভুল-ত্রুটি,ভালে-মন্দ নিয়ে সারাক্ষণ ভাবেন, যারা সংবাদ করলে সরকার সে অনুযায়ি ব্যবস্থা নেয় তারা কি করে এমন আয়োজন করতে পারে? তিনি তার ভিডিওতে দাবি করেছেন সাংবাদিকদের এই গ্রুপটি বসুন্ধরা, সামিটসহ যেসব কোম্পানি দেশের জ্বালানিখাত নিয়ন্ত্রণ করে সে রকম বেশ কয়েকটি গ্রুপের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে তারপর মালদ্বীপে গেছেন। বিলাসিতার এই বিতর্কিত কান্ডে বিস্ময় প্রকাশ করে ব্যরিষ্টার সুমন ওই ভিডিওতে তার এই দাবি মিথ্যা তা প্রমাণে সাংবাদিকদের প্রতি চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দিয়েছেন। এসময় তিনি আরো জানান, এই মুহূর্তে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামও বেশকিছু সাংবাদিক নিয়ে কুষ্টিয়ার লালনের আখড়ায় সুখনৃত্যে মশগুল রয়েছেন। ঘটনা দুটি যদি সত্যি হয় তবে ব্যারিষ্টার সুমন সাহেবের সঙ্গে আমিও বিস্মিত।

আমাদের দেশে সাংবাদিকদের পেশাগত পরিচয়ের জন্য জাতীয় প্রেসক্লাব এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি রয়েছে। এর পাশাপাশি তাদের পেশাগত অধিকার সুরক্ষার জন্য রয়েছে সাংবাদিক ইউনিয়ন। মোটা দাগে একজন প্রকৃত সংবাদকর্মীর পরিচয় এর মধ্যেই পাওয়া যায়। এইসব সংগঠনের পরিচয় দিতে তিনি যেমন সাচ্ছ্যন্দ বোধ করেন তেমন বাইরের একজন ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানও তাকে মূল্যায়ন করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাংবাদিকদের বিট ভিত্তিক সংগঠন উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। সংবাদকর্মীরা তাদের কর্ম এলাকা নির্ধারণ করে ছোটো ছোটো ভাগে বিভক্ত হয়ে অসংখ্য সংগঠন দাঁড় করিয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই বিটে একাধিক সংগঠনও রয়েছে। এইসব সংগঠনের কাজের মধ্যে এই ধরণের বিলাসি আয়োজনই মূখ্য। বছর শেষে পিকনিক, এজিএম, কক্সবাজার কিংবা দেশের বাইরের সমুদ্র ¯œানে যাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে এই সব সংগঠন সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে ব্যাপকহারে অর্থ আদায় করে থাকে। সহজ কথায় একে চাঁদাবাজিও বলা যেতে পারে। তবে কোনো কোনো সংগঠন এই বাইরে পেশাগত উৎকর্ষ সাধনেও কিছু কিছু কাজ করে থাকে এটাও সত্যি।

আমাদের দেশে ডিজিটাল মিডিয়ার আগমনের পর থেকে হুহু করে বেড়েছে সংবাদ মাধ্যম। টেলিভিশন, সংবাদপত্র অনলাইন মাধ্যমে একটি বিশাল শ্রেণি সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করছেন। ফলে কাজের পরিধি যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে এই ধরণের সংগঠনের সংখ্যাও। অথচ এইসব সংগঠনের সদস্য আবার মূল সংগঠন হিসেবে জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি কিংবা কোনো না কোনো ইউনিয়নের সদস্য। তাই এইসব বিট কেন্দ্রিক সংগঠনের গড়ে ওঠা কিংবা এর সদস্য হওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন। তাদের সেইসব প্রশ্নের  যৌক্তিক জবাবও হয়তো রয়েছে। আলোচনা সেদিকে নিচ্ছি না।

একজন পেশাদার সংবাদকর্মী হিসেবে আমিও ধরণের বিট কেন্দ্রিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। সংগঠনের সংবিধান অনুযায়ী ধরণের সংগঠনের সদস্য হলে পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের পাশাপাশি কাজের পরিধি বাড়ে। কিন্তু এই পরিধি বাড়াতে গিয়ে ধরণের বিতর্ক নিশ্চয়ই কাম্য নয়।

বলা হয় সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। এই পেশায় পাওয়ার চেয়ে না পাওয়ার গল্পই একজন প্রকৃত সাংবাদিকের ঝুলিতে বেশি থাকে। দেশের জন্মেও ইতিহাসের সঙ্গে যে সব সাংবাদিকের নাম জড়িত রয়েছে তাদের জীবনী ঘাটলে বিষয়টি স্পস্ট হওয়া যায়। আবার এখন যারা আমাদের সমাজে প্রবীণ তাদের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায়ও বিষয়টি উঠে আসে। সেখানে নিজের জীবনের পাওয়া না পাওয়ার চেয়ে সংবাদকর্মী হিসেবে দেশ সমাজের জন্য অবদান রাখতে পারাকে গর্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। তারা তাতেই আনন্দ খুঁজে বেড়ান। অথচ সময় পাল্টেছে। সেই দিন নেই। নেই সেই সাংবাদিকতা। মহান পেশার সেই সাইনবোর্ড খুলে ফেলে একে কেবল রুটি-রুজির মাধ্যম হিসেবে নিতে হচ্ছে আমাদের। সেটি করতে গিয়ে অনেকেই আমরা এখন ধরণের সংগঠনের ব্যানারে চাঁদাবাজি করছি। বিলাসী জীবনের মোহে পড়ে উচিত-অনুচিত ভুলে যাচ্ছি।

গল্পের আড্ডায় বসলে এখন একটি বিষয় বেশ অকপটেই আমরা স্বীকার করি তা হলো এখন আর সেই সাংবাদিকতা নেই। সাংবাদিকতার নামে এখন আমরা যা করি তার প্রায় সবটুকুই কেরানিগিরি। রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের হিসাব-নিকাশে পড়ে আমরা যা জানি তা লিখি না। আবার যা লিখি তা নিজেই ধারণ করি না। এই বৈপরীত্য নিয়ে কোনো পেশা মহৎ হতে পারে না। তাইতো দিনকে দিন এই পেশার মানুষের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমছে। সম্মান এবং ভক্তির বদলে আক্রোশ কিংবা উপহাসের পাল্লা দিনকে দিন ভারী হচ্ছে। পত্রিকার বিক্রি কমেছে। টেলিভিশনের দর্শক কমেছে। অনলাইনে পাঠক আটকে রাখা যাচ্ছে না।

একজন সাংবাদিককে জাতির বিবেক বলা হয়। কলমের ভাষায় জাতিকে পথ দেখান তিনি। যে কেনো ক্রান্তিকালে মানুষ যখন দিশেহারা হয়ে পড়েন তখন গণমাধ্যমে চোখে রেখে তিনি স্বস্তি খুঁজে পেতে চান। একজন সাংবাদিক তাদের আশ্বস্ত করেন। আশা-ভরসা যোগান। নিকশ অন্ধকার শেষে আলো ঝলমলে সকাল আসবে এই সত্যকে সামনে এনে জাতীকে করেন উজ্জীবীত। তাই গতানুগতিক ধারায় আর সবাই ভেসে গেলেও সাংবাদিককে ভেসে গেলে চলে না।

দেশে এখন সত্যিকারার্থে একটি ক্রান্তিকাল চলছে। এই সময়ে জ্বালানি বিটের সাংবাদিকরা বিলাসিতায় ডুবে থাকবেন সেটি আসলেই দৃষ্টি কটু। বছরের অন্যান্য সময় হলে নিশ্চয়ই বিষয়টি নিয়ে এমন বিতর্ক হতো না। যেহেতু জ্বালানি সঙ্কটের কারনেই দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং চলছে তাই এই বিটের সাংবাদিকদের বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত ছিলো। তারা যাদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে এই ধরণের আনন্দ ভ্রমণে রয়েছেন সেই স্টেকহোল্ডাররা যে এই সঙ্কটকে আরো প্রকট করেনি তাই বা কি করে উড়িয়ে দেই! সাংবাদিকদের বোঝা উচিত ছিলো বিলাসিতায় বিবেক নষ্ট হয়। আর এই বিবেকরা নষ্ট হলে তাতে রক্ত চোষাদের সুযোগ বেড়ে যায়। যার খেসারত দিতে হয় পুরো জাতিকে।

লেখক: সাংবাদিক কথাশিল্পী। 

শেয়ার করুন: